অবশেষে নিজের বাড়ি: দিনাজপুরের মানবপল্লী যেভাবে বদলে দিয়েছে ট্রান্সজেন্ডারদের জীবন
বয়স মাত্র ১০ বছর, পড়াশোনা করতেন ৫ম শ্রেণীতে- ঠিক তখনই বাড়ি ছাড়েন রজনী। এখন তার বয়স ২৬। মাঝখানে প্রায় ১২-১৩ বছর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন তিনি। যার প্রধান কারণ ছিল সামাজিকতা। কিন্তু এখন আর সেই সমস্যা নেই, সমাজের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। মাঝেমধ্যেই রজনীর মা যশোদা চলে আসেন সন্তানের বাড়িতে। থেকে যান দু'য়েক সপ্তাহ।
শুক্রবার বিকেলে দিনাজপুর শহরের পাশেই বাঙ্গিবেচা ঘাট এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য নির্মিত মানবপল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির বারান্দায় রজনী তার মায়ের পাশে বসে গল্প করছেন।
রজনী দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার শ্রীকান্ত ও যশোদার সন্তান। ছোটতে খুব বেশি সমস্যা ছিল না, কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথেই নানা শারীরিক-মানসিক পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করে। ফলে এলাকার লোকজন তাকে নিয়ে নানান কথা বলতে শুরু করে তার মধ্যে। বাবা-মা একটা সময় তাকে কবিরাজ ও স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। স্কুলের সহপাঠীরাও রজনীকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে নি। ফলে পঞ্চম শ্রেণীতে থাকাকালীনই বাড়ি ছাড়েন রজনী। দিনাজপুর শহরের গুঞ্জাবাড়ীতে 'তারই মতো' কয়েকজনের সাথে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে শুরু করেন। পরে দিনাজপুর শহরে ২০১২ সালের দিকে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর জন্য যে আবাসন তৈরী করা হয় সেখানে অন্যদের মতো তিনিও থাকার জায়গা পেয়ে যান। তখন থেকে এই আবাসনেই বসবাস করছেন তিনি।
রজনীর বাড়ির ঠিক পশ্চিম দিকেই থাকেন মেনেকা আহমেদ বাপ্পী। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বাড়ি গোছানোর কাজে ব্যস্ত তিনি। বাপ্পীর ভাই বাদশা এসেছেন তার বাড়িতে খোঁজ-খবর নিতে। শুধু যে ভাই এসেছেন তাই নয়, বাপ্পী নিজেও মাঝেমধ্যেই চলে যান বাড়িতে। তার বাড়ি দিনাজপুর জেলা শহরের সর্দারপাড়া এলাকায়। বাবা মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বাবুল।
রজনীর মতো বাপ্পীর এলাকাতেও ছিল তাকে নিয়ে নানা গুঞ্জন। তিনবার তার চুল কেটে দেওয়া হয়েছিল। এক সময় সমাজ ও পরিবারের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে চলে যান বাড়ি ছেড়ে। পেট চালাতে শুরু করেন ভিক্ষাবৃত্তি, ট্রেন-বাসে হাত পাতা।
রজনী কিংবা বাপ্পীর মত মানুষদের যারা বাঁকা চোখে দেখতো, তারাই এখন তাদেরকে ভালোবাসেন।
একটা সময় ছিল যখন ট্রান্সজেন্ডারদেরকে সবাই ভয় পেত, ঘৃণার চোখে দেখতো। বাবার বাড়িঘর থাকলেও দুরদুর করে তাড়িয়ে দেয়া হতো। সামাজিকতা, পারিবারিক ঐতিহ্য, অন্য ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বাবা-মাও তাদেরকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলতেন। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন চোখে পড়ার মত।
সমাজ তাদের মেনে নিতে শুরু করেছে। নিজের বাড়িতে গেলেও লোকজন আর তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেনা। পরিবারের সদস্যদের সাথে মিশতে নেই বাধা। তারা যেমন বাসায় যেতে পারেন, তেমনিভাবে বাবা-মা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনরাও আসেন মানবপল্লীতে তাদের বাড়ি।
