প্রতি বছর ৪ লাখ দক্ষ কর্মী নেবে জার্মানি, কতটা লাভবান হবে বাংলাদেশ?
প্রতি বছর বিদেশ থেকে চার লাখ দক্ষ কর্মী নিয়োগ দেবে ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশ জার্মানি। আর এ থেকে লাভবান হতে পারে বাংলাদেশ। তবে এই সুযোগ কাজে লাগাতে সামনের দিনগুলোতে যেন জার্মানির শ্রমবাজার বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে।
বাংলাদেশ ও জার্মানির মধ্যে বর্তমানে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রমিক নিয়োগের কোনো চুক্তি না থাকলেও জার্মানিতে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস জানিয়েছে, ইউরোপীয় শ্রমবাজারের সুবিধার পেতে দুই দেশের সরকারের (জিটুজি) মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের চেষ্টা করছে তারা।
জার্মানির নতুন জোট সরকার দেশের জনসংখ্যাগত ভারসাম্যহীনতা এবং বিভিন্ন খাতে শ্রমিক ঘাটতি মোকাবেলায় প্রতি বছর বিদেশ থেকে ৪ লাখ যোগ্য কর্মী নিয়োগ দিতে আগ্রহী। দেশটিতে বিশেষ করে কোভিড মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোয় দক্ষ লোকবলের অভাব দেখা দিয়েছে। গত ২১ জানুয়ারি বার্তাসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।
জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোঃ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, "জার্মানি এখন দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতিতে ভুগছে; বিশেষ করে হোটেল, রেস্তোরাঁ কর্মী, নার্স ও পরিচর্যাকারীদের অভাব দেখা দিয়েছে। যেসব খাতে কর্মী প্রয়োজন সেসব খাত সম্পর্কে আমরা আগামী সপ্তাহে আরও বিস্তারিত জানতে পারবো।"
"আমি ইতোমধ্যে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। তাদের নির্দেশনা অনুসারে, আমরা একটি আনুষ্ঠানিক শ্রম নিয়োগ প্রক্রিয়া খোলার জন্য সংশ্লিষ্ট জার্মান মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করছি," তিনি আরও বলেন।
তবে দেশটিতে ক্রমবর্ধমান কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে এখন প্রক্রিয়াটি ধীরগতিতে এগোচ্ছে বলে জানান তিনি।
জার্মান ইকোনমিক ইনস্টিটিউটের ধারণা, চলতি বছরে তিন লাখেরও বেশি শ্রমশক্তির ঘাটতি দেখা দেবে জার্মানিতে। কারণ বর্তমানে শ্রমবাজারে তরুণদের প্রবেশের বিপরীতে অনেক বেশি বয়স্ক কর্মী অবসর নিচ্ছেন।
২০২৯ সালের মধ্যে এই ব্যবধানটি সাড়ে ৬ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মহামারির প্রভাব সত্ত্বেও গেল বছরে কর্মসংস্থানে জার্মানদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি।
কয়েক দশক ধরে নিম্ন জন্মহার এবং অসম অভিবাসন দেশটিতে শ্রম ঘাটতির অন্যতম কারণ। এর ফলে জার্মানির পাবলিক পেনশন ব্যবস্থায়ও পড়েছে বিপাকে। ক্রমবর্ধমান অবসরপ্রাপ্তদের পেনশনের অর্থায়নের দায়িত্ব নেওয়ার মত পর্যাপ্ত কর্মীরও অভাব দেখা দিয়েছে দেশটিতে। ফলে অল্প সংখ্যক কর্মীদের ওপর কাজের চাপ পড়ছে বেশি।
ব্যবসায়িক ম্যাগাজিন ওয়ারশ্যাফটসওয়াশ-কে ফ্রি ডেমোক্র্যাটস (এফডিপি)-এর সংসদীয় নেতা ক্রিশ্চিয়ান ড্যুয়ার বলেন, "দক্ষ শ্রম ঘাটতি এখন এতটাই গুরুতর হয়ে উঠেছে যে, এটি আমাদের অর্থনীতিতে নাটকীয়ভাবে ধীরগতি এনে দিয়েছে।"
"আমরা কেবল একটি আধুনিক অভিবাসন নীতির মাধ্যমেই জনবল সংকটের এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি। আমাদের যত দ্রুত সম্ভব বিদেশ থেকে ৪ লাখ দক্ষ কর্মী নিয়ে আসতে হবে", তিনি আরও বলেন।
দেশটির বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের স্যোশাল ডেমোক্র্যাটস, ড্যুয়ারের এফডিপি এবং পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টি জোট সরকার এক চুক্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের দেশগুলো থেকে দক্ষ কর্মী আনার জন্য পয়েন্ট সিস্টেম চালু করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। বিদেশি কর্মীদের আকৃষ্ট করতে জাতীয় ন্যূনতম মুজুরি ঘণ্টায় ১২ ইউরোতে (১৩.৬০ ডলার) উন্নীত করার বিষয়েও তারা একমত হয়েছেন।
প্রায় এক দশক ধরে জার্মানিতে বসবাস করছেন বাংলাদেশি গবেষক ড. মারুফ মল্লিক। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা বহু বছর ধরে আমাদের দূতাবাসগুলোর কাছে জার্মানিতে আনুষ্ঠানিক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি দ্রুত সম্পন্ন করার দাবি জানিয়ে আসছি। কারণ প্রতি বছর অনেক বাংলাদেশি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে ইউরোপে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা এখনও এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত উদ্যোগ দেখতে পাইনি।"
