ধান/চাল মজুদের সীমা বাড়ানোর পক্ষে ব্যবসায়ীরা
- দাম বৃদ্ধি খুঁজতে গিয়ে বেরোচ্ছে নানা 'অনিয়ম'
- চট্টগ্রামে দুই প্রতিষ্ঠান সিলগালা
- রাজধানীতে দক্ষিণ সিটির অভিযানে মেলেনি চালের দামে অস্বাভাবিকতা, তবে ট্রেড লাইসেন্স না থাকায় ৫ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা
ভরা মৌসুমে ধান এবং চালের দাম বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করতে গত কয়েকদিন ধরে একটি অভিযান পরিচালনা করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
খাদ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের অভিযানে এই সীমার অতিরিক্ত চাল মজুদ পাওয়ায় ব্যবসায়ীদের জরিমানা, প্রতিষ্ঠান সিলগালা ও মামলা করার ঘটনাও ঘটছে।
অবৈধ মজুদ ঠেকাতে এই অভিযানকে সাধুবাদ জানালেও ব্যবসায়ীরা এখন ধান-চাল মজুদের সীমা বাড়ানোর দাবি তুলছেন।
বর্তমানে একজন পাইকারি ব্যবসায়ী ৩০ দিনের জন্য তিনশ টন চাল মজুদ করতে পারেন।
১১ বছরের পুরনো আইন দ্বারা ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে মজুদের এই সীমা যুগোপযোগী করে কয়েকগুণ বাড়ানো পক্ষে ব্যবসায়ীরা।
সাম্প্রতিক সময়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের অভিযানের প্রেক্ষিতে এমন দাবি তুলেছেন তারা।
এর আগে সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে এফবিসিসিআিইয়ের একটি মনিটরিং টিম কারওয়ান বাজার ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিমিয়ের সময়ও ব্যবসায়ীরা মজুদের সীমা বাড়িয়ে যুগোপযোগী করার পক্ষে মত দেন।
কারওয়ান কিচেন মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন ওইসময় বলেন, মজুদের বিষয়ে যে আইন রয়েছে, সেটা অনেক পুরনো। আইনে বেঁধে দেওয়া এই সীমা বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
মূলত, ১৯৫৬ সালের কন্ট্রোল অফ এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট-এ নির্ধারিত মজুদের সীমার বেশি ধান/চাল পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
২০১১ সালে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক আদেশে ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকদের মজুদের বিষয়টি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।
এই আইনে বলা হয়েছে, ব্যবসায়ী পর্যায়ে একজন পাইকারি বিক্রেতা সর্বোচ্চ তিনশ টন ধান/চাল মজুদ রাখতে পারবেন। খুচরা পর্যায়ে মজুদের এই সীমা সর্বোচ্চ ১৫ টন।
অবৈধ মজুদের কারণে স্কয়ার ফুড এন্ড বেভারেজ কোম্পানী বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এসিআই কোম্পানীকে ৮০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
রাজধানীসহ জেলা ও বিভাগ পর্যায়েও চলছে অভিযান।
এছাড়াও কয়েকটি বড় কর্পোরেট গ্রুপ ধান/চাল ব্যবসার লাইসেন্স না থাকলেও মজুদের কারণে বাজারে একটা সংকট তৈরী হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বড় বড় কর্পোরেট হাউজের নিজস্ব মিল না থাকলে তারা যাতে ধান-চালের ব্যবসায় যুক্ত হতে না পারে তা নিশ্চিতে নজরদারি বাড়াতে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।
এদিকে আইনে নির্দিষ্ট সীমার চেয়ে বেশি মজুর রাখায় গত দুইদিনে চট্টগ্রামের দুটি প্রতিষ্ঠান সিলগালা ও ১১টি প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক জরিমানা করেছে জেলা প্রশাসন।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাগেরহাটে নির্দেশিত সীমার বেশি চাল মজুত করার দায়ে বরকত রাইস মিলকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।এই আদালত অন্তত ১০-১২টি মিলে অভিযান চালালেও তেমন মজুদ না পাওয়ায় সতর্ক করেছে।
মিলটির স্বত্ত্বাধিকারী মধু দাম টিবিএসকে বলেন, "মজুদের উদ্দেশ্যে কোনো করসাজি হয়নি। মূলত, আড়তদার থেকে ধান কেনার পর চাল তৈরী করা হয়। কিন্তু শুরুতে নতুন চালের চাহিদা একটু কম থাকে। একটু পুরনো হলে, সেই চালের চাহিদা তৈরী হয়, সেই জন্য মিলে কিছু বাড়তি চাল ছিল।"
ধান/চাল মজুদের সীমা বাড়ানোর দাবি
২০১১ সালের ৪ মে জারি হওয়া গেজেট অনুযায়ী একজন পাইকারী ব্যবসায়ীর ৩০০ মেট্রিক টন চাল মজুদের সীমাকে খুব কম আখ্যা দিয়ে বাড়ানো দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ধান/চাল ব্যবসার পরিধি বাড়ছে। তবে ১১ বছর আগের জারি করা নির্দেশনা সংশোধন এখন সময়ের দাবি।
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, "প্রতিনিয়ত দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে খাদ্য চাহিদাও। তাই সময়ের প্রয়োজনে পাইকারী ব্যবসায়ীদের জন্য খাদ্য মজুদের পরিমাণ ও সময় বাড়ানো উচিত।"
তিনি বলেন, পাইকারী ব্যবসায়ীদের চাল মজুদের সীমা ৩০০ মেট্রিক টন থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার মেট্রিক টন করা উচিত। একইসাথে গুদামজাতকরণের সময় ৩০ দিন থেকে বাড়িয়ে ৪৫ দিন করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
গুদাম সিলগালা করে দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশও করছেন কোনো কোনো ব্যবসায়ী।
সীমার বেশি মজুদে সিলগালা দুই প্রতিষ্ঠান
পাইকারি ব্যবসায়ীরা ৩০০ টন চাল মজুদের নির্দেশনা অমান্য করায় চট্টগ্রামের আল্লার দান স্টোর ও আমেনা ট্রেডার্সের প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে জেলা প্রশাসন।
এদিন লাইসেন্স নবায়ন না করা, গুদামে অতিরিক্ত চাল রাখার দায়ে চাক্তাই বাজারে চালের ৭ টি দোকানকে ২৪ হাজার টাকা জরিমানা করেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ম্যাজিষ্ট্রেট ওমর ফারুক।
তিনি বলেন, "চাক্তাই বাজারের আল্লাহর দান স্টোরের লাইসেন্স পাওয়া যায়নি। তার স্টক রেজিষ্টারে ২ হাজার ৮৭০ বস্তা চাল থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে চাল ছিলো তিনগুন বেশি বা প্রায় ৮ হাজার বস্তা। প্রতি বস্তায় ৫০ কেজি হিসেবে গুদামে রাখা চালের পরিমাণ ৪০০ মেট্রিক টন।"
পাহাড়তলী বাজারে অভিযান চালিয়ে বেশি দামে চাল বিক্রি ও মজুদ করায় ৪ আড়তদারকে ৩৩ হাজার টাকা জরিমানা করে। ফুড গ্রেন লাইসেন্স না থাকায় আমেনা ট্রেডার্সকে সিলগালা করা হয়।
চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবদুল কাদের বলেন, "পাইকারী ব্যবসায়ী পর্যায়ে ৩০ দিন সময়ের জন্য ৩০০ মেট্রিক টন চাল মজুদের সীমা বাজারে কোনো প্রভাব ফেলবেনা।"
চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই অভিযানের ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে বলে তিনি দাবী করেন।
দাম বৃদ্ধি খতিয়ে দেখতে বেরোচ্ছে নানা অনিয়ম
ভরা মৌসুমে ধান-চালের দাম বৃদ্ধি খতিয়ে দেখার অভিযানে বেরিয়ে আসছে আরও কিছু অনিয়ম, যা এতদিন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আসেনি।
ধান-চাল ব্যবসায়ীদের কারো কারো লাইসেন্স নেই। কারো লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ। কেউবা লাইসেন্স না নিয়ে ধান-চাল ব্যবসায় নেমেছে, অবৈধভাবে মজুদ করছে।
বাজারে চালের মূল্য স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন।
নগরীর বাবু বাজারস্থ চালের পাইকারি আড়তে এবং নবাব ইউসুফ আলী মার্কেটের খুচরা চালের দোকানে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়।
তবে চালের বাজারে অবৈধ মজুদ কিংবা মূল্য তালিকায় কোনো অস্বাভাবিকতা পায়নি ভ্রাম্যমাণ আদালত।
অভিযানকালে বাদামতলীর ১টি চালের আড়ত, নবাব ইউসুফ মার্কেটের ৩টি খুচরা চালের দোকান এবং সংলগ্ন ১টি হোটেল তৎক্ষনাৎ বাণিজ্য অনুমতির হালনাগাদ (ট্রেড লাইসেন্স) কাগজপত্র দেখাতে না পারায় মোট ৫টি মামলায় ২৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
এ অভিযান প্রসঙ্গে দক্ষিণ সিটির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আফিফা খান টিবিএসকে বলেন, পরিচালিত প্রায় দুই ঘন্টার অভিযানে চালের মূল্য বৃদ্ধিতে সেখানকার আড়তদার ও খুচরা দোকানিদের কারসাজি প্রতীয়মান হয়নি।
- এই প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন চট্টগ্রাম, বাগেরহাট ও দিনাজপুরের টিবিএস প্রতিনিধিরা