আমি রাজনীতিবিদ হতে চেয়েছিলাম: আহমেদ রুবেল
বয়স পঞ্চাশের কোঠা পেরিয়ে গেলেও এখনও তারুণ্যের আভা ছড়িয়ে আছে অবয়বে। সমবয়সী অন্য অনেক অভিনেতার মতো ঝিমিয়ে পড়েননি তিনি, বরং সময়ের সাথে সাথে নিজেকে আরও শাণিত করেছেন, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছেন। নতুন নতুন চরিত্রে মানিয়ে নিয়ে এখনও দর্শকদের অনবদ্য অভিনয় উপহার দিয়ে যাচ্ছেন অভিনেতা আহমেদ রুবেল। মাঝে কয়েক বছর তাকে টিভির পর্দায় কম দেখা গেলেও, সাম্প্রতিক সময়ে আবারও চাঙ্গা ভাব এনেছেন নিজের মধ্যে, কাজ করছেন পুরোদমে।
বাংলাদেশের অভিনয় অঙ্গনে সাবলীল অভিনয় করে যে কজন অভিনেতা দর্শকের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন, আহমেদ রুবেল তাদের মধ্যে অন্যতম। মঞ্চনাটক দিয়ে অভিনয় শুরু, এরপর টিভি নাটক এবং পরে চলচ্চিত্রেও অভিনয় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। কিন্তু ভক্তরা কী জানেন যে ছোটবেলা থেকেই অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন ছিল না আহমেদ রুবেলের? বরং আহমেদ রুবেল হতে চেয়েছিলেন একজন রাজনীতিবিদ।
অভিনেতা বলেন, "আমার বাবা ছিলেন শিক্ষক। তাই তিনি চাইতেন আমি ভালোভাবে পড়ালেখা করি। কিন্তু আমার ভেতরে তখন কাজ করছে অন্যকিছু। ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে ছিলাম, মারামারি করতাম সুযোগ পেলেই। একসময় রাজনীতির দিকে ঝুঁকতে শুরু করলাম, যদিও তখনো ম্যাট্রিকের গণ্ডি পার করিনি। আমি রাজনীতিবিদ হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাবার কঠোর নির্দেশ ছিল- পরিবার থেকে এ বিষয়ে কোনো সহযোগিতা করা হবেনা। তাই অল্প বয়সেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে রাজনীতি আর করা যাবে না। তাই কিছু তো একটা করতে হবে। সেই থেকে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের দিকে ঝুঁকে পড়লাম।"
শুরুর দিকে নিজের জন্মস্থান গাজীপুরে নাট্যদল গঠন করে অনেককে নিয়ে নাট্যচর্চা শুরু করেন। নাট্যকার সেলিম আল দীনের সহায়তায় গ্রাম থিয়েটার আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন এই অভিনেতা। এরপর পেয়ে বসে অভিনেতা হবার অদম্য বাসনা। গাজীপুরের আঞ্চলিক পরিমণ্ডল থেকে এইচএসসি শেষ করার পর ঢাকায় এসে ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হন। শুরু হয় পেশাদারী নাট্যচর্চা শুরুর পাঠ। এখানে এসেই তিনি সেলিম আল দীন, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, আফজাল হোসেন, হুমায়ূন ফরিদীর মতো অভিনয় কিংবদন্তীদের সাহচর্য পান এবং নিজেকে তৈরি করতে থাকেন।
এ সংগঠনে আসার পরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আহমেদ রুবেল বলেন, "ঢাকা থিয়েটারে আসার আগে অভিনেতা হিসেবে নিজেকে নিয়ে এক ধরনের অহংবোধ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখানে আসার পর দেখলাম যে আসলে আমি কিছুই না। অভিনয় যে কি জিনিস তা এখানে আসার পর বুঝতে শুরু করলাম। আমিও সংগঠনের সব নিয়ম মেনে দীক্ষা নিতে থাকলাম। এরপর একসময় ঢাকা থিয়েটারের হয়ে মঞ্চ নাটকে অভিনয় শুরু করি। ততদিনে আমার অস্তিত্বে অভিনয় ছাড়া আর কিছুই নেই।"
অতীতের স্মৃতিচারণ করে এই অভিনেতা বলেন, "ঢাকা থিয়েটারে কাজ করার সময় হুমায়ূন ফরিদী ভাইয়ের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো সত্যিই অসাধা্রণ। তার কাছে ছোট ছোট অভিনয়ের দীক্ষা আমার খুব কাজে লেগেছে। এই গুণী মানুষটির কথা খুব মনে পড়ে।"
টিভি নাটকের আগেই চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় আহমেদ রুবেলের। যদিও বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন তালিকাভুক্ত অভিনয়শিল্পী ছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে উত্তম আকাশের পরিচালনায় 'আখেরী হামলা' নামের সিনেমা দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক হয়। প্রথম সিনেমা ব্যবসাসফল হওয়ায় একই পরিচালকের আরও দুটি সিনেমায় তিনি অভিনয় করেন। এভাবে প্রায় একডজন সিনেমায় অভিনয় করেন ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। এরপর সিনেমা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন তিনি।
চলচ্চিত্র থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন, এমন প্রশ্নে আহমেদ রুবেল বলেন, "আমি থিয়েটার করে যে ধরনের অভিনয় ক্যারিয়ার গড়ার ছবি আঁকতাম মনে, তা থেকে হয়তো সরে যাচ্ছিলাম। একটা নির্দিষ্ট ছকে বন্দি হয়ে যাচ্ছিলাম। তাই নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম সিনেমায় অভিনয় করা বন্ধ রাখবো।"
এরপর কিছুদিনের বিরতি নিয়ে ২০০০ সাল থেকে টিভি নাটকে অভিনয় শুরু করেন আহমেদ রুবেল। এখন পর্যন্ত একক ও ধারাবাহিক মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক নাটকে তিনি অভিনয় করেন। তবে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর 'ব্যাচেলর' দিয়ে সিনেমায় ফিরে সিনেমায় অভিনয়ের ধারা পরিবর্তন করেন এই প্রখ্যাত অভিনেতা।এরপর কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের 'চন্দ্রকথা'সহ আরও কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেন।
বর্তমানে নাটক ও সিনেমা এই দুই মাধ্যমেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন আহমেদ রুবেল। ১১ নভেম্বর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে তার অভিনীত চলচ্চিত্র 'দেশান্তর'। আশুতোষ সুজনের পরিচালনায় এতে একটি কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। কবি নির্মলেন্দু গুণের গল্প অবলম্বনে সিনেমাটি তৈরি হয়েছে, সিনেমায় তার চরিত্রের নাম মনীন্দ্র। ছবিতে বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতীক হিসেবে দেখা যাবে তাকে।
এ সিনেমাটি নিয়ে আহমেদ রুবেল বলেন, "নির্মলেন্দু গুণকে আমরা কবি জনপ্রিয় কবি হিসেবেই জানি। কিন্তু তিনি যে এত সুন্দর গল্পও লিখতে পারেন, তা আগে জানা ছিল না। আমি খুবই স্বস্তি বোধ করেছি এতে অভিনয় করে। আশা করছি দেশপ্রেমের গল্প নিয়ে নির্মিত এ সিনেমাটি দর্শকের ভালো লাগবে।"
এদিকে নুরুল আলম আতিকের পরিচালনায় 'পেয়ারার সুবাস' নামের একটি সিনেমাতেও অভিনয় করেছিলেন আহমেদ রুবেল যেটি মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর বাইরে নতুন একটি ওয়েব সিরিজে অভিনয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অভিনয়ে আবারও নতুন কিছু নিয়ে হাজির হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে নিজের কথার ইতি টানলেন এই গুণী অভিনেতা।