‘পরিত্যাক্ত’ বাংলার সমৃদ্ধির জন্য বিমাদাবির পুরো টাকা পাচ্ছে না বিএসসি
ইউক্রেনে পরিত্যাক্ত ঘোষিত জাহাজ 'এমভি বাংলার সমৃদ্ধি'র বিমাদাবির সম্পূর্ণটা বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) কর্তৃপক্ষ পাওয়ার যোগ্য নয় বলে রিপোর্ট দিয়েছে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান একুয়ালিস ব্রেমার এলওসি (এবিএল)। ফলে আড়াই মাস আগে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা জাহাজটিকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে বিএসসিকে।
বৃহস্পতিবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি এ পরিকল্পনার কথা জানায়। এ তথ্য দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে নিশ্চিত করেছেন কমিটির সদস্য ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের এমপি সামিল উদ্দিন আহম্মেদ শিমুল।
তিনি জানান, সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ইউক্রেনে ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে জাহাজটি নিয়ে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বিএসসি।
বিএসসির প্রতিবেদনে বলা হয়, 'নিয়ম অনুসারে জাহাজকে পরিত্যক্ত করে কন্সট্রাক্টিভ টোটাল লস (সিটিএল) কার্যকর করতে হলে স্যালভেজ (উদ্ধার) ও মেরামত খরচ বীমা মূল্যের ৮০ শতাংশের বেশি হতে হয়। বাংলার সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে (বীমা মূল্য ২২ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ডলার) সিটিএল কার্যকর করতে উদ্ধার ও মেরামত খরচ ১৭ দশমিক ৯৮ মিলিয়ন ডলারের বেশি হতে হবে। এর কম হলে সেটি আংশিক ক্ষতি হিসেবে বিবেচিত হবে।'
'বাংলার সমৃদ্ধি'র উদ্ধার ও মেরামত খরচ জানতে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান একুয়ালিস ব্রেমার এলওসি (এবিএল) নিয়োগ দিয়েছিলো বিএসসি। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জাহাজে সরাসরি উপস্থিত হওয়া সম্ভব না হওয়ায় জাহাজের বিভিন্ন তথ্য, ড্যামেজের ছবি, ভিডিও ফুটেজ ইত্যাদি পর্যালোচনা করে রিমোট অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে আনুমানিক মেরামত খরচ নির্ণয় করে এবিএল প্রতিবেদন দিয়েছে।
এবিএলের প্রতিবেদনে জাহাজের উদ্ধার ও মেরামতের আনুমানিক মোট খরচ তিন দশমিক ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নিরুপণ করা হয়েছে। সে হিসেবে 'আপাতদৃষ্টিতে' সিটিএল কার্যকর হবে না ধরে জাহাজ উদ্ধার ও মেরামত কার্যক্রম শুরু করার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করছে বিএসসি।
ইউক্রেনে রকেট হামলার পর পরিত্যাক্ত ঘোষিত জাহাজ 'এমভি বাংলার সমৃদ্ধি'র জন্য সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের কাছে ২২.৮ মিলিয়ন ডলার বিমাদাবি করেছিলো দেশের সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনাকারী বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) কর্তৃপক্ষ।
সংসদীয় কমিটির সদস্য সামিল উদ্দিন আহম্মেদ শিমুল টিবিএসকে বলেন, "সংসদীয় কমিটি জাহাজটিকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। এক্ষেত্রে আমরা কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর জোর দিতে বলেছি। বিমা প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্যও আমরা জোর দিয়েছি।"
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, "আমরা শুরু থেকেই বলছি, 'বাংলার সমৃদ্ধি' নিয়ে যা কিছু ঘটছে পুরোটাতেই বিএসসি দারুণ অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। বিদেশের যুদ্ধক্ষেত্রে একটা জাহাজ পরিত্যাক্ত ঘোষণা দিয়ে পুরো বিমা চাইবেন আর বিমা প্রতিষ্ঠান দিয়ে দেবে এটা কিভাবে হয়?"
"বিএসসির মূল সমস্যা হলো তারা আমাদের সঙ্গে কোনো বিষয় শেয়ার করেন না, অথচ আমাদের সংগঠনে আন্তর্জাতিক মানের অনেক মেরিনার আছেন যারা এ বিষয়ে বিএসসিকে ভালো পরামর্শ দিতে পারতো," বলেন তিনি।
তবে বিষয়টি নিয়ে টিবিএসের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) শীর্ষ দুই কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বাড়ছে ক্ষতির পরিমাণ, জাহাজ উদ্ধার করতে চায় বিএসসি
তিন মাস ধরে পরিত্যাক্ত অবস্থায় ভাসছে বাংলাদেশি জাহাজ 'বাংলার সমৃদ্ধি'। এ দীর্ঘ সময়েও জাহাজটি দেখে রাখার জন্য ওয়াচম্যান নিয়োগ করতে পারেনি পরিচালক সংস্থা বিএসসি। তবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট পেয়ে এবার তাদের বোধদয় হয়েছে।
সংসদীয় কমিটির কাছে দাখিল করা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, 'জাহাজটি দীর্ঘদিন ইউক্রেনের ওলিভিয়া বন্দরে পড়ে থাকার কারণে এর বীমা/যুদ্ধঝুঁকি প্রিমিয়াম পরিশোধসহ বিএসসির পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বেড়ে চলেছে। বাংলার সমৃদ্ধির দ্রুত উদ্ধার ও মেরামত কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পোল্যান্ড এবং রোমানিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতা চেয়ে মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে।'
মেরিটাইম আইনজীবি হামদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "বিএসসি জাহাজটিকে কোন ক্রাইটেরিয়াতে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে তা পরিস্কার করেনি। যেহেতু বন্দর সীমানায় বাংলার সমৃদ্ধি রয়েছে, সেহেতু অলিভিয়া পোর্ট তাদের পাওনা আদায়ের জন্য জাহাজটির মালিকানা দাবির সম্ভাবনা বেশি। কারণ ইতোমধ্যেই তিনমাস অতিক্রম হয়েছে। প্রতিটি দিনের জন্য তারা ন্যূনতম ১০ হাজার ইউএস ডলার জরিমানা দাবি করবে।"
সংসদীয় কমিটির সদস্য সামিল উদ্দিন আহম্মেদ শিমুল বলেন, "জাহাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা কিংবা উদ্ধার ও মেরামত যেটা আমাদের জন্য ভালো হবে তা নির্ণয়ে দক্ষ পরামর্শক নিয়োগের কথা বলেছি। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজের তদন্ত কমিটিতে মন্ত্রণালয়কে দ্রুত একজন মেরিটাইম আইনজীবি নিয়োগ করার সুপারিশ করা হয়েছে।"
'পরিত্যাক্ত' বাংলার সমৃদ্ধি কি ফেরানো যাবে?
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন মো. এনাম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "হামলায় জাহাজের নেভিগেশন সিস্টেম পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। জাহাজের মেইন পাওয়ার জেনারেটরও কাজ করছে না। এ জাহাজ নিয়ে আর সমুদ্রপথে বের হওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে বসফরাস প্রণালী দিয়ে জাহাজ বের করে আনার অনুমতি তুরস্ক দেবে না।"
বিকল্প হিসেবে যুদ্ধ থামলে জাহাজটি আশেপাশের কোনো দেশের কোনো ডকইয়ার্ডে নিয়ে মেরামত করা যায়। তাতে খরচ হতে পারে কম-বেশি ৩০ কোটি টাকা। এ বিষয়ে বিএসসিকে দেশীয় প্রতিষ্ঠান প্রান্তিক মেরিন প্রস্তাব দিলেও বিএসসি তাদের কোনো জবাব দেয়নি বলে জানান ক্যাপ্টেন মো. এনাম চৌধুরী।
গত ২৩ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ২৯ ক্রু নিয়ে ওলভিয়া বন্দরে আটকা পড়ে জাহাজটি। ২ মার্চ রকেট হামলার শিকার হয়। এতে জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হাদিসুর রহমান প্রাণ হারান।
পরদিন ৩ মার্চ জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে অন্য ২৮ নাবিককে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়। ৮ মার্চ বিএসসি 'এমভি বাংলার সমৃদ্ধি'র জন্য সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের কাছে ২২.৮ মিলিয়ন ডলার বীমা দাবি করে।