এশিয়ায় দ্রুত বিস্তারে মরিয়া নেটফ্লিক্স
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/02/13/netflix-logo.jpg)
স্ট্রিমিং ভিডিওর রাজা হিসেবে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে ২ কোটি গ্রাহকের মাইফলক স্পর্শ করা নেটফ্লিক্স। ক্রমবর্ধমান গ্রাহক থাকায় এশিয়ায় দ্রুত গতিতে নিজেদের প্রসার বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিনোদন জগতের এই বাঘা প্রতিষ্ঠান গত বছর এশিয়া প্যাসিফিক থেকে নতুন করে পেয়েছে ৯.৩ মিলিয়ন পেইড সাবস্ক্রাইবার, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৬৫ শতাংশ বেশি।
ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় ৪০ শতাংশ আয় বৃদ্ধির বিপরীতে এই অঞ্চলের থেকে নেটফ্লিক্সের আয় বেড়েছে প্রায় ৬২ শতাংশ।
ক্রমবর্ধমান সাবস্ক্রাইবারের এই গতি নেটফ্লিক্সকে এশিয়ায় আরও দ্রুত নিজেদের বিস্তার চালাতে উৎসাহিত করেছে। ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং অন্যান্য দেশে আরও নতুন গ্রাহক পাওয়ার আশায় এ বছর এই অঞ্চলের অরজিনাল কন্টেন্ট নির্মাণের বাজেট প্রায় দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
যদিও আপাতত চীনের মূল ভূখণ্ড বাইরে থাকছে এই পরিকল্পনার। অন্যদিকে, এ খাতে নেটফ্লিক্স কত টাকা খরচ করবে, তা জানা যায়নি।
কোম্পানির চিফ অপারেটিং অফিসার এবং চিফ প্রোডাক্ট অফিসার গ্রেগ পিটার্সের মতে, 'এশিয়ায় সম্ভাবনা নিয়ে আমরা খুবই উদগ্রীব ও উৎসাহী। আক্ষরিক অর্থে সেখানে শত শত কোটি মানুষ রয়েছে, যাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য আমরা চমৎকার কোনো উপায় খোঁজার চেষ্টা করছি।'
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2021/02/13/alice_in_borderland.jpg)
কন্টেন্ট মেশিন
পাঁচ বছর আগে জাপানে নিজেদের সেবা চালু করার মধ্য দিয়ে এশিয়া প্যাসিফিকে যাত্রা শুরু করে নেটফ্লিক্স (এনএফএলএক্স)। সে সময় ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক কোম্পানিটি মূলত এই অঞ্চলে 'স্টার্টআপ' ছিল। পিটার্স জানান, তখন এর কোনো স্থানীয় কর্মী বা এমনকি অফিস স্পেস পর্যন্ত ছিল না।
সময় বদলেছে। তিন বছর আগে নেটফ্লিক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিড হেস্টিংস ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, 'পরবর্তী ১০০ মিলিয়ন' গ্রাহক শুধুই ভারত থেকে আসবে; পরে সেখানে নেটফ্লিক্স দেখা পেয়েছে 'বিশাল প্রবৃদ্ধির'।
এশিয়ান কন্টেন্টের মালিকানা পাওয়া বা উৎপাদনের জন্য ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত নেটফ্লিক্স প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে। এখন পর্যন্ত ২০০ টিরও বেশি অরিজিনাল এশিয়ান কন্টেন্টের সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছে তাদের। নেটফ্লিক্স এই অঞ্চলজুড়ে প্রায় ৬০০ কর্মী নিয়োগ করেছে এবং সিঙ্গাপুরে রয়েছে তাদের আঞ্চলিক সদর দপ্তর।
এই সাফল্যের সূত্র হচ্ছে, পশ্চিম বিশ্বের জনপ্রিয় শোগুলোর সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষদের অভ্যস্ত করানো।
২০১৯ সালে নেটফ্লিক্স 'অদ্ভুত চোখ' নামে একটি বিশেষ সিজন চালু করে, যেখানে অভিনেতারা অভিনয় করেছিল জাপানি মেকওভার করে। ডিসেম্বরে 'মানি হেইস্ট'-এর দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্করণ বের করার ঘোষণা দেয় নেটফ্লিক্স, যা মূলত সমালোচক ও দর্শকদের প্রশংসা অর্জন করা একটি স্প্যানিশ ক্রাইম ড্রামা ।
