কলাবাগান খেলার মাঠ: ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে
রোববার (২৪ এপ্রিল) রাজধানীর কলাবাগানের 'তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষা'র অন্যতম আন্দোলনকারী সৈয়দা রত্না ও তার ছেলে, ১৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ ঈসা আবদুল্লাহকে আটক করে পুলিশ।
এ সময় অপ্রাপ্তবয়স্ক আব্দুল্লাহকে প্রাপ্তবয়স্কদের হাজতে আটক রাখা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। মা ও ছেলেকে এভাবে আটক করায় এসব মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্টে অনেককেই দেখা যায় ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানাতে।
এনজিও কর্মকর্তা শরিফুল হাসান ফেইসবুকে লিখেন, '...আমি মনে করি যে কারণে যেভাবে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেটা অন্যায়। এই অন্যায়ের বিচার হওয়া উচিত। আর ন্যায়ের জন্য সবারই এভাবে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করা উচিত।'
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও অফলাইনে ঘটনার প্রতিবাদের ইঙ্গিত করে তিনি লিখেন, 'এই যে অনলাইন-অফলাইনে সাধারণ মানুষ এই মা-ছেলের মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদ করলেন, সেটাই ন্যায়ের শক্তি। এই দেশটা আমাদের সবার। এভাবেই সম্মিলিতভাবে সব শুভশক্তির জয় হোক। আর প্রতিটি এলাকায় মাঠ চাই।'
আমিন আল রশীদ নামে আরেকজন সাংবাদিক বিষয়টি নিয়ে একাধিক প্রতিবাদমূলক পোস্ট করেছেন। এক পোস্টে ছেলের বয়স ১৮ না হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেন, '…মায়ের সাথে তাকেও ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। অভিযোগ, রাষ্ট্রীয় কাজে বাধাদান।' এ সময় এ নেটিজেন পরিহাস করেন, 'স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে এসে এমন আইনের শাসন আর রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন দুর্দান্ত মানবিক আচরণ দেখে আনন্দে, আবেগে চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন!'
কলাবাগান থানায় ১০ ঘণ্টার বেশি সময় আটক রাখার পর মা ও ছেলেকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। থানার ওসি পরিতোষ চন্দ্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, রত্না ও তার ছেলেকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যে তারা ভবিষ্যতে কোনো সরকারি কাজে বাধা দেবে না।
আজাহার উদ্দীন অনিক নামক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী তার টাইমলাইনে লিখেছেন, 'কলাবাগানে তেঁতুলতলা মাঠ নামে একটা মাঠ আছে, এখানে এতদিন বাচ্চারা গিয়ে খেলাধুলা করত, ঈদের সময় জামাতে নামাজ পড়ত স্থানীয় লোকেরা। এই মাঠটাকে "পতিত" ঘোষণা দিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসন কলাবাগান থানার নিজস্ব ভবন নির্মাণের জন্য অধিগ্রহণ করার ঘোষণা দেয় ২০২০ সালে।
এরপরে প্রধানমন্ত্রীর অফিস, মেয়রের অফিস, স্থানীয় সাংসদ সবার কাছেই আবেদন জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি, উল্টো আমাদের পুলিশ মহোদয়গণ এরপরে মাঠে খেলতে যাওয়া বাচ্চাকাচ্চাদের কানধরে উঠবস করিয়ে ভিডিও করার মত কাজও করেছেন।
এই মাঠ দখল করে ভবন বানানোর এই কাজের প্রতিবাদ করার "অপরাধে" সৈয়দ রত্না এবং তার ১৭ বছর বয়সী ছেলেকে আটক করেছে পুলিশ।'
অনিক লিখেন, এই জিনিস শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব, কাউকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বের করার চেষ্টা করা তাকে কোন অপরাধে গ্রেফতার দেখানো যায়! এ সময় তিনি প্রশ্ন রাখেন, 'ঢাকা শহরে এমনিতেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নাই। বাকি থাকা মাঠগুলোকেও এভাবে পুলিশ, রাজনৈতিক নেতারা দখল করে ফেলে রেগুলার বেসিসে, বাচ্চারা খেলবে কই?'