এই যে অবস্থার পরিবর্তন, তা সম্ভব হয়েছে মানবপল্লীর জন্য, তাও মাত্র ১০ বছরে। মানবপল্লী নামের এই আবাসনটির মূল উদ্যোক্তা ছিলেন জাতীয় সংসদের হুইপ ও স্থানীয় সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিম, এমপি। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য আবাসন পল্লী বানিয়ে সোশাল ইনোভেটর ক্যাটাগরিতে ওয়ার্ল্ড লিডারশিপ ফেডারেশনের পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
শুধু আবাসন তৈরীই নয়, ৮০ জন ট্রান্সজেন্ডারকে সেখানে পুনর্বাসিত করে দেওয়া হয়েছে হস্তশিল্প, গবাদিপশু পালন, মৎস্য পালন, পার্লার, ড্রাইভিং, টেইলারিংসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ।
এরই মধ্যে চাকরি দেওয়াসহ তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে আর্থিক সহায়তাও করেছেন তিনি। এখানে তাদেরকে সহযোগিতা করতে টিআর, জিআর চালও বরাদ্দ দেয়া হয়।
তবে জীবনমানের উন্নয়নের চেয়েও বেশি পরিবর্তন হয়েছে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির, যেটি সত্যিই দরকার ছিল। একটা সময় ট্রান্সজেন্ডারদেরকে মানুষ অন্য চোখে দেখতো, নানান কথা বলতো, হাসাহাসি করতো। তারাই আজ এই জনগোষ্ঠীর মানুষদের সম্মানের চোখে দেখে, যার অন্যতম প্রমাণ ওয়ার্ল্ড লিডারশিপ পুরস্কার।
ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর জন্য প্রায় ৮ একর জায়গার উপর নির্মিত এই মানবপল্লী প্রকল্পের কাজ হয় ২০১১-২০১২ সালে। ২০১২ সালের ১৭ আগস্ট থেকে এখানে ট্রান্সজেন্ডাররা বসবাস শুরু করেন। এই মানবপল্লীতে রয়েছে ২৫টি ব্যারাক। প্রতি ব্যারাকে রয়েছে ৫টি করে ঘর ও বারান্দা। একেকটি ঘরে বসবাস করতে পারবেন দুইজন করে। প্রতিটি ব্যারাকের জন্য দুইটি করে টয়লেট ও একটি করে টিউবওয়েল করে দেওয়া হয়েছে।
কথা হয় এখানকার বাসিন্দা মেনেকা আহমেদ বাপ্পীর সাথে। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, "তখনও শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝিনা। এরইমধ্যে এলাকার লোকজন নানান কথা বলেন। আমার 'মেয়েলি' স্বভাব, কথার পরিবর্তন সবকিছু মিলে আমাকে নিয়ে পরিবার একটু সমস্যার মধ্যেই পড়ে যায়। পরপর ৩ বার চুল কেটে দেয়া হয়। ফলে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হই। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। মাঝেমধ্যেই বাসায় যাই। এখন আর কেউ তেমন কিছু বলে না। আমাদেরকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। আমি পার্লারের কাজ শিখেছি। হুইপ ইকবালুর রহিম আমাকে একটা দোকান দেখতে বলেছেন, যেখানে আমি পার্লার দিতে পারবো। তিনি সাধ্যমত সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন।"
"হুইপ ইকবালুর রহিম ভাই আমাদের বিভিন্ন আবদার পূরণ করেন। ঈদের সময় বাজার-সদাই ও গরু ক্রয় করে দেন। আমাদের মত মানুষকে পাশে বসিয়ে কথা বলেন। বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যান। মূলত তার এই আচরণের কারণেই আমরা সমাজে এখন সম্মান পাই।"
বাপ্পীর ভাই বাদশা বলেন, "আমি মির্জাপুর এলাকায় পেইন্টিংয়ের কাজ করি। মাঝেমধ্যেই এখানে আসি বাপ্পীর খোঁজখবর নিতে। আমাদের রক্তের সম্পর্ক, কে কী বললো তাতে কিছু যায় আসে না। তবে আগের চেয়ে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর সেভাবে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। বাপ্পীকে নিয়ে কেউ কিছু বলে না, তার প্রধান কারণ সরকার তাদের পক্ষে কাজ করছেন। তাদের পক্ষে কথা বলছেন।"
