২১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫ হাসপাতালে হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সামনে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা বর্জ্য যথাযথভাবে শোধন ও নিষ্পত্তির জন্য বিভিন্ন রঙের কন্টেইনার রাখা হলেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও দক্ষ জনবলের অভাবে হাসপাতালটি সুষ্ঠুভাবে বর্জ ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না।
এমনকি, বর্জ্য সংরক্ষণের কনটেইনার ঢাকনা আটকে রাখার কথা থাকলেও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের অধিকাংশ কনটেইনারই খোলা থাকে। সংক্রামক বর্জ্যের খোলা কনটেইনারে সাধারণ বর্জ্য আবার সাধারণ বর্জ্যের কনটেইনারে মাস্ক, সিরিঞ্জ, ওষুধের বোতলসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যও ফেলা হয়।
সাধারণত হলুদ কনটেইনারে ক্ষতিকারক, লাল কনটেইনারে ধারালো, নীল কনটেইনারে তরল, সিলভার কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়, সবুজ কনটেইনারে পুনঃব্যবহারযোগ্য সাধারণ বর্জ্য এবং কালো কনটেইনারে সাধারণ বর্জ্য রাখার নির্দেশনা থাকলেও একটির বর্জ্য ফেলা হচ্ছে অন্যটিতে। মানা হচ্ছে না কনটেইনারে বর্জ্যের নাম ও সাংকেতিক চিহ্ন রাখার নির্দেশনাও।
শুধু শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নয়, ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা ছাড়াই চলছে দেশের প্রায় সব হাসপাতাল। মেডিকেল বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ছে। এ সমস্যা সমাধানে ২১৪ কোটি ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ব্যয়ে দেশের ১৫টি সরকারি হাসপাতালে হাসপাতাল ভিত্তিক চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে সরকার।
মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সাপ্তাহিক বৈঠকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদনের সময় প্রধানমন্ত্রী যন্ত্রপাতি ক্রয়ের পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য জনবল প্রস্তুত করতে বলেন।
তিনি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে চিকিৎসা বর্জ্য যথাযথভাবে নিষ্কাশনে বাধ্য করতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
১৫ সরকারি হাসপাতালে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেম প্রতিষ্ঠা শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকার শেরেবাংলা নগর এলাকার সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ এবং মুন্সীগঞ্জ, বান্দরবান, লক্ষ্মীপুর, ঝিনাইদহ, বাগেরহাট, লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, পঞ্চগড়, পিরোজপুর ও শেরপুরের ১০টি সরকারি হাসপাতাল থেকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো তৈরি করা হবে।
প্রকল্প শেষে স্থাপিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রে আধুনিক চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করা হবে।
পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে প্রকল্প হোতে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হচ্ছে, ৪৫টি চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ক্রয়, ১৫টি ক্যাটাগরি এ, বি, ও সি'ভুক্ত অনাবাসিক ভবন, সরবরাহ সেবা, ২টি যানবাহন ভাড়া, ৫টি আউটসোর্সিং সেবা, ৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন ভাতা, ৪৭টি আসবাবপত্র ক্রয়, ১২টি কম্পিউটার এবং আনুষঙ্গিক ক্রয়, মেরামত, সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন করা।
এ প্রকল্পের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম বলেন, "প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর কোনো বিরূপ প্রভাব ছাড়াই বিভিন্ন চিকিৎসা বর্জ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও অপসারণের সক্ষমতা তৈরি হবে এবং সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন ও সংক্রমণমুক্ত পরিবেশে চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।"
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডাঃ ফরিদ হোসেন মিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে এখন যে সংকট আছে তা কাটবে। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি কমবে।"
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, দেশের অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে হাসপাতাল বর্জ্য পরিশোধনের সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, এমনকি এইডসের মতো মরণব্যাধির ঝুঁকি বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাঠামো না থাকায় বেসরকারি সংস্থা প্রিজম বাংলাদেশ সংক্রামক বর্জ্য সংগ্রহ করে বিনষ্ট করে। আর অসংক্রামক বর্জ্য অপসারণ করে দুই সিটি করপোরেশন।
গত বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত ব্র্যাকের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, সারা দেশের হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন মোট ২৪৮ টন চিকিৎসা বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩৫ টন (১৪.১ শতাংশ) বর্জ্য যথাযথ ব্যবস্থাপনার অধীনে রয়েছে এবং এই ব্যবস্থাপনা রাজধানী ঢাকার মধ্যেই সীমিত।
"এই বর্জ্যের শোধন একটি একক বেসরকারি সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়। যদিও দেশের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং হাসপাতালে বর্জ্য পৃথকীকরণের সুবিধা পাওয়া যায়, তবে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো চিকিৎসা বর্জ্য নিষ্কাশন বা চিকিৎসার সুবিধা নেই," বলা হয়েছে ব্র্যাক গবেষণায়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেলিন চৌধুরী বলেন, "বাংলাদেশে সঠিক উপায়ে বর্জ্য পরিচালনা না করায় তা একটি বড় পরিবেশগত হুমকি তৈরি করে। এছাড়া, এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এবং পুনরায় উদ্ভূত সংক্রমণের একটি সম্ভাব্য উৎস হতে পারে।"