আমার আকুতি প্রতিবার হেসে উড়িয়ে দিতেন সত্যজিৎ: শাবানা আজমি
বাংলা সিনেমা তার হাত ধরে পূর্ণতা পেয়েছে। তিনি ঋদ্ধ করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রকে। তার ব্যাপ্তি পার করেছে সব সীমারেখাকে।
তিনি আক্ষরিক অর্থে এ অঞ্চলের চলচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন।
কথা হচ্ছে বাঙালির গর্ব, সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে। ১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট যদি বাংলা সিনেমার নতুন জন্ম হয়, তবে সেই জন্মদাতার জন্ম হয়েছিল আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে। ১৯২১ সালের ২ মে জন্মেছিলেন সুকুমার রায়ের সুযোগ্য পুত্র সত্যজিৎ রায়। তার চলচ্চিত্র ভাবনা সত্যিই অনন্য।
সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে কলম ধরলেন ভারতীয় প্রখ্যাত অভিনেত্রী শাবানা আজমি। চলুন পড়া যাক:
"আমি কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করবার সুযোগ পাব। যখন শামা জৈয়দি (কস্টিউম ডিজাইনার) আমাকে ফোন করে বলল, উনি (সত্যজিৎ রায়) আমাকে 'শতরঞ্জ কে খিলাড়ি'তে কাস্ট করতে ইচ্ছুক, থমকে গিয়েছিলাম। বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল ওই কথাগুলোকে বিশ্বাস করতে। তারপর খুব চাপাস্বরে, ফিসফিস করে 'হ্যাঁ' বললাম। পালটা কোনো প্রশ্ন করিনি।
প্রথম দিকে মিস্টার রায় আমাকে ওই চরিত্রের জন্য কাস্ট করতে ইতস্তত বোধ করেছিলেন কিন্তু। ওনার মনে হয়েছিল, মির্জার স্ত্রীর চরিত্রের জন্য আমার বয়সটা খুব কম। তবে উপরওয়ালাকে ধন্যবাদ, শেষমেষ উনি নিজের মন পালটেছিলেন।
কিছুদিন পর, যখন ছবির প্রযোজক সুরেশ জিন্দল আমাকে ফোন করলেন, আমার একবারের জন্য মাথাতেও আসেনি চুক্তিপত্র চাইবার কথা, অথচ তখনও পর্যন্ত একবারের জন্যও মানিকদার সঙ্গে আমার দেখাই হয়নি। আমি জানতাম উনি 'অঙ্কুর' দেখেছেন। এই ছবি নিয়ে উনি লিখেছিলেন- 'দুটো হাই পিচড দৃশ্যে, শাবানা আজমি মারাত্মক সুন্দরভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আমাদের প্রজন্মের সেরা নাটকীয় অভিনেত্রীদের একজন হিসাবে।' বিশ্বাস করুন, নিজের অভিনয় সম্পর্কে ওনার কাছ থেকে এই প্রশংসাবাণী শুনে আমার হৃদযন্ত্রটা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
১৯৭৬ সালে তেহরানে প্রথমবার মানিকদার সঙ্গে আমার দেখা। সেই সময় আমি তেহরান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের বিচারক। আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো সেখানে আমার চরিত্রটি নিয়ে কোনো কথা বলবেন, কিন্তু সেটা উনি করলেন না। এক পরিচিতের বাড়িতে খুব কাছের মানুষদের নিয়ে আয়োজিত এক নৈশভোজ, যখন ওনাকে কাছ থেকে দেখলাম, বুঝতে পারলাম, সকলের সামনে কাজ নিয়ে কথা বলবার বিষয়টা ওনার এক্কেবারেই অপছন্দ।