তিনি আরও বলেন, "অবৈধ পথে জার্মানিতে প্রবেশকারী বাংলাদেশির সংখ্যা প্রতি বছর ৫০০-এর বেশি নয়। জার্মানি এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোতে বেশিরভাগ বেমানান কাজগুলো (অড জব) করেন থাকেন এই অনিয়মিত অভিবাসী শ্রমিকরা। জার্মানিতে নিয়মিত কর্মীরা প্রতি ঘন্টায় মজুরি পান ৯.৬০ ইউরো; আর অনিয়মিতরা পান মাত্র ৬ থেকে ৭ ইউরো পান।"
একটি বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি জার্মানিতে বসবাস করছেন।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। এরমধ্যে ৮০ হাজারই অবস্থান করছেন অবৈধভাবে এবং প্রতি বছরই এই সংখ্যা বাড়েই চলেছে।
জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচ ভেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ইউরোপে আশ্রয় আবেদনকারী প্রায় সাড়ে ৭ লাখ লোকের মধ্যে ১৩ হাজার ১৯০ জনই আবেদন করেছেন বাংলাদেশ থেকে।
অনিয়মিত শ্রমিক ফেরত নিতে বাংলাদেশের ওপর চাপ দিচ্ছে ইইউ
২০১৭ সালে ইইউ ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস (এসওপি) নামের একটি চুক্তি। এর মাধ্যমে ইইউ সদস্য দেশগুলোতে অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
যদি এসওপি চুক্তির অধীনে সহযোগিতা পাওয়া না যায়, তাহলে বাংলাদেশ, ইরাক ও গাম্বিয়া থেকে আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে স্বল্পস্থায়ী ভিসা ওপর সাময়িক বিধিনিষেধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন।
বার্লিনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, "আমরা যদি এটি অনুসরণ না করি তাহলে আমাদের ভিসা নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে হতে পারে।"
তিনি বলেন, "এসওপি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত আমরা জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ৮১৬ জনের ভ্রমণ সংক্রান্ত কাগজপত্র জারি করার অনুরোধ পেয়েছি। তাদের অনেকেই ইতোমধ্যেই জার্মানি ছেড়েছেন।"
তিনি আরও উল্লেখ করেন, করোনভাইরাস মহামারির কারণে অনিয়মিত বাংলাদেশি অভিবাসীদের আসার প্রবণতা কিছুটা কমেছে এবং জার্মান কর্তৃপক্ষ গত বছরগুলোত অল্প সংখ্যক লোককে ফেরত পাঠিয়েছে।
এদিকে, ইইউভুক্ত অধিকাংশ দেশ অনিয়মিত শ্রমিকদের প্রবেশের অনুমতি দিলেও বৈধ উপায়ে আসা শ্রমিকদের কাজে নিয়োগ দিচ্ছে না। ইইউ'র এমন অবস্থানের সমালোচনা করেছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সি আর আবরার বলেন, "ইউরোপীয় দেশগুলোতে বিশেষ করে কৃষি ও সেবা খাতে অভিবাসী শ্রমিকদের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু তারা বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে কর্মী নিয়োগ করছে না।"
"অন্যদিকে, প্রতি বছর হাজার হাজার বাংলাদেশি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করছে এবং ইউরোপ এই অনিয়মিত অভিবাসীদের দেশে প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে। প্রায়ই তারা এই শ্রমিকদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বৈধতা দেয়, কারণ তারা তুলনামূলক কম বেতনে এই শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে", তিনি আরও বলেন।
জার্মানিতে আশ্রয় চাওয়ার আবেদন কমেছে
জার্মান ফেডারেল অফিস ফর মাইগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজিস (বিএএমএফ) কর্তৃক প্রকাশিত আশ্রয় আবেদনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ও ইইউ'র মধ্যে এসওপি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের আশ্রয় আবেদনের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
২০১৭ সালে ৫৭১ জন বাংলাদেশি নাগরিক জার্মানিতে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করলেও, ২০২০ সালে এই আবেদনের সংখ্যা নেমে আসে মাত্র ১৮৯টিতে।
গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে মাত্র ৮৮টি আশ্রয় আবেদন নিবন্ধিত হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই সময়ের মধ্যে সামগ্রিক সুরক্ষার হার ছিল ৬.১ শতাংশ।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের প্রথম ছয় মাসে ইউরোপে যাওয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে ভূমধ্যসাগর ও স্থলপথ পাড়ি দেওয়া যাত্রীদের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি।
হিসাব অনুযায়ী, গেল বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত অবৈধ পথে ইউরোপে পৌঁছানো বাংলাদেশি নাগরিকের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৩৩২ জন, যা ইউরোপে অভিবাসন প্রত্যাশীদের মোট সাড়ে ১৪ শতাংশ।