টিউবওয়েল আছে, কিন্তু পানি পাওয়া যাচ্ছে না নোয়াখালীর চরাঞ্চলে
২০ বছর আগে সরকারিভাবে পাওয়া একটি গভীর টিউবওয়েলের পানি দিয়ে চলে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার রীতা রানী কাহার ও আরও ৫টি পরিবারের। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চৈত্র মাসের শুরু থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা চেপেও এক গ্লাস পানি টিউবওয়েল থেকে তুলতে পারছেন না তারা।
শুধু 'কাহার পাড়া' না সুবর্ণচর উপজেলার চরবাটা, পূর্ব চরবাটা, মোহাম্মদপুর, চরক্লার্ক ও চরজুবলী ইউনিয়নসহ বেশির ভাগ এলাকায় বর্তমানে দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির সংকট। গরম বাড়ার সাথে সাথে এর তীব্রতা প্রতিদিনই বেড়ে চলছে, বিশুদ্ধ পানির সংকটে বিপাকে পড়েছে এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কোনো পরিকল্পনা ও অনুমোদন ছাড়া স্থানীয় চাষীরা বোরো চাষের জন্য যত্রতত্র ৮০০ থেকে ১২০০ফুট গভীর টিউবওয়েল স্থাপন করে পানি উত্তোলন করার কারণে উপজেলা জুড়ে পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, গভীর নলকূপ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে আশপাশের এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এক কিলোমিটার পর্যন্ত নিচে নেমে যায়।
সাধারণত গভীর টিউবওয়েলগুলোর গভীরতা হয় ৮০০-৯০০ ফুট, ব্যবহার করা হয়ে ১.৫ ইঞ্চি পাইপ। কিন্তু সুবর্ণচর উপজেলার অনেক টিউবওয়েল ১২০০ ফুট গভীরে বসানো হয়েছে, ব্যবহার করা হয়েছে ৪.৫ ইঞ্চি পাইপ।
রীতা রানী কাহার জানান, বর্তমানে নিজের বাড়িতে টিউবওয়েল থাকার পরও প্রতিদিন প্রায় এক কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে নিজেদের খাওয়ার জন্য পানি আনতে হয় পাশ্ববর্তী টিউবওয়েল থেকে।
'মনে হচ্ছে বাড়ির টিউবওয়েলগুলোতে পানি শেষ হয়ে গেছে। সুপেয় পানির সংকট দেখা দেওয়ায় একদিকে যেমন খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে, তেমনি আমাদের গোসল, গবাদি পশুর খাবার ও গোসলের কাজ ব্যহত হচ্ছে।'
চরবাটা ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের মাস্টার জিল্লুর রহমান (৮৩) বলেন, 'গত তিন বছর থেকে আমার বাড়ির দু'টি টিউবওয়েলে চৈত্র মাসের আগে থেকে পানি ওঠা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে আর্সেনিক ও লবণ আছে জানার পরও স্যালো টিউবওয়েল বসিয়ে মোটর দিয়ে পানি তুলে ব্যবহার করতে হচ্ছে।'
পানি সংকটের কারণে এলাকায় স্বাস্থ্য সমস্যাও দেখা দিয়েছে। নোয়াখালী সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকার মানুষ নদী, খাল ও পুকুরের পানি পান ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করে। ফলে বাড়ছে ডায়েরিয়া'সহ নানা রোগ।
উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন বাংলাদেশের সুবর্ণচর শাখার আহবায়ক আবদুল বারী বাবলু দাবী করে বলেন, এ অঞ্চলের মানুষের পানি সংকট সমাধানে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে ভূগর্ভস্ত পানির মজুদের পরিমাণ জরিপ করতে হবে। অন্যথায় পানি শূণ্যতার কবলে পড়তে পারে উপকূলীয় জনপদ।
এভাবে ভূগর্ভের পানিরস্তর খালি হয়ে পড়লে তা পূরণে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। এর ফলে মাটির অগভীরভাগে আর্সেনিক ও লবণাক্ত পানির নির্ভরতা বেড়ে যাবে। খাল, বিল, পুকুর খনন করে বৃষ্টির পানি বা উপরিভাগের পানি সংরক্ষণে সবাইকে মনযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
পানি সংকটের বিষয়ে নোয়াখালী কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তর বলছে, চলতি মৌসুমে বৃষ্টি না থাকায় ভূগর্ভের পানির ওপর কৃষকরা বেশি নির্ভরশীল ছিল। ভূগর্ভের পানি রক্ষা করার জন্য রবি মৌসুমে ধান চাষ বন্ধ করে লাভজনক অনান্য ফসল উৎপাদন করতে তারা স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে কাজ করছে বলে জানানো হয়।
জেলায় এবার ১৩হাজার হেক্টর জমিতে বোরে ধানের আবাদ হয়েছে। যা গতবারের তুলনায় ২হাজার হেক্টর বেশি। এ ধান চাষে ব্যবহার হয়েছে ৪৪ কোটি ১৬লাখ ২০হাজার ২৮০ কিউসেক পানি।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) এর তথ্যমতে, জেলার সুবর্ণচরের চাষাবাদের জন্য আবেদনের ভিত্তিতে ৩৭টি ও পরবর্তীতে স্থাপনের পর আরও ২০৮টি গভীর টিউবওয়েল (সেচ পাম্প) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এর বাইরে চাষীরা ব্যক্তিগত উদ্দ্যেগে আরও এক হাজারের বেশি সেচ পাম্প স্থাপন করেছে, তবে সেগুলো এখনও অনুমোদনহীন। একটি গভীর টিউবওয়েল ভূগর্ভ থেকে প্রতি ঘন্টায় ১৮০০কিউসেক পানি উত্তোলন করা হয়।
বিএডিসি নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আলী আশরাফ বলেন, অবৈধ নলকূপের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সেগুলো উচ্ছেদের উদ্যোগ নেবেন তারা।
সুবর্ণচরের সহকারি কমিশনার (ভূমি) আরিফুল ইসলাম বলেন, অননুমোদিত গভীর নলকূপের কথা শুনেছেন তিনি, কিন্তু অননুমোদিত গভীর নলকূপ স্থাপনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাথে এ বিষয়ে কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও খাল, বিল, পুকুর ও মেঘনা খালটি সংস্কার করে শুকনো মৌসুমে পানি জমিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হবে। তাহলে সেচের কাজে ওই পানিগুলো ব্যবহার করলে টিউবওয়েলের সুপেয় পানির সংকট কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি।