৫ বছরে ওয়াসার মুনাফা বেড়েছে ১১৯%, তারপরও পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের যুক্তি কতখানি
ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা) গত বছর প্রায় ৫০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে এ তথ্য জানা গেছে। তারপরও ওয়াসা চিফ গত ৯ ফেব্রুয়ারির এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আয়ব্যয়ের একটি অনুজ্বল হিসাব উপস্থাপন করেছেন।
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান সেদিন পানির মূল্য ২০ শতাংশ বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি দিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, "সরকারের কাছ থেকে ভিক্ষা ও ভর্তুকি নিয়ে কোনো সংস্থা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না।"
অথচ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ১৩ বছরে পানির দাম বেড়েছে ১৪ বার। আর গত পাঁচ বছরে রাজধানীতে পানির দাম বেড়েছে পাঁচবার।
এভাবে প্রতিবছর পানির মূল্য বৃদ্ধিকে অনৈতিক বলে উল্লেখ করেছেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতি গোলাম রহমান। দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের পেছনে তিনি ওয়াসার 'অতি-মুনাফা সন্ধানী মনোভাব এবং এর কর্মকর্তাদের উচ্চ বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ' অব্যাহত রাখার আগ্রহকে দায়ী করেছেন।
এদিকে ওয়াসা আইন অনুযায়ী, সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে প্রতিবছর পানির দাম ৫ শতাংশ হারে বাড়াতে পারে ওয়াসা।
গত বছরের ১ জুলাই পানির ৫ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি কার্যকর হয়। এতে আবাসিকে প্রতিইউনিট (১,০০০ লিটার) পানির মূল্য ১৫.১৮ টাকা আর বাণিজ্যিকে ৪২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি এ বছর ২০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে, যা আগামী ১ জুলাই থেকে গ্রাহকদের ওপর চার্জ করতে চায়।
নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, দাম বাড়ানো হলে আবাসিকে প্রতিইউনিটে পানির দাম বেড়ে দাঁড়াবে ১৮.২৫ টাকা ও বাণিজ্যিকে দাঁড়াবে ৫০.৪ টাকা।
তাকসিম এ খান বলেছেন, সরকার যদি প্রস্তাবিত ২০ শতাংশের চেয়েও বেশি বাড়তে চায়; সেক্ষেত্রে ওয়াসার কোনো আপত্তি নেই। "সরকারের উচ্চমহল থেকে পানির দামে ভর্তুকির পরিমাণ ধীরে ধীরে কমানোর নির্দেশনা রয়েছে। কারণ পানির উৎপাদন ব্যয় ও খুচরা বিক্রয়মূল্যের মধ্যে অনেক ব্যবধান।"
সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেন, প্রতিইউনিট পানি উৎপাদনে (উত্তোলন, পরিশোধন ইত্যাদি) ওয়াসার বর্তমান খরচ ২৫ টাকা, কিন্তু তারা ১৫ টাকায় বিক্রি করছেন। তার মানে, সরকারকে এখানে প্রতিইউনিটে ১০ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও ওয়াসার প্রস্তাবের সমালোচনা করে বলছেন, মহামারির কারণে মানুষের আর্থিক দুর্দশা এতে আরও বাড়বে। মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরোধিতায় মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) একটি আলোচনা সভা আয়োজন করবে ক্যাব।
পাঁচ বছরে ১১৯ শতাংশ লাভ:
গত পাঁচ বছর ধরেই মুনাফা করছে ওয়াসা। পানির মূল্যবৃদ্ধির সুবাদে সরবরাহক সংস্থাটির মুনাফা গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষিত আর্থিক হিসাব অনুযায়ী, বিগত পাঁচ বছরে ওয়াসার মোট আয় বেড়েছে ৫১ শতাংশ আর মুনাফা বেড়েছে ১১৯ শতাংশ। আর পানি সেবা থেকে আয় বেড়েছে প্রায় ৫৩ শতাংশ আর স্যুয়ারেজে ৪১ শতাংশ।
আর্থিক হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ওয়াসার মোট আয় ১ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। আর মুনাফা ৪৯.৬৫ কোটি টাকা।
এসময়ে পানি সরবরাহ থেকে প্রতিষ্ঠানটির আয় হয়েছে ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা আর স্যুয়ারেজ সেবা থেকে ৩৯১ কোটি টাকা। বাকি ১৬১ টাকা আয় হয়েছে বোতলজাত পানি বিক্রি, সংযোগ ফি, ব্যাংকে জমানো এফডিআর ও অন্যান্য উৎস থেকে।
পাঁচবছর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির মোট আয় ছিল ১ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা আর মুনাফা ছিল প্রায় ২২ কোটি টাকা।
যার মধ্যে পানি সরবরাহ থেকে ৭৮৬.৫০ কোটি টাকা আর স্যুয়ারেজ সেবা থেকে আয় ২৭৬.৭৯ কোটি টাকা।
ওয়াসার আয়ের ৭০ শতাংশ আসে- রাজধানীর আবাসিক ভবন ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পানি আর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার পরিষেবা দিয়ে।
'মানুষের উপর নিপীড়ন'
ওয়াসার পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের পর জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন,"চারদিকে দ্রব্যমূল্য যেভাবে বাড়ছে এবং তার ওপর বছর বছর পানির দাম বাড়ানো মানুষের উপর নিপীড়ন। এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।"
সরবরাহ করা পানির মানের বিষয়ে তিনি টিবিএসকে বলেন, "ওয়াসার নিজস্ব গবেষণার ফাইন্ডিংসে এসেছে, মানুষ সরাসরি পানি খায় না। বরং সিদ্ধ করে খেতে হয়। এতে প্রচুর গ্যাস খরচ হয়।"
এদিকে "ঘুরে দাঁড়াও, ঢাকা ওয়াসা" কর্মসূচির শুরুর পর থেকেই লাভ করছে ঢাকা ওয়াসা। বিষয়টি উল্লেখ করে ওয়াসার এমডি তাকসিম টিবিএসকে বলেন, "ওয়াসা আগে কখনো লাভজনক ছিল না এবং এখন আমরা এটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পেরেছি।"
ওয়সা লাভে থাকার পরও কেন পানির দাম বাড়ানো হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আগে বুঝতে হবে এটা কেমন প্রফিট। এটা কি একুরাল বেসিস না একচুয়াল বেসিস- সেটা আগে জানতে হবে। যেভাবে সাদামাটাভাবে লাভজনক বলছেন, সেটা নয়। অডিট রিপোর্ট নিয়ে আসেন- তখন আপনাকে বোঝাব।"