কেমন হওয়া উচিত আরও বাসযোগ্য ঢাকার পরিকল্পনা
বিশ্বের অন্যতম জনবহুল মেগাসিটি ঢাকা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরে এই শহরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু অন্যান্য বড় শহরের মতো ঢাকাও ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বাসযোগ্য পরিবেশের সামগ্রিক চিত্র এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির মতো বিষয়গুলো নিয়ে বাড়ছে চ্যালেঞ্জ। শহরের বিভিন্ন পরিষেবা ও জীবনযাপনের মান নির্ধারক সূচক অনুযায়ী ঢাকাকে আরও বাসযোগ্য করে তুলতে এখনও অনেক কিছু করা বাকি।
ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তোলার লক্ষ্য অর্জনে রয়েছে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা। উদাহরণস্বরূপ:
• কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির কারণে ড্রেন এবং নর্দমা আটকে শহরজুড়ে জলাবদ্ধতার ঝুঁকি
• কম খরচে বাসা পাওয়া যায় এমন এলাকাগুলো অফিসপাড়া থেকে দূরে হওয়া
• গণপরিবহনের স্বল্পতা এবং বিকল্প ও পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকা
• উন্নয়ন নীতিমালায় শিথিলতার অভাবে কর্মস্থলের কাছাকাছি কম খরচে আবাসন প্রকল্প নির্মিত না হওয়া
শুধু এগুলোই নয়, নগরজুড়েই রয়েছে নানা অব্যবস্থাপনা। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে নতুনভাবে বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা করা জরুরি। ঢাকায় ৫০টিরও বেশি উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা রয়েছে। শহরের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রতিটি সংস্থার রয়েছে নিজস্ব ভাবনা।
কোন বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন, অর্থসংস্থান এবং বাস্তবায়ন পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কার হবে- এসব নিয়ে প্রায়ই প্রকল্পগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। আর তাই প্রয়োজন সমন্বিত নগর পরিকল্পনার। সময় এসেছে ঢাকার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে বিভিন্ন খাত নিয়ে সম্মিলিতভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা করার।
ঢাকার নগর উন্নয়নের তিন পদ্ধতি:
নগর উন্নয়নের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- কীভাবে তা করা হবে? বিভিন্ন অবকাঠামোগত বিনিয়োগ এবং নীতিমালার সমন্বয়ে বিশ্বের বড় শহরগুলো সম্মিলিত উন্নয়নের জন্য কাজ করেছে। এখানে তিনটি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হলো যা ঢাকার ক্ষেত্রেও কাজে লাগতে পারে।
১. ট্রানজিট-নির্ভর উন্নয়ন
পরিবহন রুট এবং ভূমি ব্যবহার নীতির সমন্বয়ে ট্রানজিট-নির্ভর উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হয়। নির্দিষ্ট জোনভিত্তিক এরিয়ায় জনসংখ্যা ও অবকাঠামোর ঘনত্ব ও ব্যবহার নির্ধারণ করা থাকে। এর উদ্দেশ্য হলো- আবাসন ব্যবস্থা উন্নতকরণের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক ঘনত্ব নির্ধারণ এবং চলাচল সহজ করে তোলা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির আর্লিংটন কাউন্টিতে বিভিন্ন সাবওয়ে স্টেশনের আশেপাশের অঞ্চল নিয়ে ভূমি উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো করা হয়। এর ফলে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও পরিবহন ব্যবস্থা একে-অপরের পরিপূরক হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
ঢাকার বর্তমান ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) ও বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। আর তাই ঢাকায় ট্রানজিট নির্ভর সমন্বিত উন্নয়নের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।
২. পরিবেশ ব্যবস্থাপনা নির্ভর সমাধান
ঢাকার জল-নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পরিবেশনির্ভর সমাধান সাশ্রয়ীভাবে জলাবদ্ধতার ঝুঁকি কমাতে পারে। সমতল ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, নদীর দূরত্ব এবং অসংখ্য হ্রদ ও খাল থাকায় ঢাকায় বন্যা এবং বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির ঝুঁকি আছে। জলনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার উন্নতি এবং জলবায়ু অভিযোজনে বিনিয়োগ ভবিষ্যতের বন্যা ক্ষয়ক্ষতি রোধ করে কোটি কোটি টাকা বাঁচাতে পারে।
শহুরে জলাভূমি চিহ্নিত ও রক্ষার পাশাপাশি জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করতে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে বিশ্বব্যাংক একটি সফল প্রকল্প পরিচালনায় সহায়তা করে। শহরটিতে জলাভূমি সংরক্ষণের ফলে বন্যার ঝুঁকি হ্রাস পেয়েছে। একইসঙ্গে কলম্বোর বাসিন্দাদের বিনোদনের জন্য শহরে সবুজ পার্কের আয়তনও বেড়েছে।
ঢাকায় পানি ব্যবস্থাপনা এবং বন্যার ঝুঁকি হ্রাসের পদ্ধতিগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শহরের পূর্বদিকে বালু নদীর তীরে রয়েছে বন্যাপ্রবণ এলাকা। সেখানে প্রায় ৬০ শতাংশ জমি বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। অথচ নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনায় বর্তমান নিষ্কাশন খাল এবং হ্রদগুলো এখন ভরাট হওয়ার উপক্রম।
৩. ভূমি একত্রীকরণ
ভুটানের থিম্পুসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে নগর ঢেলে সাজানোর ক্ষেত্রে ভূমি একত্রীকরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ঢাকার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে শিল্প ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনার সঙ্গে নগর প্রসারণের ক্ষেত্রেও জরুরিভাবে ভূমি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রয়োজন।
ভূমি একত্রীকরণ পরিকল্পনায় বিনিয়োগ অগ্রাধিকার অনুসারে স্যানিটেশন, পরিবহন, আবাসন, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার মতো খাতগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন, স্টেশন, সবুজ পার্ক এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনার জন্য জমি আলাদাভাবে নির্ধারণ যেতে পারে।
#ডেল্টা প্ল্যান হতে পারে একটি মডেল:
ঢাকায় নগরায়নের চ্যালেঞ্জ, শাসন ব্যবস্থা এবং অর্থায়নের বিকল্পগুলোর একটি ডায়াগনস্টিক মূল্যায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক; যা সরকারকে ঢাকার জন্য একটি কৌশল তৈরি করতে সহায়তা করবে। মূল্যায়ন অনুযায়ী, শহরের বিনিয়োগগুলো হতে হবে পরিকল্পিত। সেগুলো যেন অন্য কোনো প্রকল্পের সঙ্গে সংঘর্ষপূর্ণ বা অন্য কোনো প্রকল্পের পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্য পূর্বকল্পিত এবং পরিপূরক প্রকল্প দাঁড় করাতে হবে। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি ও কাঠামো প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ একটি সম্ভাবনাপূর্ণ পরিকল্পনার উদাহরণ। এই পরিকল্পনার লক্ষ্যে রয়েছে- বন্যা সুরক্ষা এবং জল নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার উন্নতি। কিন্তু লক্ষ্যপূরণে নগর উন্নয়ন, জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা, পানি সরবরাহ, শাসন ব্যবস্থা, জ্বালানি ও বেসরকারির খাতেও সহায়ক বিনিয়োগ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রয়োজন।
- সূত্র: ওয়ার্ল্ডব্যাংক ব্লুগ
- ভাষান্তর: তামারা ইয়াসমীন তমা