যদিও কোম্পানিটি বুঝতে পেরেছে, এশিয়ান দর্শকেরা শুধুই পাশ্চাত্যের অনুষ্ঠানে অভ্যস্ত হতে চায় না।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2021/02/13/indian_matchmaking.jpg)
দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের নেটফ্লিক্সের কন্টেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট কিম বলেন, '২০১৬ সালে যখন প্রথম এশিয়াভিত্তিক কন্টেন্ট এক্সিকিউটিভ হিসেবে নেটফ্লিক্সে যোগ দিলাম, তখন কোম্পানিটি জানত, এশিয়ায় আমাদের ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় কন্টেন্ট সত্যিই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে যাচ্ছে। আমাদের কাছে শুধু এর কোনো প্রমাণ ছিল না।'
আজ সেই পরিস্থিতি নেই। নেটফ্লিক্সের আন্তর্জাতিক শো যেমন বিভিন্ন পরিসরে বাণিজ্য করেছে, কোম্পানি বুঝতে পেয়েছে তাদের এশিয়ান শোয়েরও বিশ্বব্যাপী আবেদন রয়েছে। জাপানের 'অ্যালিস ইন বর্ডারল্যান্ড', দক্ষিণ কোরিয়ার 'কিংডম' এবং ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে ধারণ করা 'ইন্ডিয়ান ম্যাচমেকিং' বিশ্বব্যাপী সাফল্য অর্জন করেছে।
আরও দুটি কারণ এশিয়ায় নেটফ্লিক্সকে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সুযোগ করে দিয়েছে। গত বছর কোরিয়ান নাটক বা 'কে-ড্রামা' দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শীর্ষ ১০টি তালিকায় আধিপত্য বিস্তার করে। ২০১৯ সালের তুলনায় গত বছর কোরিয়ান কন্টেন্টের আঞ্চলিক দর্শক সংখ্যা চারগুণ বেড়েছে। এদিকে জাপানি অ্যানিমের আঞ্চলিক দর্শক সংখ্যা বছরে হয়েছে দ্বিগুণ।
এশিয়ায় দর্শক গড়ে তুলতে নেটফ্লিক্সে ভাষার সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে। তাদের সেবা এখন হিন্দি, চীনা, ভিয়েতনামী এবং মালয়-সহ ৩৫টি ভাষায় পাওয়া যায়। সাবটাইটেলিং ও ডাবিং অপশন-সহ আরও ভাষা যোগ করা অব্যাহত রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এশিয়ার দর্শকদের জন্য সুলভ মোবাইল-ওনলি প্ল্যান চালু করেছে নেটফ্লিক্স, বিশেষ যারা নিজেদের ফোনে প্রচুর ভিডিও দেখেন, এমনকি বাড়িতে থাকাকালেও, তাদের জন্য। এই সেবা ২০১৯ সালে ভারতে শুরু হয় এবং তারপর থেকে অন্যান্য দেশে প্রসারিত হয়েছে।
পিটার্স বলেন, এশিয়ার দর্শকরা কোম্পানিটিকে নতুন প্রযুক্তি উন্নয়নে সাহায্য করেছে, যা পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ বিদেশি ভাষা শেখার চেষ্টা করছে, ধীর গতিতে একটি শো দেখতে চাইছে, সেই চাহিদা পূরণ করতে নেটফ্লিক্সকে ভিডিও প্লেব্যাক গতি টগল করার ক্ষমতা চালু করতে হয়েছে, যা এখন বিশ্বব্যাপী ব্যবহার হচ্ছে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2021/02/13/kingdom.jpg)
বিশ্বায়নের অসুবিধা
প্রতিযোগিতা বাড়তে থাকলে নতুন কন্টেন্টের প্রয়োজনীয়তা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অরিজিনাল কন্টেন্ট মজুদ করার মাধ্যমে কোম্পানি প্রতিযোগীদের কাছে গ্রাহক হারানোর ঝুঁকির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
গত মাসে শেয়ার হোল্ডারদের কাছে লেখা এক চিঠিতে নেটফ্লিক্স দাবি করেছে, তারা বছরের পর বছর ধরে বিশ্বব্যাপী আরও ধারালো প্রতিযোগিতা প্রত্যাশা করছে।
চিঠিতে লেখা হয়, 'এ কারণে বিভিন্ন ধারা ও জাতি জুড়ে আমাদের অরিজিনাল কন্টেন্ট সংগ্রহশালাকে আরও শক্তিশালী করতে আমরা এত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি।'