আর কোনো কথাবার্তা হয়নি, নির্ধারিত দিনে আমি কলকাতা পৌঁছালাম। টলিগঞ্জের ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে যখন ঢুকছি, দেখলাম মানিকদা বাইরে দাঁড়িয়ে। তাকে ঘিরে রয়েছে জনা কয়েক মানুষজন। আমি হাত মেলালাম। উনি বললেন, 'আমরা প্রথমে ছবির লম্বা দৈর্ঘ্যের দৃশ্যগুলো শ্যুট করব। দ্রুত কস্টিউম পরে তৈরি হয়ে নাও। আমি এসে বাকিটা দেখছি।'
শুনে আমার কেমন একটা খটকা লাগল, তবে ওনার কথা মেনে নিলাম ঘাড় নেড়ে। প্রচণ্ড ভারী পোশাক গায়ে চড়াতেই দেখলাম আমার শরীরের কাঠামোটাই কেমন যেন বদলে যাচ্ছে, আমি অজ্ঞাতভাবেই একদম সোজাভাবে বসেছিলাম। মানিকদা মেকআপ রুমে ঢুকে বললেন, 'বেশ… এবার তুমি বেগমের যন্ত্রণাটা ভালোভাবে অনুভব করতে পারবে। জিনস-টপে তোমার শরীরের অঙ্গভঙ্গিগুলো একটা শহুরে কিশোরীর মতো ছিল।'
উনি আমাকে ভয় দেখাননি, তবে ওনার চারিপাশ জুড়ে এমন একটা আভা ছড়িয়ে থাকত, যে আপনি মন্ত্রমুগ্ধ না হয়ে থাকতে পারবেন না! আমার চরিত্রের যা পরিসর ছিল, তাতে তিনদিনের শ্যুটিংই যথেষ্ট ছিল। যখন আমি আমার প্রথম টেক দিলাম, উনি বললেন, 'খুব সুন্দর।' এরপর আস্তে আস্তে আমার দিকে হেঁটে এসে বললেন, 'আচ্ছা, তুমি কি এটা একটু ভাগে ভাগে ভাঙতে পারবে? অভিযোগ, রাগ, যন্ত্রণা?' ওস্তাদের মুখের ওই একটা লাইন সবকিছু বদলে দিয়েছিল।
এরপর বছরের পর বছর কেটেছে। ফোনে আমাদের খুব কমই কথা হয়েছে। একবার আমি চা খেতে গিয়েছিলাম ওনার বাড়ি। সেখানে শুধু বই আর বই! তাক জুড়ে, ডেস্কে, এমনকি মাটিতেও! উনি শুধু লোপচু চা খেতেন। সেটা একটা সাজানো ট্রে-তে আসত। কেটলির মধ্যে ঢাকা দেওয়া, পাশে চা পাত্রের আবরণ, দুধ, চিনি অন্যদিকে রাখা। আমার মা, শওকত কাইফি ঠিক এইভাবে বাড়িতে চা পরিবেশন করতেন।
কোনোকিছুই তাকে ছুতে পারেনি। তিনি নবজাগরণের পথিকৃৎ ছিলেন, সেটিও তার উপর চেপে বসেনি।
'খণ্ডর' (Khandhar) আর 'পার' (Paar) দেখে উনি আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি খুব উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম। বলেছিলেন, খণ্ডর-এর গল্পটা ওনার খুব বেশি ভালো না লাগলেও আমার পারফরম্যান্স দুর্দান্ত লেগেছে। 'পার' ছবিতে আমার আর নাসিরের (নাসিরুদ্দিন শাহ) অভিনয়ের খুব প্রশংসা করেছিলেন। ছবিতে রেলওয়ে স্টেশনের দৃশ্য, যেখানে নাসির একটা কাগজের টুকরো হারিয়ে ফেলে, সেটার খুব সুখ্যাতি করেছিলেন।
আমি ওনাকে বারবার অনুরোধ করেছিলাম ওনার অন্য কোনো ছবিতে আমাকে কাস্ট করবার। প্রতিবার হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলতেন, আমার একটাই হিন্দি ছবি তৈরির পরিকল্পনা ছিল, আর কোনো প্ল্যান নেই। আমার চিরকালের আফসোস, আর কোনোদিন মানিকদার সঙ্গে কাজের সুযোগ হয়নি আমার।"