আগে নাটকের বক্তব্যে জোর দেওয়া হতো, এখন ভিউয়ে: ফজলুর রহমান বাবু
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বিনোদন মিডিয়ায় চরিত্র অনুযায়ী অভিনয় করে হাতেগোনা যে ক'জন অভিনয়শিল্পী আকাশচুম্বী দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন, তাদের মধ্যে ফজলুর রহমান বাবু অন্যতম। একজন অভিনয়শিল্পীকে যেভাবে পর্যায়ক্রমে অভিনয়ের দীক্ষা নিয়ে বিকশিত হতে হয়, তিনি ঠিক সেই পথ দিয়েই এগিয়ে এসেছেন।
আজকের এই অবস্থানে আসার জন্য অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলার পাশাপাশি নিতে হয়েছিল ঝুঁকিও। অনেকেই হয়ত জানেন না যে বাবু কর্মজীবন শুরু করেছিলেন একজন ব্যাংকার হিসেবে। কিন্তু অভিনয়ের প্রতি অদম্য টান এবং ভালোবাসার কারণে তিনি ব্যাংকের চাকরি থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে থাকেন।
পরিবারের সদস্যদের অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও একসময় চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে পুরোপুরি অভিনয়ে আত্মনিয়োগ করেন।
তার অভিনয় জীবনের সূচনা হয়েছিল জন্মস্থান ফরিদপুরে। যদিও গ্রামে ছিল তার আবাস। তারপরও ফরিদপুর জেলা শহরে এসে শুরু করেন অভিনয় দীক্ষা। মঞ্চনাটক দিয়েই প্রাথমিকভাবে অভিনয় করতে শুরু করেন। অল্পবয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর আর্থিক সংকটের মধ্যেই পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অভিনয়টাও শিখতে থাকেন। একসময় চাকরী নিয়ে ঢাকায় আসার পর আরণ্যক নাট্যদলে ভর্তি হয়ে যান। এখানে নাট্যজন মামুনুর রশীদের তত্ত্বাবধানে অভিনয়ের দীক্ষা নেয়ার পাশাপাশি মঞ্চে অভিনয় করতে থাকেন। তারপর থেকেই আসলে তার অভিনয় দক্ষতা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং দর্শকের ভালোবাসা পাওয়া শুরু করেন। একটা সময় অভিনয়ে আত্মবিশ্বাস তৈরী হলে তিনি চাকরী ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি অভিনয়ে মনোযোগ দেন।
মঞ্চ নাটকেই নিজেকে আটকে রাখেননি। টিভি নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতে থাকেন। একক নাটকের পাশাপাশি ধারাবাহিক নাটকেও তার উপস্থিতি উপভোগ্য। তবে গত তিন বছর ধরে বাবু ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'বর্তমান সময়ের ধারাবাহিক নাটকের গল্প আমার কাছে একই রকম মনে হয়। তাই আগ্রহ পাই না। যখন এ ধরনের নাটকের গল্পে একটা টান অনুভব করতাম তখন নিয়মিতই অভিনয় করেছি। টাকার জন্য কখনই অভিনয় করি না। যদি তাই করতাম তাহলে হয়ত এতোদিন অনেকের মতোই স্রোতের সঙ্গে হারিয়ে যেতাম। পেশাদার অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে এক ধরনের ধৈর্য এবং সংযম দরকার, যা আমি করার চেষ্টা করি।'
একজন আপাদমস্তক অভিনয়শিল্পী হিসেবেই দিনযাপন করেন ফজলুর রহমান বাবু। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে গায়ক হিসেবেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তিনি। বিশেষ করে গিয়াসউদ্দিন সেলিমের পরিচালনায় 'মনপুরা' সিনেমায় তার গাওয়া 'নিথুয়া পাথারে' গানটি এখনও শ্রোতাদের মুখে মুখে প্রচলিত আছে। এই গানটি দিয়েই কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বাবুর আবির্ভাব ঘটে। তবে গান নিয়ে তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নাই, যা অবলীলায় স্বীকারও করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে বাবু বলেন, 'নিজের জন্য তো গুনগুনিয়ে গান করতাম। তাছাড়া মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের জন্য কিন্তু গান গাইতে হতো। সেটুকুই শিল্পী হিসেবে সঞ্চয় ছিল আমার। এরপর মনপুরা সিনেমা তৈরীর সময় পরিচালক সেলিম আমাকে দিয়ে জোর করিয়ে সেই গানটিতে কণ্ঠ দেয়ান। প্রথমে ভয় ছিল গানটি নিয়ে। এটি প্রকাশ হওয়ার পর যখন সব বয়সী শ্রোতারা পছন্দ করল তখন অন্য ধরনের এক আনন্দ পেয়েছিলাম। তবে আমি কখনও গায়ক হতে চাইনি, এখনও চাই না। আমি অভিনয় নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।'
মঞ্চনাটকে তার অভিনয়ের বিরতি চললেও এখন সিনেমা এবং ওটিটি প্লাটফর্মে নিয়মিত অভিনয় করছেন এই অভিনেতা। কিছুদিন আগে অনম বিশ্বাসের পরিচালনায় ওয়েব ফিল্ম 'দুই দিনের দুনিয়া'য় অভিনয় করেছিলেন। যেটি এরইমধ্যে প্রকাশও হয়েছে। এছাড়া তার অভিনীত একাধিক সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় আছে। এগুলো হলো এম শাখাওয়াত হোসেনের পরিচালনায় 'ভাঙন' ও 'বীরাঙ্গনা ৭১' , রাজীব আহসানের 'উড়াল', সানী সানোয়ার ও ফয়সাল আহমেদের 'মিশন এক্সট্রিম-২' এবং রাঙামাটি জেলার নারী ফুটবলারদের জীবন নিয়ে নির্মিতব্য একটি সিনেমায় অভিনয়ের কথা রয়েছে তার। এদিকে নতুন দুটি গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন ফজলুর রহমান বাবু। গান দুটির শিরোনাম হলো 'আন্ধার রাতে জীবন যৌবন' এবং 'বন্ধুরে তোর মন জুগাইয়া চলব কতকাল'।
কথামালার শেষ পর্যায়ে এসে আবারও এই অভিনেতা ফেরেন নাটকের প্রসঙ্গে। তিনি বলেন, '২০ বছর আগেও যেমন ভালো নাটক তৈরী হতো , এখনও হয়। ২০ বছর আগেও খারাপ নাটক তৈরী হতো, এখনও হয়। আরেকটা বিষয় হলো আগে নাটকে বক্তব্যের দিকে জোর দেয়া হতো, এখন দেয়া হয় ভিউয়ের দিকে। আমি মনে করি ভিউ বাড়ানোর জন্য যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা আছে সেটা থেকে বের হওয়া উচিত। ভালো এবং মূল্যবোধসম্পন্ন কনটেন্ট দিয়েও ভিউ বাড়ানো যায়। সেই দিকে জোর দিতে হবে। আর যারা সমাজের এবং দেশের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে কাজ করেন, তাদের উৎসাহিত করতে হবে।'