বাগেরহাটে পর্যটন বাড়াবে পদ্মা সেতু
- ষাটগম্বুজ ও সুন্দরবনকে প্রধান্য দেওয়া হয়েছে ট্যুরিজম মাস্টার প্লানে
- একদিনে ষাটগম্বুজ ঘুরে আসতে পারবে রাজধানীর মানুষ
- পর্যটকের চাপ সামলাতে সুন্দরবনে আরও ৪টি ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র বানানো হচ্ছে
- বাগেরহাট জেলাকে পর্যটক বান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে
- বাড়তি পর্যটকদের নিরাপত্তায় ২৪ ঘণ্টা সেবা দিবে ট্যুরিস্ট পুলিশ
পদ্মা সেতু চালু হলে খুলনাঞ্চলে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে বলে প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডে ও পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িতরা।
বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদাপ্রাপ্ত ষাটগম্বুজ মসজিদ ও সুন্দরবন (ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট) রয়েছে খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলায়। প্রতিবছর সেখানে লাখ লাখ পর্যটকের আগমন ঘটে। তবে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় সুবিধার অভাবে পর্যটন শিল্পের তেমন বিকাশ ঘটেনি ওই অঞ্চলে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, "আমাদের দেশে তিনটি ঐতিহ্যবাহী স্থান আছে। তার মধ্যে দুইটিই খুলনা বিভাগে। তবে ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকার কারণে এতদিন সেখানে পর্যটকের সংখ্যা তুলনামূলক কম ছিল। পদ্মা সেতু চালু হলে যাতাযাত ব্যবস্থা ভাল হয়ে যাবে। ফলে ওই অঞ্চলে পর্যটকের সংখ্যাও বাড়বে।"
তিনি বলেন, "আমাদের দেশের মানুষ ঘুরতে চায়। প্রতি বছর ডোমেস্টিক পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ২ কোটির বেশি।"
"আমারা সারা বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় সার্ভে করে একটি মাস্টার প্লান তৈরির কাজ করছি। তাতেও ষাটগম্বুজ ও সুন্দরবনকে প্রধান্য দেওয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে এই কাজটি শেষ হবে। তখন দেশি-বিদেশি একাধিক সংস্থা ট্যুরিজমে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে। বিদেশি পর্যটকরাও আসবে।"
পদ্মা সেতু চালু হলে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের পর্যটন অনেক দূরে এগিয়ে যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। পাশাপাশি বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডও বিনিয়োগ করবে বলে জানান আবু তাহের।
ষাটগম্বুজ মসজিদ
১৫শ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে বাগেরহাটে ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন খান জাহান আলী। ১৯৮৫ সালে মসজিদটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দিয়েছে ইউনেস্কো। বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই মসজিদটি দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, ষাটগম্বুজ আমাদের দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন নিদর্শন। তবে ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় দেশি-বিদেশি পর্যটকরা তুলনামূলক কম আসেন এখানে।
পদ্মা সেতু চালু হলে রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ৩ ঘণ্টায় পর্যটকরা এসে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ পরিদর্শন করতে পারবেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। আবার একইদিনে তারা ঢাকাতে ফেরত যেতে পারবেন।
"ষাটগম্বুজ মসজিদ নিয়ে দেশের মানুষের কৌতুহল আছে। তবে যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ হওয়ার জন্য সবাই দেখতে আসতে চাইতো না। পদ্মা সেতু চালু হলে সেখানে পর্যটক বৃদ্ধি পাবে," বলেন আফরোজা খান।
তিনি বলেন, "পদ্মা সেতু চালু হলে শুধু যে ষাটগম্বুজে পর্যটক বৃদ্ধি পাবে তা নয়, আমাদের অন্যন্য প্রত্নতত্ত্ব স্থানেও পর্যটক বাড়বে।"
বর্তমানে খুলনা বিভাগে টিকিট কেটে ৭টি স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া আরও ১০০টির বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিনামূল্য দেখার সুযোগ রয়েছে।
ষাটগম্বুজ মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে একটি জাদুঘর। ওই জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. যায়েদ বলেন, "এ অর্থবছরে ষাটগম্বুজ মসজিদে দেশি-বিদেশি পর্যটক এসেছে প্রায় আড়াই লক্ষ। এ থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৫৫ লক্ষ টাকা।"
তিনি বলেন, পদ্মা সেতু খুলে দেওয়া হলে পর্যটকদের সংখ্যা দুই থেকে তিন গুন বৃদ্ধি পাবে। আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায় দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি পাবে।