রজনী বলেন, "আগে তো অনেকেই অনেক কথা বলতো। পরিবারের কেউই আমাদের খোঁজ রাখত না। এখন পরিবারের সদস্যরা খোঁজখবর নেন। মাঝেমধ্যেই মা আসেন, থেকে যান সপ্তাহখানেক। আবাসন করে দিয়েছেন, পাশাপাশি সম্মানও দিয়েছেন হুইপ ইকবালুর রহিম। এই আবাসনের জন্য তিনি পুরস্কার পেয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা আমরা যে সমাজেরই অংশ, তিনি তা মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এই কারণে আমরা তার কাছে ঋণী। তিনি আমাদের জীবন-মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সরকারি একটি পুকুর লিজ নিয়ে দিয়েছেন। একজনকে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এবং একজনকে দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। আমরা সবসময় তার মঙ্গল কামনা করি।"
রজনীর মা যশোদা বলেন, "মেয়ের বাড়িতে মাঝেমধ্যে আসি। ওর বাবা মারা গেছে। বেঁচে থাকলে তিনিও আসতেন। রজনী আমার গর্ভের সন্তান। তাকে না দেখে থাকতে পারি না। এখন আর রজনীকে নিয়ে কেউ কিছু বলে না। এখন উল্টো খোঁজখবর নিতে চায়।"
এখানে বাস করেন জোনা আহমেদ রাজ (২৪)। তিনি শহরের ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ড এলাকার আনোয়ার হোসেনের সন্তান। রাজের এক বড় ভাই ও ছোট বোন আছে। ৮ম শ্রেণী পাস রাজ প্রায় ৯-১০ বছর ধরেই এখানে বসবাস করছেন।
তিনি বলেন, "মাঝেমধ্যে বাড়িতে যাই। অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। তবে স্বপ্ন দেখি যখন আমরা পরিবারের সাথেই থেকে যেতে পারবো। হয়তো একদিন সেই দিনও আসবে।"
হাসপাতালে চাকরি পাওয়া আনিস বলেন, "ট্রান্সজেন্ডাররা যে চাকরি করতে পারবে সেটিই আমরা ভাবতে পারতাম না। আমাজের জীবিকা নির্বাহের পথ ছিল- মানুষের কাছে হাত পাতা। কিন্তু এখন আমাকে আর সেটি করতে হয় না। মাঝেমধ্যেই বাড়িতে যাই, সমাজের লোকজনও ভাল ব্যবহার করে। মাঝেমধ্যেই হুইপ ইকবালুর রহিম আমাদেরকে ডাকেন, খবর নেন। আমরা আগে যেভাবে অবহেলিত ছিলাম এখন আর তেমনটি নই।"
কথা হলে জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম বলেন, "পুরস্কার পাওয়ার আশায় নয়, আমি তাদেরকে মানুষের মর্যাদা দিতেই এসব কাজ করেছি। আমি প্রথম যখন একজন ট্রান্সজেন্ডারের জীবনকাহিনী শুনলাম জানতে পারলাম যে, তারা নিজ পরিবারেই অবহেলার পাত্র। নিজ পরিবার থেকেই বিচ্ছিন্ন। সমাজ তাদেরকে ভিন্ন চোখে দেখে। ভবঘুরের মত এখানে-সেখানে বসবাস করে। তখনই মনে করেছি যে তাদেরকে পুনর্বাসন করা আমাদের দায়িত্ব। আর তাই এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছি।"
"বর্তমানে আমি সবচেয়ে আনন্দিত হই এই ভেবে যে, এখন তারা নিজ পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত হতে পেরেছে। সমাজ তাদেরকে আর ভিন্ন চোখে দেখে না। তাছাড়া জীবন পরিচালনার জন্য তাদেরকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।"
ইকবালুর রহিম বলেন, "ট্রান্সজেন্ডাররা নিজ পরিবারের কাছেই অবহেলিত, সমাজের কাছেও অবহেলিত। তাদের জীবন-জীবিকার পথটিও সহজ নয়। তাই তাদেরকে পুর্নবাসন করতে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের অর্থ দিয়ে এই মানবপল্লী নির্মাণ করা হয়েছে। তাদেরকে যেসব ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেগুলোর দলিলও তাদেরকে হস্তান্তর করা হয়েছে। ফলে এসব ঘরের স্থায়ী মালিকানা তাদের।"