মুখ থুবড়ে পড়েছে ‘ডিজিটাল সিলেট সিটি’ প্রকল্প
ব্যাপক হাকডাক করে সিলেট নগরকে ডিজিটালাইজ করার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিলো 'ডিজিটাল সিলেট সিটি প্রকল্প'। তবে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছে এই উদ্যোগ।
এই প্রকল্পের আওতায় নগরের ১২৬ পয়েন্টে চালু করা ফ্রি ওয়াইফাই সেবা বন্ধ হয়ে পড়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে সড়কে লাগানো চেহারা চিহ্নিতকরণ ও যানবাহানের নম্বরপ্লেট চিহ্নিতকরণ আইপি ক্যামেরার বেশিরভাগ।
জানা যায়, দেশের প্রথম নগর হিসেবে সিলেটকে ডিজিটালাইজড করার লক্ষ্যে ২০১৮ সালে শুরু হয় 'ডিজিটাল সিলেট সিটি' প্রকল্পের কাজ।
সিলেটের ওসমানী হাসপাতাল, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সেবা ডিজিটালাইজেশন করা, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সড়কে চেহারা ও নম্বরপ্লেট চিহ্নিতকরণ ক্যামেরা স্থাপন এবং নগরজুড়ে ফ্রি ওয়াইফাই জোন স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় এ প্রকল্পের মাধ্যমে।
২০১৯ সালের জুনের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। তবে মেয়াদ বাড়িয়েও শেষ হয়নি কাজ। গত বছর প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
প্রায় ৩০ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে আইসিটি বিভাগের তত্ত্বাবধানে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)।
প্রকল্পের আওতায় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার কথা ছিলো। এজন্য 'হেলথ ম্যানেজমেন্ট অটোমেশন সিস্টেম' চালুর করার কথা জানিয়েছিলেন সংশ্লিস্টরা। তবে এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের কাজই শুরু হয়নি।
অকার্যকর ওয়াইফাই পরিষেবা
প্রকল্পের আওতায় ২০২০ সালে নগরের ৬২টি এলাকার ১২৬টি পয়েন্ট ফ্রি ওয়াইফাই সেবা চালু করা হয়। প্রকল্পে কাজ শেষে ফ্রি ওয়াইফাইসেবা ব্যবস্থাপনার জন্য গত বছরের ২১ মার্চ সিলেট সিটি করপোরেশনের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়।
তবে চলতি বছর থেকে বন্ধ হয়ে পড়েছে এই সেবা। বর্তমানে নগরের কোনো জায়গা থেকে বিনামূল্যে ওয়াইফাই সেবা মিলছে না।
ফ্রি ওইফাই সেবা বন্ধের কারণ হিসেবে সিলেট সিটি করপোরেশন বলছে, আর্থিক সমস্যার কারণে তারা বিনামূল্যে ওয়াইফাই সেবা দিতে পারছে না।
ফ্রি ওয়াইফাই সেবা চালুর পর ওই প্রকল্পের সহকারী পরিচালক মধুসূদন চন্দ বলেন, "প্রতিটি এক্সেস পয়েন্টের একসঙ্গে অন্তত ৫শ জন বিনামূল্যে ওয়াইফাই ব্যবহার করতে পারবেন। এর মধ্যে ১০০ জন উচ্চগতির ইন্টারনেট পাবেন। প্রতিটি এক্সেস পয়েন্টের চারদিকে ১০০ মিটার এলাকায় ব্যান্ডউইথ থাকবে প্রতি সেকেন্ড ১০ মেগাবাইট।"
তবে শুরু থেকেই ইন্টারনেটের মন্থর গতি নিয়ে অভিযোগ ছিল ব্যবহারকারীদের। গতি ধীর হলেও প্রায় সব এলাকা থেকে বিনামূল্যে ওয়াইফাই সুবিধা পাওয়া যেত। তবে এখন এই সেবা মিলছেই না।
গত রোববার (২০ জানুয়ারি) নগরেরর আম্বরখানা, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার এলাকায় ওয়াইফাই জোনে গিয়ে একাধিবার ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহারের চেষ্টা করেও তা ব্যবহার করা যায়নি। নির্ধারিত ইউজার নেম 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' ও পাসওয়ার্ড 'জয় বাংলা' দেওয়ার পর শুধু ওয়াইফাই কানেক্ট হয়। তবে ইন্টারনেন্ট ব্যবহার করা যায় না।
নগরের জিন্দাবাজার এলাকার ব্যবসায়ী খাদেমুল ইসলাম বলেন, "চালু হওয়ার পর কিছুদিন আমরা ফ্রি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পেরেছিলাম। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে এটি আর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কেন ব্যবহার করা যাচ্ছে না তাও জানি না।"
আলাদা অর্থ বরাদ্ধ না থাকায় ফ্রি ওয়াইফাই সেবা বন্ধ রয়েছে জানিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রুহুল আলম বলেন, "বিনামূল্যে ওয়াইফাই সেবার দায়িত্ব আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু এটা চালাতে যে অর্থের দরকার তা আমরা পাইনি। ফলে আমরা ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিতে পারছি না।"
তিনি আরও বলেন, "বিনামূল্যে ওয়াইফাই সেবা চালু করতে প্রতিমাসে ৭ লাখ টাকা দরকার। এই অর্থের জন্য বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা।"
চলছে না বেশিরভাগ আইপি ক্যামেরা
'ডিজিটাল সিলেট সিটি' প্রকল্পের আওতায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নগরের বিভিন্ন সড়কে বসানো হয়েছিল ১১০টি চেহারা ও গাড়ির নম্বরপ্লেট চিহ্নিতকরণ ক্যামেরা। তবে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব ক্যামেরার বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে অপরাধী শনাক্তে বেগ পেতে হচ্ছে পুলিশকে।
সিলেট মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, ১১০টি ক্যামেরার মধ্যে ৬৮টি নষ্ট হয়ে গেছে। সচল আছে ৪২টি। বেশিরভাগ আইপি ক্যামেরা নষ্ট হয়ে যাওয়াতে অপরাধী শনাক্তে বেগ পেতে হচ্ছে।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের কনসালটেন্ট মনিরুজ্জামান তনু বলেন, "শুরু করার পর থেকে প্রায় এক বছর আইসিটি মন্ত্রণালয়ের তত্বাবধানে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল বিনামূল্যে ওয়াইফাই সেবা পরিচালনা করেছিল। চেহারা চিহ্নিতকরণ ক্যামেরাও আমরা দেখভাল করেছি। পরীক্ষামূলক এক বছর চালুর পর ওয়াইফাইয়ের দায়িত্ব সিলেট সিটি করপোরেশনকে ও ক্যামেরায় দায়িত্ব সিলেট মহানগর পুলিশকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন এগুলো দেখভালের দায়িত্ব তাদের।"
চীনের হুয়াওয়ে কোম্পানির সহায়তায় প্রায় ৪ কোটি টাকা খরচে দেশে প্রথমবারের মতো ফেস রিকগনিশন ও যানবাহনের নম্বর প্লেট চিহ্নিতকরণ আইপি ক্যামেরা বসানো হয়েছিলো সিলেটে।
নগরীর জিন্দাবাজার, সুরমা মার্কেট, লামাবাজার, আম্বরখানা, শাহজালাল মাজারগেট, জেলগেট, সুবিদ বাজার, শাহি ঈদগাহ এলাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মোড়ে এসব আইপি ক্যামেরা বসানো হয়। এসব আইপি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয় মহানগর পুলিশের হাতে। এজন্য সিলেট কোতয়ালী মডেল থানায় মনিটরিং কক্ষ স্থাপন করা হয়। তবে এসব ক্যামেরার বেশিরভাগই এখন বিকল হয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ বলেন, "নগরীতে আইপি ক্যামেরা স্থাপনের পর অপরাধী শনাক্তে বেশ সুবিধা হয়েছিলো।"
এর মধ্যে কিছু ক্যামেরা ৩৬০ ডিগ্রি জুমিং সুবিধা রয়েছে। এসব ক্যামেরা ব্যবহার করে কয়েকটি ঘটনার রহস্য উদঘাটনেও সক্ষম হয় পুলিশ। কিন্তু এখন বেশিরভাগ ক্যামেরা নষ্ট হওয়াতে অপরাধী শনাক্ত কঠিন হয়েছে।
তিনি বলেন, "এগুলো সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কাদের তা আমি ঠিক জানি না।"