এই চিন্তাধারা নেটফ্লিক্সকে নতুন সিনেমা, সিরিজ ও তথ্যচিত্রের একটি মহাসমারোহ গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছে। ৫০০টিরও বেশি প্রযোজনা ইতোমধ্যে অপেক্ষায় আছে সম্প্রচার হওয়ার। এমনকি নেটফ্লিক্স ২০২১ সালে প্রতি সপ্তাহে একটি করে নতুন চলচ্চিত্র মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
যদিও কোম্পানিটি আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ভারতে ডিজনি (ডিআই) স্থানীয় কোম্পানি হটস্টারের সঙ্গে সরাসরি ক্রিকেট ম্যাচ দেখানোর জন্য অংশীদার হয়েছে।
মর্নিংস্টারের সিনিয়র ইকুইটি বিশ্লেষক নিল ম্যাকার বলেন, 'ভারতে ডিজনি/হটস্টারের যা কিছু রয়েছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে সরাসরি খেলা দেখার সুবিধা, যা নেটফ্লিক্সে নেই।'
রাজনৈতিক নানা জটিলতায়ও পোহাতে হয় নেটফ্লিক্সকে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2021/02/13/a_suitable_boy.jpg)
২০১৯ সালে এটি সৌদি আরবে 'প্যাট্রিয়টিক অ্যাক্ট' নামক কমেডি শোয়ের একটি পর্ব বন্ধ করে দেয়, যেখানে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সমালোচনা করা হয়েছিল।
গত নভেম্বরে নেটফ্লিক্স ভারতে উত্তপ্ত পরিস্থিতির মুখে পড়ে, কিছু রাজনীতিবিদ 'অ্যা সুইটেবল বয়' সিরিজ নিয়ে আপত্তি জানানোর পর এটি বয়কটের আহ্বান জানায়; কারণ সেখানে হিন্দু ও মুসলিম চরিত্রদের মধ্যে একটি চুম্বন দৃশ্য দেখানো হয়। এমনকি তা শেষ পর্যন্ত পুলিশে অভিযোগের বিষয় হয়ে ওঠে।
প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে সেন্সরশিপের দাবি মোকাবেলা করে, জানতে চাইলে পিটার্স 'সৃজনশীল স্বাধীনতা' সমর্থন করার অঙ্গীকার করেন।
তিনি বলেন, 'আমাদের কোনো বিশেষ এজেন্ডা নেই, যা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করব। আমরা কোনো দলের ক্ষতি বা অপমান করতে চাই না; তবে বিভিন্ন ধরনের নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করছি। আর এই বৈচিত্র্যময় নির্মাতাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বিস্তৃত।'
এশিয়ার একটি বিশাল বাজারে নেটফ্লিক্স এখনো প্রবেশ করতে পারেনি: বিশেষ করে চীনের মূল ভূখণ্ডে। আগেও চীনে বিস্তার ঘটাতে গিয়ে নেটফ্লিক্স হতাশাজনক ফলাফলের সম্মুখীন হয়েছে।
২০১৬ সালে নেটফ্লিক্স শেয়ার হোল্ডারদের জানায়, স্থানীয় 'নিয়ন্ত্রক পরিবেশ' একটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে, যদিও তারা এখনো আশা করছে, চীনে 'অবশেষে' কার্যক্রম চালু করতে পারবে। সে বছর চীনা স্ট্রিমিং জায়ান্ট আইকিয়ের সঙ্গে একটি নিষ্ফল লাইসেন্সিং অংশীদারিত্ব শুরু করে নেটফ্লিক্স। অবশ্য, নেটফ্লিক্সের নিজস্ব সেবা চীনের মূল ভূখণ্ডে কখনো শুরু করা সম্ভব হয়নি।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2021/02/13/patriot_act.jpg)
আইকিউই'র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গং ইউ পরে সিএনবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'এর প্রভাব অত ভালো ছিল না, তাই আমরা অংশীদারিত্ব অব্যাহত রাখিনি।'
এ বিষয়ে পিটার্স বলেন, 'আমাদের কাছে চীনে ভবিষ্যত নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। সত্যিই, আমরা চীনের বাইরে সুযোগের অপেক্ষায় থাকি।'
এমনকি এশিয়ার অন্যত্র কোম্পানির সাফল্যের হিসাব করেও পিটার্স বলেন, তা সন্তোষজনক নয়।
তিনি বলেন, 'এমন কিছুই এখানে নেই, যে বিষয়ে আমি সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে পারি। আমাদের ক্রমাগত উন্নতি চালিয়ে যেতে হবে। আমরা সারা বিশ্বের অনেক মানুষের সঙ্গে যুক্ত। তবে সব মানুষের সঙ্গে নই, তাই না? তাই আমাদের আরও কাজ করতে হবে।'
- সূত্র: সিএনএন