শাকিরা, জাস্টিন টিম্বারলেক এবং আরও যেসব শিল্পী গানের মাধ্যমে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন!
প্রাক্তন প্রেমিক বা প্রেমিকার প্রতি রাগ-ক্ষোভ থেকে গান রচনা সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য নতুন কিছু নয়। প্রেমে ব্যর্থ বা প্রতারণার শিকার হয়ে কিংবা বিচ্ছেদের পরে বহু শিল্পীই মনের যন্ত্রণা থেকে এমন অনেক গান লিখেছেন ও গেয়েছেন, যেগুলো পরবর্তীতে তাদের ক্যারিয়ারের অনবদ্য সৃষ্টি হয়ে রয়েছে। 'সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রতিশোধ' নিয়ে নিজের মনকে হালকা করার পাশাপাশি তারা গানের মাধ্যমে বিশ্বকে জানিয়েছেন নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের কথা। এসব ক্ষেত্রে নারী সঙ্গীতশিল্পীদের গান তুলনামূলক বেশি পরিচিতি পেলেও, পুরুষ শিল্পীরাও বাদ যাননি 'প্রতিশোধ' নেওয়া থেকে!
১৯৯৫ সালে নিজের তৃতীয় স্টুডিও অ্যালবাম 'জ্যাগড লিটল পিল'-এর লিড সিঙ্গেল 'ইউ অটা নো' গানটি দিয়ে সঙ্গীত জগতে ব্যাপক খ্যাতি পান ২০ বছর বয়সী কানাডিয়ান-আমেরিকান গায়িকা অ্যালানিস মরিসেট। পরবর্তীতে একাধিক সাক্ষাৎকারে অ্যালানিস জানিয়েছেন, প্রাক্তন প্রেমিকের হাতে প্রতারণার শিকার হওয়ার পর তিনি প্রচণ্ড রাগান্বিত ছিলেন এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। এরপরেই তিনি এই গানটি রচনার মধ্য দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করেন।
যদিও অ্যালানিস তার গানে বা কোনো সাক্ষাৎকারেই কখনো তার সেই প্রাক্তন প্রেমিকের নাম উচ্চারণ করেননি, কিন্তু তার তৎকালীন প্রেমিক ডেভ কুলিয়ার জনপ্রিয় টিভি সিটকম 'ফুল হাউজ'-এ অভিনয়ের জন্য আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে ডেভ বলেছিলেন, তিনি যখন প্রথম এ গানটি শোনেন তখন রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন এবং ভাবছিলেন- "না, এটা আমি হতে পারি না!"
এরপর অভিনেতা সোজা একটা রেকর্ডের দোকানে গিয়ে অ্যালানিসের অ্যালবামটি কেনেন; যেমনটা করেছিলেন বিশ্বের আরও ৩৩ মিলিয়ন মানুষ! অ্যালানিস একা ছিলেন না। প্রিয় মানুষের কাছ থেকে প্রতারিত হবার যে সার্বজনীন অনুভূতি, যে অনুভূতির তিক্ত স্বাদ বিশ্বের লাখ লাখ নারী তাদের জীবনে পেয়েছেন- তা অ্যালানিসের গানে নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছিল বলেই শ্রোতারা তার সাথে একাত্ম হতে পেরেছিলেন।
১৯৬৭ সালে (প্রথম ক্যাসিও ঘড়ি বাজারে আসার সাত বছর আগে) আমেরিকান গায়িকা ও গীতিকার অ্যারেথা ফ্রাংকলিন নারী শ্রোতাদের এমন একটি গান উপহার দেন, যাতে করে তারা আত্মসম্মানবোধ বজায় রেখে চলতে অনুপ্রাণিত হন। কিন্তু এই 'নারীবাদী' গানের রচয়িতা ছিলেন ওটিস রেডিং নামক একজন পুরুষ গীতিকার, যদিও তিনি গানটির অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবনই করতে পারেননি। রেডিং গানটি লিখেছিলেন এমন এক সময়ে যখন তিনি নিজের স্ত্রীর ওপর চরম বিরক্ত ছিলেন। রেডিং এর ভাষ্যে- তিনি ট্যুর থেকে বাড়ি ফেরার পর তার স্ত্রী তাকে যথেষ্ট ভালোবাসা দেখাতেন না। সে কারণেই দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য চলছিল। এদিকে অ্যারেথা ফ্রাংকলিন গানটিকে নিজের জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেন এবং তার কিংবদন্তি সুরেলা গলায় 'রেসপেক্ট' শব্দটিকে হাইলাইট করেন।
পুরুষেরাও যে প্রেমঘটিত যন্ত্রণা থেকে গান রচনা করেননি তা নয়। জাস্টিন টিম্বারলেক তার 'ক্রাই মি আ রিভার' গানটি গেয়েছিলেন ব্রিটনি স্পিয়ার্সকে উদ্দেশ্য করে। ২০১২ সালে এক কনসার্টে এই গান সম্পর্কে তিনি বলেন, "মাঝেমাঝে মনে হবে আপনি আপনার ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়ে গেছেন, কিন্তু এরপর হঠাৎ একদিন উপলব্ধি করবেন- সে একটা বাজে মানুষ ছাড়া আর কিছুই ছিল না!"