বাগেরহাটের খানজাহান আলী মাজার এলাকার হোটেল ব্যবসায়ী মো. কামরুজ্জামান বলেন, "পর্যটন মৌসুম ছাড়া বাগেরহাটে পর্যটকদের আনাগোনা কম থাকে। এ কারণে হোটেল ব্যবসায়ীদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।"
"পদ্মা সেতু খুলে দিলে, বছর জুড়ে পর্যটকদের আগমন ঘটবে বাগেরহাটে। চাপ থাকবে হোটেল-মোটেলগুলোতে। নতুন নতুন হোটেল-মোটেল তৈরী হবে, বাড়বে কর্মসংস্থানের সুযোগও," যোগ করেন তিনি।
সুন্দরবন
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, শিহরণ ও রোমাঞ্চকর স্থান বিশ্বের সব থেকে বড় লোনা পানির বন সুন্দরবন। ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো।
বন অধিদপ্তরের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, প্রতিবছর সুন্দরবনে আড়াই লাখ থেকে ৩ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন। এতে সরকারের প্রায় ৩ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়।
বর্তমানে সুন্দরবনে ৭টি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র রয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে বাড়তি পর্যটকের চাপ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, "সুন্দরবন যেহেতু একটি প্রাকৃতিক স্থান, এখানে অতিরিক্ত পরিমাণে পর্যটক প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। ভবিয্যতের কথা মাথায় রেখে সুন্দরবনে আরও চারটি পর্যটক কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। দ্রুত এই চারটি কেন্দ্রেও পর্যটকরা ভ্রমণ করতে পারবেন।"
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, "পর্যটন শিল্পের বিকাশে পূর্ব শর্ত হচ্ছে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা। পদ্মা সেতু চালু হলে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা সহজে সুন্দরবনে আসতে পারবে।"
বাগেরহাটের ট্যুরিস্ট গাইড নিয়ামুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবন দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সমাগম থাকে প্রায় বছর জুড়ে। ঢাকা থেকে বাগেরহাটের আসতে মাওয়া ঘাটে জ্যামসহ নানা কারণে ইচ্ছা থাকলেও পর্যটকরা সহজে আসতে পারতো না।
"আশা করছি পদ্মা সেতু চালুর পর এ সমস্যা গুলো আর থাকবে না। ভ্রমণ পিপাসুরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাদের ভ্রমণ শেষে ফিরে যেতে পারবে," বলেন তিনি।
পর্যটনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে বাগেরহাটকে
শুধু ষাটগম্বুজ মসজিদ বা সুন্দরবন নয়, বাগেরহাটে দেখার মতো আরো অনেক স্থাপনা রয়েছে বলে দাবি করেছেন বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মো. আজিজুর রহমান।
তিনি বলেন, "মসজিদের শহর বাগেরহাটকে দেশি-বিদেশি মানুষের কাছে আরও পরিচিত করতে আমাদের সকলের এগিয়ে আসতে হবে। দীর্ঘদিন আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আবাসন সুবিধা না থাকায় বাগেরহাট ভ্রমণে দর্শনার্থীদের আগ্রহ কম ছিলো। কিন্তু পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পর সহজে বাগেরহাটে আসতে পারবে পর্যটকরা।"
এর আগে ফেরি ঘাটেই ৭/৮ ঘণ্টা ব্যায় হয়ে হত, এখন মাত্র ৩ ঘণ্টার মধ্যেই পর্যটকরা বাগেরহাট আসতে পারবে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে বাগেরহাটকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
"ইতোমধ্যেই পর্যটন করপোরেশনের অর্থায়নে ১২ কোটি ৭৭ লাখ ৬ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি তিন তারকা মানের হোটেল ভবন নির্মাণের কাজ প্রায় ৮০ ভাগ শেষ হয়েছে। ষাটগম্বুজ মসজিদের সামনে বিশ্রামাগার নির্মাণ, মসজিদ সংলগ্ন ঘোড়া দিঘিকে নান্দনিক করতে ওয়াকওয়ে তৈরি করাসহ বাগেরহাটকে পর্যটকবান্ধব করার জন্য নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১০০ জনকে ট্যুরিস্ট গাইড হিসাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, শুধু সরকারি ভাবে নয়, ব্যাক্তি উদ্যোগে দৃষ্টিনন্দন হোটেল-মোটেলসহ নানা স্থাপন তৈরী করার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হতে হবে। এর ফলে লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী হবে। এখানকার মানুষের জীবনমান আরো বৃদ্ধি পাবে।
ট্যুরিষ্ট পুলিশের খুলনাঞ্চলের পুলিশ সুপার দেওয়ান লালন আহমেদ বলেন, "বর্তমানে খুলনা অঞ্চলের ৬টি জোনে ট্যুরিস্ট পুলিশ পর্যটকদের সেবা দিচ্ছে। ষাটগম্বুজ ও সুন্দরবনে পর্যটকদের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু চালু হলে বাগেরহাটের সাথে রাজধানীর যাতায়াত সহজ হবে, ফলে পর্যটকও বাড়বে। বাড়তি পর্যটকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে আমরা প্রস্তুত আছি।"