শহীদ সাবের: এক অসমাপ্ত কবিতার নাম
"আপনাকে লিখেছি অনেকদিন হলো। ...পরীক্ষার পর থেকে আমার হাতে এখন কোন কাজ নেই। আর নিজেকে ব্যস্ত করে রাখার মতো কিছু যখন থাকে না তখন বন্দী জীবন খুবই দুঃসহ হয়ে ওঠে। নির্বাচন এগিয়ে আসলেও কিছুদিনের মধ্যে আমার মুক্তিলাভের সম্ভাবনা নেই।"
১৯৫১ সালের ২০ নভেম্বর রাজশাহী সেন্ট্রাল জেল থেকে বাবার কাছে চিঠিতে কথাগুলো লিখেছিলেন ভাষা সৈনিক শহীদ সাবের। ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ততার কারণে ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত বিনা বিচারে কারাভোগ করেন এই আমরণ সংগ্রামী।
১৯৩০ সালের ১৮ ডিসেম্বর। বাবা সালামত উল্লাহ আর মা শফিকা খাতুনের কোলজুড়ে আসেন সাবের, যার পুরো নাম আবুল কালাম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাবের। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার কারণে তিনি 'শহীদ সাবের' হিসেবে পরিচিতি পান।
শহীদুল্লাহ সাবের তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলার কক্সবাজার মহকুমার ঈদগাঁও ইউনিয়নে সিকদারপাড়ায় নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
সাবেরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ঈদগাঁও প্রাথমিক স্কুলে। শৈশব থেকেই ছিলেন মেধাবী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সেই অগ্নিঝরা দিনে বেড়ে উঠেছিলেন সাবের।
পিতা সালামত উল্লাহ সাবেরকে নিজ কর্মস্থল কলকাতায় নিয়ে যান। ভর্তি করিয়ে দেন কলকাতা হেয়ার স্কুলে। সেখানেও মেধার স্বাক্ষর রাখেন। কলকাতায় অবস্থানকালেই দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় শহীদ সাবেরের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে চলে আসেন।
১৯৪৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। সেখানে তিনি যুক্ত হন "মুকুল ফৌজ" আন্দোলনের সাথে। লেখার দক্ষতা ও বক্তৃতার ক্ষমতা সচেতন, প্রগতিশীল রাজনৈতিক মহলে দ্রুতই জনপ্রিয় করে তোলে তাকে। কলেজে ছাত্রাবস্থায় সাবেরের সাথে পরিচয় ঘটে তৎকালীন তরুণ কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরীর। তারা হয়ে ওঠেন সার্বক্ষণিক সঙ্গী। চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে শহীদ সাবের মুসলিম লীগের লোকজনের আক্রমণের শিকার হন।
সেই ঘটনা স্মরণ করে ভাষা সৈনিক মাহবুবুল আলম চৌধুরী লিখেছেন, "১৯৪৮ সালে ১১ মার্চকে 'রাষ্ট্রভাষা দাবি দিবস' ঘোষণার পর এ উপলক্ষে চট্টগ্রামে জেমসেন হলে অনুষ্ঠিতব্য জনসভার প্রচারণা করি আমরা। আমি আর শহীদ সাবের মাইক নিয়ে প্রচারে নেমেছিলাম। লালদিঘিতে মুসলিম লীগের সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলা করে মাইক কেড়ে নিয়ে যায়। আমরা পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষা করি।"
স্বল্প সময়ে সাবের চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের একজন হয়ে উঠেন। তার বক্তৃতা, লেখনী ও সংগ্রামী ভূমিকা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের নজরে আসে। একপর্যায়ে ১৯৫০ সালে সাবের কারারুদ্ধ হন। ১৯৫০ সালের শেষের দিকে সাবেরকে চট্টগ্রাম জেল থেকে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। এই জেলেই ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল সাতজন রাজবন্দীকে হত্যা করে মুসলিম লীগ সরকার।
তখন জেলখানায় বসেই তিনি লিখেছিলেন সাড়া জাগানো রাজবন্দীর কাহিনী 'আরেক দুনিয়া থেকে'। যা কলকাতার 'নতুন সাহিত্য' পত্রিকায় প্রকাশ হয়।
সাবের কারাগারে থাকাকালেই ১৯৫১ সালে আই.এ পাশ করেন। জেল থেকে বন্ডে মুক্তির সুযোগ দেয় পাকিস্তানি জান্তা সরকার। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। চার বছর বিনাবিচারে কারাভোগের পর ১৯৫৪ সালে সাবের জেল থেকে মুক্তি পান।
১৯৫৫ সালে জগন্নাথ কলেজের নৈশ বিভাগ থেকে বিএ পাশ করার পর ঢাকার ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন সাবের। পরে দৈনিক সংবাদ-এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। দৈনিক সংবাদ-এ তিনি সম্পাদকীয় লিখতেন। তার লেখা সম্পাদকীয়তে ছিল অনন্য প্রতিভার ছাপ। যা সর্বমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো।
সাবের দৈনিক সংবাদ অফিসেই থাকতেন। ১৯৭১ এর ৩১ মার্চ তারিখে পাক হানাদারবাহিনী দৈনিক সংবাদ অফিসে আগুন দিলে, সে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান সাংবাদিক সাবের।
টিবিএস ও নগদের যৌথ উদ্যোগ