রোলিং স্টোনসের 'মেলোডি' শিরোনামের গানটিতে বলা হয়েছে: "আমি তার পেছনে পেছনে লক্ষ্য রাখছি এবং হঠাত করেই তাকে ধরে ফেলতে চাই, তারপর আমি তাকে জীবিত পোড়াতে চাই!" এরকম ঘৃণায় পরিপূর্ণ গান লেখার পেছনেও যে হৃদয়ভঙ্গের যন্ত্রণা কাজ করেছে তা বলাই বাহুল্য। সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ অ্যানাবেল ভেলেজ বলেছেন, বব ডিলানের 'ব্লাড অন দ্য ট্র্যাকস' অ্যালবামের পুরোটাই ছিল 'বিচ্ছেদ নিয়ে'।
এবার শাকিরার সর্বশেষ গানের প্রসঙ্গে আসা যাক। শাকিরা তার 'ডিস ট্র্যাক' শিরোনামের গানটির মাধ্যমে আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন একসময়কার দারুণ জনপ্রিয় ক্যাসিও ঘড়ির কথা; জানিয়েছেন টুইংগো কি এবং পাকিতা লা দেল বারিও (মেক্সিকান গায়িকা ও অভিনেত্রী) কে ছিলেন। একই সাথে শাকিরার প্রজন্মের ভক্তরা তাদের সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টে নারীবাদ এবং মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন লেখালেখিও করে যাচ্ছেন। জেরার্ড পিকের জার্সি নম্বর '৩' এর সাথেও গানের সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন ভক্তরা। মেলানি মোরা নামের একজন টুইটারে লিখেছেন- শাকিরার গানটির দৈর্ঘ্যও কাঁটায় কাঁটায় ৩ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডের।
শাকিরার গানের কথা আপাতদৃষ্টিতে খুব সূক্ষ্ণ কিছু না হলেও, শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে এটি। গানটির জনপ্রিয়তা, ইউটিউবে মাত্র ১৯ ঘণ্টায় ৩৮ মিলিয়ন ভিউই প্রমাণ করে যে একসময়ের জনপ্রিয় জুটি পিকে-শাকিরাকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল কত বেশি।
শাকিরার প্রতি পিকের বিশ্বাসঘাতকতা কলম্বিয়ান গায়িকার সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রভাব ফেলেছে। শুরু থেকেই বলা হচ্ছিল, পিকে-শাকিরার বিচ্ছেদের পেছনে তৃতীয় পক্ষের হাত রয়েছে। শাকিরার বিভিন্ন মন্তব্য ও গানের মধ্যেও বিষয়টি স্পষ্ট যে অন্য কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন পিকে; যদিও স্প্যানিশ ফুটবলার এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন এখনো।
তবে শাকিরার প্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্ট যে ধনীরাও সাধারণ মানুষের মতোই কষ্ট অনুভব করেন, বিচ্ছেদের পর দিনের পর দিন মানসিক যন্ত্রণায় কাটান। আর উদারতার চাইতে যেহেতু ঘৃণা প্রকাশ করাটাই সহজ, তাই শাকিরাও সেই পথই বেছে নিয়েছেন।
তবে এখানে ডেভ কুলিয়ারের কথা আবারও চলে আসে। 'ইউ অটা নো' গানের স্বঘোষিত প্রধান চরিত্র এই অভিনেতা কিন্তু অ্যালানিস মরিসেটের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে ডেভ বলেছিলেন, "আমার বোন যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিল, অ্যালানিস তার গিটারসমেত টরন্টো থেকে ডেট্রয়েটে উড়ে আসে এবং হাসপাতালে আমার বোনের পাশে বসে তাকে গান শোনায়। এতটাই ভালো মনের মানুষ ছিল সে।" কে জানে হয়তো জীবনের কোনো এক পর্যায়ে গিয়ে অ্যালানিস ও ডেভ আবারও একে অপরকে চাইবেন কিংবা চাইবেন না! তবে কিছু মানুষ থাকেই যারা পুনর্মিলনকে গ্রহণ করতে পারেন না, বরং একবার বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হলে সেটিই হৃদয়ে গেঁথে রাখেন এবং সুযোগ পেলে হয়তো প্রতিশোধও নেন!
সূত্র: এল পাইস