বিডিআর বিদ্রোহ: ১৩ বছরেও হত্যা ও বিস্ফোরক মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি
১৩ বছর আগে পিলখানায় তৎকালীন বর্ডার গার্ড (বিডিআর) বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহতের ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলাটির আপিল এখনো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
একই ঘটনায় দায়ের হওয়া বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়নি বিচারিক আদালতে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কোভিডের প্রভাবে আদালতের কার্যক্রম অনিয়মিত হওয়ায় হত্যা মামলার আপিল ও বিষ্ফোরক মামলার বিচার নিষ্পত্তি সম্ভব হয়নি। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আপিল বিভাগে বিশেষ বেঞ্চ গঠন ও বিচারিক আদালতে একটি নির্দিষ্ট সময় বেধে দিয়ে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুইটি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ থাকলেও কোভিডের কারণে সেটি হয়ে উঠেনি। এখন কোভিডের প্রভাব বেশ কমে এসেছে। যত দ্রুত সম্ভব আপিল বিভাগের আপিল নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে। আর বিচারিক আদালতের মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, হাইকোর্টের রায়টি অনেক বড়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল অনেক ব্যয়বহুল। গত বছরের জানুয়ারি মাসে ৯ জনের পক্ষে একটি আপিল দায়ের করতে প্রায় ১৯ লাখ টাকা খরচে হয়েছে।
তিনি বলেন, বাকি আসামিদের আপিল বিনা খরচে দায়েরের জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করা হলে সেটি মঞ্জুর হয়েছে গত বছরেই। এ বছর আপিল শুনানি শুরু হতে পারে। আশা করি, সর্বোচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার পাব।
হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রাজধানীর পুরান ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদরাসা সংলগ্ন মাঠে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত ১৫২ জন বিডিআর সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও ২৭৮ জনকে খালাস দিয়ে রায় দেন।
ওই রায়ের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন।
২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার হাইকোর্টের রায় প্রকাশ করা হয়।
হাইকোর্ট রায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৩৯ জনের দণ্ড হাইকোর্টে বহাল রাখেন।
বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আটজনের সর্বোচ্চ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চারজনকে বেকসুর খালাস দেন হাইকোর্ট।
যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে ১৮৫ জনকে। ১৩ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে দুজনের। ১৫৭ জনকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন উচ্চ আদালত। ১৩ জনকে ৭ বছর করে, ১৪ জনকে ৩ বছর করে ও ১ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে দুজনকে।
মোট ৫৫২ জনকে সাজা এবং ২৮৩ জনকে খালাস দেন হাইকোর্ট।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা যায়, আসামিদের মধ্যে ২০৩ জনের পক্ষে এখন পর্যন্ত ৪৭টি আপিল ও লিভ টু আপিল করা হয়েছে আপিল বিভাগে। আর হাইকোর্টের রায়ে যারা খালাস পেয়েছে ও মৃত্যুদণ্ডাদেশের পরিবর্তে যাদের যাবজ্জীবন হয়েছে, সে রকম ৮৩ আসামির মৃত্যুদণ্ড চেয়ে ২০টি লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। সব মিলিয়ে হাইকোর্টের রায় চ্যালেঞ্জ করে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের ৬৭টি আপিল ও লিভ টু আপিল করা হয়েছে।
সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে বিস্ফোরক মামলা
বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ১ হাজার ৩৪৪ জন সাক্ষীর মধ্যে প্রায় ২০০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। এ মামলায় আসামি ৮৩৪ জন। তাদের মধ্যে ৩৩ আসামি ইতোমধ্যে মারা গেছেন এবং ২০ আসামি পলাতক। ৭৮১ আসামি কারাগারে আছেন। হত্যা মামলার আসামিরাই এই মামলায় আসামি।
বিস্ফোরক মামলাটি নিম্ন আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব শেষ হয়ে রায় প্রদানে আরও কয়েক বছর লেগে যেতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। বিচারকাজ চলছে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদরাসা সংলগ্ন মাঠে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে।
কবে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না টিবিএসকে বলেন, এই মামলা দুইটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা।
আপিল নিষ্পত্তির জন্য আপিল বিভাগের বিশেষ বেঞ্চ গঠন করা যেতে পারে। প্রধান বিচারপতি এই উদ্যোগ নিতে পারেন। এছাড়া কতোদিনে এই আপিল নিষ্পতি হবে সেটি বলা মুশকিল।
আর বিচারিক আদালতে বিস্ফোরক মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেধে দিতে পারে আইন মন্ত্রণালয়।
কারণ আপিল নিষ্পত্তির পর এই মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করতে রিভিউ আবেদনের আরেকটি ধাপ বাকি থাকবে।
আর বিচারিক আদালতে বিষ্ফোরক মামলার রায়ের পর সেটি হাইকোর্টে আসবে। সেখানে নিষ্পত্তির পর আপিল হবে, আপিল নিষ্পত্তির পর রিভিউ আবেদন হবে। অর্থাৎ মামলা দুটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা সময়সাপেক্ষ বিষয়।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। সেদিন ঢাকার পিলখানায় (বিজিবি সদর দপ্তর) নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। নিষ্ঠুর আচরণ ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন তৎকালীন বিডিআরে কর্মরত সামরিক কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরাও। দুই দিনব্যাপী ওই বিদ্রোহের সময় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়, যা পরে নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়।