কচ্ছপ গতিতে এগোচ্ছে বিসিকের প্রকল্পগুলো
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) চট্টগ্রামে 'বিসিক শিল্প নগরী, রাউজান' প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল ২০১৬ সালের জুলাই মাসে; শেষ হওয়ার কথা ২০১৯ সালে। বর্ধিত মেয়াদও শেষ হচ্ছে এ বছরের জুনে। কিন্তু গত সাড়ে পাঁচ বছরে প্রকল্পিত এলাকায় সীমানা দেয়াল নির্মাণ ও মাটি ভরাটের কাজই শেষ করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য আরও এক বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বিসিক।
শুধু যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় বেড়েছে তা নয়; সঙ্গে ব্যয়ও বেড়েছে। শুরুতে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। মেয়াদ বাড়ানোর পর প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। নতুন করে সময় বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন হলে আবারও বাড়বে প্রকল্প ব্যয়।
'বিসিক শিল্প নগরী, রাউজান'- একটি উদাহরণ মাত্র। বিসিকের চলমান ১০টি প্রকল্পের সবগুলোর অগ্রগতিই এমন কচ্ছপ গতির। এসব প্রকল্প যখন হাতে নেওয়া হয়েছিল, তখন মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। এখন ব্যয় তিনগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা।
প্রকল্পগুলো হলো- বিসিক শিল্প নগরী, রাউজান; বিসিক শিল্পপার্ক, সিরাজগঞ্জ; বিসিক শিল্পনগর, ভৈরব; বিসিক শিল্পপার্ক, টাঙ্গাইল; বিসিক প্লাস্টিক শিল্পনগর; নরসিংদী বিসিক শিল্পনগর সম্প্রসারণ; বিসিক মুদ্রণ শিল্পনগর; বিসিক বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদন ও হালকা প্রকৌশল শিল্পনগর; বরিশাল বিসিক শিল্পনগরের অনুন্নত এলাকা উন্নয়ন এবং উন্নত এলাকার অবকাঠামো মেরামত ও পুনঃনির্মাণ এবং বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, মুন্সিগঞ্জ।
বিসিক আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে জানা গেছে, বিসিক শিল্পনগরী রাউজান প্রকল্পের আওতায় ৩৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ, ৩০ লাখ ২২ হাজার ঘনমিটার ভূমির উন্নয়ন, ৩৭৫ বর্গমিটার প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ ও ৪৬ বর্গমিটার পাম্প ড্রাইভার কোয়ার্টার নির্মাণ করা হবে। এ শিল্পনগরীতে মোট ১৮৪টি শিল্প প্লটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ইউনিট স্থাপিত হওয়ার কথা ছিলো। যেখানে রপ্তানিজাত তৈরি পোশাকশিল্প, আইসিটি/সফটওয়্যার শিল্প, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, ওষুধ, আসবাবপত্র, প্লাস্টিক, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং, জুয়েলারি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হবে।
শুক্রবার পূর্ব রাউজান মৌজার ঢালার মুখ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিসিক শিল্পনগরের কাজ মাটি ভরাটের কাজ চলছে। সীমানা প্রাচীর তৈরীর কাজও এখনো শেষ করা যায়নি। এর মাঝেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচটি ইটভাটা। স্থানীয়রা জানান কিছুদিন আগেও এসব ইটভাটা থেকে ইটের চালান গেছে জেলার বিভিন্ন এলাকায়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র ছয়মাস আগে মাটি ভরাটের কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্পের সাবেক পরিচালক আহমেদ জামাল নাসের চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'দুইমাস আগে আমি রিটায়ার্ড হয়েছি। তবে কর্মরত অবস্থায় এই প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল। শুরুতে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ করতেই আমাদের তিন বছর চলে গেছে। এছাড়া ঠিক সময়ে অর্থছাড় না হওয়ায় প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়া যায়নি।'
বিসিক আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক ও বর্তমান প্রকল্প পরিচালক নিজাম উদ্দিন বলেন, 'বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় মাটি ভরাট, সীমানা দেওয়াল তৈরী ও কালভার্ট নির্মাণের কাজ চলছে। যেহেতু এবছর কাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না তাই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য আরও এক বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছি।'
মিরসরাই বিসিক শিল্প নগরী এখন গো-চারণ ভূমি
এক যুগ আগে চট্টগ্রামের মিরসরাই সদরে ১৫ দশমিক ৩২ একর জমিতে মিরসরাই বিসিক শিল্প নগরী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতি, অবকাঠামো গড়ে না ওঠা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সহ বিভিন্ন কারণে এই প্রকল্প এখনো আলোর মুখ দেখেনি। অথচ প্রকল্পের প্রথম সংশোধনীতে ২ কোটি ১ লাখ ও দ্বিতীয় সংশোধনীতে ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয় বেড়েছে এই প্রকল্পে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্প এলাকায় কারখানা গড়ে না ওঠায় প্লটগুলো গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। রাত নামলেই মাদকসেবীদের আনাগোনা বাড়ে শিল্প নগরী এলাকায়।
চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, '৮৮টি প্লটের মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে গেছে। চলতি বছর আরো ৭টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আসতে পারবে বলে আশা করছি।'
এক যুগেও শেষ হয়নি সিরাজগঞ্জের বিসিক শিল্পপার্ক
সিরাজগঞ্জে 'বিসিক শিল্পপার্ক' করার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিলো ২০১০ সালে। এটি শেষ হওয়ার কথা ২০১৪ সালে। কিন্তু এক যুগ পরেও সে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে তিন দফা। সঙ্গে ব্যয়ও বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। শুরুতে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৭৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা। আর এখন প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১৯ কোটি ২১ লাখ টাকা।
চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের বর্ধিত মেয়াদও শেষ হচ্ছে। বিসিকের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রকল্পটির ৪৬ শতাংশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ শিল্পপার্ক নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক আবদুল খালেক জানান, বিভিন্ন দপ্তরের প্রয়োজনীয় অনুমোদন সংগ্রহ করতে অনেকটা সময় চলে যায়। সব অনুমোদন পাওয়ার পর ২০১৮ সাল থেকে প্রকল্পের কাজ মাঠে গড়ায়।
পটিয়া বিসিক শিল্প নগরের প্লটে সেলুন-খাবারের হোটেল
১৯৯০ সালে চট্টগ্রামে পটিয়ায় বিসিক শিল্প নগর স্থাপন করা হয়। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতি ও অবকাঠামো গড়ে না ওঠায় প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এই শিল্প নগরের ১০ দশমিক ৫৪ একর জমিতে ২২ প্লটের মধ্যে ১৫ প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে।
তবে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পটিয়ায় বিসিক শিল্প নগরীতে চালু থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে সেলুন, পার্লার, টেইলারিং দোকান, খাবার হোটেল, রেসটুরেন্ট, মোবাইলে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও ফার্নিচার দোকান।
টাঙ্গাইল বিসিক শিল্পপার্ক: সাত বছরে কাজ এগিয়েছে ০.৮১ শতাংশ!
টাঙ্গাইলে বিসিক শিল্পপার্ক প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৫ সালের জুলাই মাসে। এটি শেষ হওয়ার কথা ২০১৭ সালের জুনে। তিন দফা প্রকল্পটি সংশোধন করে এখন চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। প্রথমে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৬৪ কোটি টাকা, যা বেড়ে ২৯৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা হয়েছে। তবে এই সাত বছরে প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ০.৮১ শতাংশ!
অন্যান্য প্রকল্প
বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদন ও হালকা প্রকৌশল শিল্পনগর গড়তে বিসিক মুন্সিগঞ্জে প্রকল্প শুরু করে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে। ২০১৯ সালের জুনে এটি শেষ হওয়ার কথা। গত ছয় বছরে এ প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ২৮ শতাংশ। জমি অধিগ্রহণে সময়ক্ষেপণ ও অন্যান্য কারণে ইতিমধ্যে প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়েছে। নতুন মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত। শুরুতে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১৩ কোটি টাকা। আর এখন ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৩০৯ কোটি টাকা।
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে শিল্পনগর প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালে। ২০১৬ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা। দুই দফা সংশোধন করে এখন চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এখন ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৮০ কোটি ২৫ লাখ টাকা। তবে প্রকল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এখনো দৃশ্যমান হয়নি। অথচ প্রকল্পের সময় শেষ হতে বাকি আর আড়াই মাস। যদিও বিসিক ৪৭ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার দাবি করা হয়েছে।
একইভাবে পোভার্টি রিডাকশন থ্রু ইন্টিগ্রেটেড এন্ড সাসটেইনেবল মার্কেটস (প্রিজম) প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এটি শেষ হওয়ার কথা। অথচ গত সাত বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৩ শতাংশ।
রাজশাহী বিসিক শিল্প নগরী-২ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের জুলাইতে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৪৪ শতাংশ। বরিশাল শিল্প নগরীর অনুন্নত এলাকা উন্নয়নের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৭ সালে। ২০২১ সালে কাজের মেয়াদ শেষ হলেও কাজ হয়েছে মাত্র ২৮ শতাংশ।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিকের চেয়ারম্যান মুহ. মাহবুবর রহমান বলেন, 'জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতার কারণে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ও ব্যয় বেড়েছে। প্রকল্পগুলোর সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে। অনুমোদিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করা হবে।'