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১৭ নং ওয়ার্ডের অধীন তেঁতুলতলা খেলার মাঠটি দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের খেলার মাঠ হিসেবে এবং জানাজার মতো অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
এরপর, ২০২০ সালে একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে সেখানে থানার জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে উল্লেখ করে কলাবাগান পুলিশ। বাসিন্দারা অবিলম্বে সেই পদক্ষেপের প্রতিবাদ করে, সাইনবোর্ড অপসারণ করে এবং আগের মতো জায়গাটি ব্যবহার করতে থাকে।
ফেইসবুকে শওগত আলী সাগর এ ঘটনায় পুলিশের ক্ষমতা প্রয়োগের সাথে জবাবদিহিতার অসংলগ্নতার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেন, 'আন্দোলনকারী মা-ছেলেকে থানায় আটকে রাখার ঘটনাটি পুলিশের জবাবদিহিতাবিহীন ক্ষমতা প্রয়োগের একটি নজির হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যে সময়ে ঢাকায় মার্কিন রাষ্টদূত র্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা বলছেন, সে সময়ে পুলিশের এই আচরণ তাদের সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি করতে পারে।'
সাগর মনে করেন, ঘটনাটি যেহেতু খেলার মাঠ তথা পরিবেশ বিষয়ক ইস্যূর সাথে সম্পর্কিত, তাই আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিষযক এবং মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো এই ঘটনার দিকে স্বাভাবিকভাবেই মনোযোগ দেবে। সেটি পুলিশের জন্য তো বটেই সরকারের জন্যও বিব্রতকর হতে বাধ্য।
নিজের পোস্টের সমাপ্তিতে তিনি সরকারের কাছে কলাবাগানে খেলার মাঠটি খেলার মাঠ হিসেবেই থাকার নিশ্চয়তা চান।
২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে কলাবাগান মাঠের জায়গাটি চিহ্নিত করে পুলিশ। কলাবাগান থানা পুলিশের কয়েকজন সদস্যকেও নিয়মিত সেখানে পাহারা দিতে দেখা গেছে।
এর আগে মার্চে ডিএমপি কর্মকর্তারা বলেছিলেন, কলাবাগান থানা কমপ্লেক্স শিগগিরই নির্মাণ করা হবে এবং স্থানীয় জনগণের দাবির সঙ্গে আপস করে জমি ফেরত দেওয়ার সুযোগ নেই।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি সূত্র জানায়, তেঁতুলতলা খেলার মাঠ তাদের খেলার মাঠের তালিকায় নেই। এলাকাবাসী এটিকে খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করছিলেন।
ঘটনায় মর্মাহত হয়ে ফেইসবুককে অনেককে ব্যঙ্গের ছলে পরিহাসসহকারে প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে। বিভু রঞ্জন সরকার নামে একজন 'খেলার মাঠ না চেয়ে, তার জায়গায় থানা দাবি করেছেন'। তিনি লিখেন, 'পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য রত্নাকে মুচলেকা দিতে হয়েছে বলে জানা গেছে। সত্যি তো, তিনি বড্ড অন্যায় করেছেন। খেলার মাঠ দিয়ে আমরা কি করবো? আমাদের দরকার থানা, বড় বড় থানা। খেলাধুলা করে উচ্ছন্নে যাওয়ার চেয়ে থানা-হাজত ইত্যাদি অনেক ভালো এবং নিরাপদ।'
এ সময় তিনি আবাহনী মাঠের প্রসঙ্গ তুলে এনে বিদ্রুপের ছলে প্রশ্ন রাখেন, 'আচ্ছা, আবাহনী মাঠটা কোনো থানা ভবনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া যায় না? আসুন, আমরা সবাই কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ না করার মুচলেকা দেই এবং দাবি তুলি: খেলার সব মাঠে অবিলম্বে থানা ভবন চাই।'
২০২২ সালের ২৪ আগস্ট ঢাকা জেলা প্রশাসনের জারি করা এক নোটিশে উল্লেখ করা হয়, সেখানে ডিএমপি কলাবাগান থানা ভবন নির্মাণের জন্য খেলার মাঠটি সরকার অধিগ্রহণের প্রস্তাব করে। নোটিশে জমিটিকে পতিত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
পরে ১১ সেপ্টেম্বর নোটিশের প্রতিবাদে কলাবাগানের বাসিন্দা, পরিবেশবাদী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও উন্নয়নকর্মী এবং শিশু-কিশোররা আন্দোলন শুরু করে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর ফেইসবুকে শেয়ার করা এ বিষয়ক সংবাদে পাঠকেরা মন্তব্য করেছেন। শামসুদ্দীন আহমেদ নামক এক পাঠক মা-ছেলের একত্রে গ্রেপ্তারের ঘটনাকে 'কুৎসিত' বলে অভিহিত করেছেন। রুম্মান আলম চৌধুরী নামের আরেকজন পাঠক লিখেছেন, 'আজকে স্কুলগুলাতে মাঠ থাকলে এই অবস্থা হতো না। মাঠ ছাড়াই স্কুলস্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে- তাহলে বাচ্চারা খেলবে কোথায়? প্রতিবাদ করলে সমস্যা! আবার নতুন মার্কেট অনুমোদন পাচ্ছে পার্কিং ছাড়া- তাহলে মানুষ গাড়ি রাখছে রাস্তায়- রাখলে আবার মামলা!'
টিবিএস-এর আরেকটি সংবাদে আরেকজন পাঠক আবদুল্লাহ আল নাহিয়ান দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তেঁতুলতলার মাঠের নতুন নাম রত্না-ঈসা মাঠ রাখার প্রস্তাব করেছন।
সৈয়দা রত্না ও এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে থানা ভবন নির্মাণের প্রতিবাদে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন।