আর্ট কিউরেটর: শিল্পের যত্ন নেন, শিল্পীকে হারিয়ে যেতে দেন না
এ লেখার তিন চরিত্র শামসুল আলম হেলাল, রুক্সমিনি রিকভানা কিউ চৌধুরী এবং ওয়াকিলুর রহমান। তাদের পরিচয় নানা ক্ষেত্রে বিস্তৃত, তবে এখানে তারা আর্ট কিউরেটর।
রুক্সমিনি তিনজনের মধ্যে কনিষ্ঠ। তিনি ২০১৪ সালে শিল্পকলার ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন। হেলালের গুচ্ছ আলোকচিত্র লাভ স্টুডিও ২০১৩ সালের ছবিমেলায় প্রথম প্রদর্শিত হয়, দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে।
ওয়াকিল সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ; ১৯৬১ সালে জন্ম। তিনি বেইজিংয়ে পেইন্টিং নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮৮ সালে বার্লিনে চলে যান। সেখানে তিনি অসংখ্য প্রদর্শনীর সাক্ষী হন, সে সঙ্গে 'আর্ট ইন কনটেক্সট' নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান। ২০০৯ সাল থেকে তিনি পাকাপাকিভাবে ঢাকায় বসবাস করছেন এবং লালমাটিয়ায় কলাকেন্দ্র নামে একটি আর্ট স্পেস পরিচালনা করছেন।
কিউরেটর যা করেন
সাদা কথায়, আর্ট কিউরেটর হলেন শিল্পের তত্ত্বাবধায়ক, শিল্পের যত্ন নেন তারা। বিষয় নির্বাচন, শিল্পকর্ম সংগ্রহ ও প্রদর্শন—এসবই আগে তাদের প্রধান কাজ ছিল। তবে গত এক দশকে কিউরেটরের দায়িত্বে যুক্ত হয়েছে দর্শকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন।
ওয়াকিলুর রহমান বলছিলেন, 'কোনো একটি প্রদর্শনী যখন কিউরেশনের মধ্য দিয়ে যায় তখন দেখার নতুন ভঙ্গি যুক্ত হয়। শিল্পের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে কিউরেটর প্রয়োজনমতো নতুন উপকরণ সংযোজন করেন, যেমন শব্দ, চলচ্চিত্র, স্থিরচিত্র, স্থাপনা শিল্প, ভাষা, ডিভাইস, খেলা, অভিব্যক্তি বা পরিবেশনা শিল্প।'
তিনি আরও বলেন, 'অনেক সময় কিউরেটর শিল্পীকেও ভাবনা যোগান দেন। এটি ঘটে দীর্ঘ সময় ধরে। কিউরেটর এক বা একাধিক শিল্পীকে একত্র করেন এবং ভাবনাটি প্রকাশের উপায় খুঁজতে থাকেন। একই ভাবনা চিত্রকর্ম, স্থিরচিত্র বা পরিবেশনা শিল্প দিয়ে প্রকাশ করা যায়, তবে সবক্ষেত্রে সমান অনুভূতি প্রকাশিত হয় না। তাই বেশ নীরিক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।'
২০১০ সালে বিশ্বে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের রয়্যাল একাডেমি অব আর্টসে কিউরেশন পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে ওয়াকিল মনে করেন, শিল্পের ক্ষেত্র এখন এতটাই বিস্তৃত যে, অ্যাকাডেমির চৌহদ্দিতে একে আর বেঁধে রাখা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, 'প্রতিটি নতুন অভিজ্ঞতাই শিল্প হয়ে উঠতে পারে যদি তাকে শিল্পিতভাবে প্রদর্শন করা যায়।' কলাকেন্দ্রের পাঁচটি প্রদর্শনীর কথা তিনি উল্লেখ করলেন, যেগুলোর কোনো শিল্পীই কোথাও পড়াশোনা করেননি।
এর মধ্যে একজন যেমন ওয়াজউদ্দিন, পেশায় লেদ মেশিন মেকানিক। তিনি বিভিন্ন টুকরো কাগজ জোড়া দিয়ে বড় বড় ক্যানভাস তৈরি করেন। অথচ প্রদর্শনী, কিউরেশন বা বিক্রির বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই।
অথবা আরেকজন গৃহবধূ, যার স্বামী থাকেন ইতালিতে। সংসারের কাজ শেষে যে অবসর পান, তাতে তিনি ছবি আঁকেন।
সম্ভাবনা বড় সম্বল
সম্ভাবনার কোনো সীমা নেই—এটাই কিউরেটরের প্রধান সম্বল। দেখার চলমান অভিজ্ঞতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কিউরেটর নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করেন।
ওয়াকিল দেশে থিতু হওয়ার একটি বড় কারণ এ সম্ভাবনা। তিনি বলেন, 'পশ্চিমের দেশগুলো এর মধ্যেই সব গুছিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক কিছু গোছানো বাকি। এখানেই সম্ভাবনা উঁকি দেয় বারবার।'
এটা করতে গিয়ে কি কখনো কিউরেটর সীমা লঙ্ঘন করেন?
ওয়াকিলের উত্তর, 'যার সীমা নেই, তা লঙ্ঘনের প্রশ্ন আসে না। তবে কখনো মনে হতে পারে, যতটা সম্ভাবনা ছিল তার সবটা কিউরেটর মেলে ধরতে পারেননি। এটা তার মনোযোগহীনতা বা সময়স্বল্পতার কারণে হতে পারে। কখনো তহবিলের অভাবেও হয়।'
তাই কখনো কখনো কিউরেটরকে তহবিল সংগ্রহের কাজেও ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে এতসবের মধ্যেও আনন্দের মুহূর্ত আসে। ওয়াকিল বলেন, 'যখন দেখি একজন কিউরেটর পাঁচজন ভিন্ন জীবনাচার ও ভূগোলের মানুষকে একত্র করতে পেরেছেন, অথবা একজন শিল্পীকে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন, তখন সেটাই সাফল্য।'
ওয়াকিল জানান, ফাইন আর্টসে কিউরেশন নতুন হলেও সাহিত্য ও কবিতার ক্ষেত্রে এটি নতুন নয়।
তিনি বলেন, 'ধরা যাক, প্রবন্ধের নাম "পঞ্চাশের দশকের কবিতায় গ্রামীণ উপকরণ"—এটাও একধরনের কিউরেশন। এমনকি শিল্পীর অবচেতনকেও কিউরেটর প্রকাশিত করেন।'
তিনি উদাহরণ দেন, যদি কিউরেটর গত একশ বছরের শিল্পীদের আঁকা আকাশ নিয়ে প্রদর্শনী করতে চান। সমস্যা হলো, শিল্পীরা সরাসরি আকাশ আঁকেননি, বরং ল্যান্ডস্কেপ এঁকেছেন যেখানে আকাশ এসেছে জল, বৃক্ষের অনুষঙ্গ হিসেবে।
কিউরেটর যদি সেগুলো জড়ো করে প্রদর্শন করেন, দর্শক আকাশকে নতুনভাবে দেখতে পাবেন। এ নতুন উপস্থাপনাই কিউরেটরের সাফল্য। দর্শকের দেখার অভিজ্ঞতাকে বদলে দেওয়ার মধ্যেই তার গুরুত্ব নিহিত।
হারিয়ে যাওয়ার আগেই
শামসুল আলম হেলাল আলোকচিত্রের পাঠ নিয়েছেন দৃকের পাঠশালায়। অনেকদিন ধরে নিজের প্রদর্শনীর লে-আউট নিজেই করতেন। ছবিমেলার বিভিন্ন প্রদর্শনী দেখে তিনি চমৎকৃত হতেন।
২০১৬ সালে ঢাকা আর্ট সামিট চলাকালে তার পরিচয় হয় কিউরেটর ডানিয়েল বুমেনের সঙ্গে। ডানিয়েলের সঙ্গে আলাপের মাধ্যমে এবং পরবর্তীকালো সুইজারল্যান্ড সফরের অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝতে পারেন, একজন কিউরেটর কেবল সংগঠক নন, তিনি শিল্পকর্মের মধ্যে নতুন অর্থ সংযোজন করেন। এরপর থেকেই হেলাল কিউরেশনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
তিনি বলেন, 'একজন কিউরেটর শিল্পকর্মকে বোল্ড [শক্তিশালী বা সপ্রতিভ] করেন, দর্শক ও শিল্পীর বোঝাপড়া বৃদ্ধি করেন, স্পেসের সঙ্গে আর্টওয়ার্কের সম্পর্ক স্থাপন করেন।'
২০২২ সালের মার্চ মাসে হেলাল সুইস শিল্পী মারা জুস্টের সঙ্গে যৌথভাবে ছাপাখানা শীর্ষক একটি কর্মশালা ও প্রদর্শনী কিউরেট করেন। এর কিছুদিন পরে বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টস তাকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর কিউরেটর হওয়ার আমন্ত্রণ জানায়।
জিএমএমই করিমের তোলা চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ছবি নিয়ে 'র্যান্ডম হারভেস্ট' নামক প্রদর্শনীটি কিউরেট করার সময় হেলাল কোনো নেগেটিভ খুঁজে পাননি। তিনি শুধু প্রিন্ট করা ছবির অ্যালবাম পান, যেখানে ছবিগুলো ছিল মাত্র ২ ইঞ্চি বাই ২ ইঞ্চি আকারের।
প্রথমে তিনি স্থান, সময় ও বিষয়বস্তু বিবেচনায় ছবিগুলো নির্বাচন করেন। এরপর বড় আকারে প্রিন্ট করার জন্য ছবিগুলো আবার তোলা হয়। গ্যালারি স্পেসকে কয়েক ভাগে ভাগ করে কোথাও গুচ্ছছবি, কোথাও বড় করে একটিমাত্র ছবি প্রদর্শন করেন।
একটি দেওয়ালে ছবি ও টেক্সটের মাধ্যমে আলোকচিত্রীর পরিচিতি তুলে ধরেন। অন্য একটি দেওয়াল নির্বাচন করেন শুধু পঞ্চাশের দশকের ছবির জন্য। তিনি একটি ডার্করুমও তৈরি করেন, যেখানে অ্যানালগ পদ্ধতিতে ছবি প্রিন্ট করার প্রক্রিয়া দেখানো হয়।
হেলাল বলেন, 'কিউরেট করে আনন্দ পাই, দায়িত্ব থেকেও করি। অনেক প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পী কেবল ঠিকমতো উপস্থাপিত হন না বলে হারিয়ে যান। এর সঙ্গে সম্মানী পেলে নিজের কাজের সুবিধা হয়। নতুন কোনো আইডিয়া বাস্তবায়নে হাত দিতে পারি।'
ঠিক করলেন কিউরেটরই হবেন
ওয়াকিলুর রহমানকে মেন্টর মানেন রুক্সমিনি চৌধুরী। দিনাজপুর ও রাজশাহীতে তার বেড়ে ওঠা। মা-বাবা দুজনেই শিল্পী।
ও-লেভেল শেষ করার পর রুক্সমিনি আমেরিকা চলে যান। সেখানে বছরখানেক থাকার পর দেশে ফিরে তিনি ঢাকা চারুকলায় ভর্তি হন। আর্ট হিস্ট্রি পড়তে গিয়ে প্রাচীনকাল, মধ্যযুগ, আফ্রিকা, মিসরীয়, অ্যাবরিজিনাল ইত্যাদি বিভিন্ন সময় ও অঞ্চলের শিল্প সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন।
পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত গ্যালারিগুলোর প্রদর্শনী দেখতে যেতেন। ছবিমেলায় ছবি দেখা ছিল তার বিশেষ আনন্দের জায়গা। এর আয়োজন ছিল ভিন্নধর্মী এবং বিষয়ের বৈচিত্র্যও ছিল প্রশংসনীয়। ঢাকা আর্ট সেন্টারের প্রদর্শনীও তার ভালো লাগত।
সেন্টারের ট্রাস্টিদের একজন ওয়াকিলুর রহমান। তার কিউরেটেড প্রদর্শনী দেখে রুক্সমিনি ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ওয়াকিল তার আগ্রহ ও আন্তরিকতা দেখে তাকে ইন্টার্ন হিসেবে নিয়োগ দেন।
২০১২ সালে 'সেনসেস: ৭' নামক একটি প্রদর্শনীর কথা রুক্সমিনির মনে আছে। আর্ট সেন্টারকে ৭টি আলাদা স্পেসে ভাগ করে ৭টি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল। একটি স্পেস কিউরেট করেছিলেন নিসার হোসেন, যেখানে রিকশা, পোস্টার ও সিনেমা আর্টিস্টদের কাজ প্রদর্শিত হয়েছিল।
এ প্রদর্শনীতে জানা যায়, ১৯৬০-এর দশকে হিউম্যান ফিগার আঁকা অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল। পেইন্টাররা প্রতীকের মাধ্যমে ভালুক ও বাঘের ছবিতে সামাজিক বার্তা ফুটিয়ে তুলতেন (ভালুক কাঁথা সেলাচ্ছে বা বাঘ লাঠি হাতে চর দখলে যাচ্ছে)।
'অনলি গড ক্যান জাজ মি' নামক একটি আর্ট গ্রুপ 'মোর্ন' বা শোক নামক একটি প্রদর্শনী তৈরি করে। তারা ফাউন্ড অবজেক্ট, যেমন জুতা ব্যবহার করে প্রদর্শনী সাজিয়েছিল।
শিল্পী রনি আহমেদ সেমিনার রুমটিকে প্রদর্শনের জায়গা হিসেবে ব্যবহার করেন। ভিআইপি সংস্কৃতি ও ডায়াসের ভাবগম্ভীরতাকে ব্যঙ্গ করে তিনি প্রদর্শনী সাজান। আয়শা সুলতানা বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত শব্দ দিয়ে সাউন্ড আর্ট তৈরি করেন, যা একটি করুণ আবহ সৃষ্টি করে।
সবগুলো প্রদর্শনী প্রধান কিউরেটর একত্রিত করে একটি সুতায় গেঁথে নিয়েছিলেন। এটা দেখে রুক্সমিনি চমকে যান এবং স্থির করেন, তিনিও কিউরেটর হবেন।
প্রতিবাদের বদলে মুগ্ধতা
২০১৪ সাল। রুক্সমিনির জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ বছর। সেবার ঢাকা আর্ট সামিটের দ্বিতীয় আসর বসেছিল। এক বন্ধু বলেছিলেন, চল প্রতিবাদ করে আসি, সামিটে শিল্পচর্চার দেশীয় রীতিকে অবহেলা করা হচ্ছে। রুক্সমিনি বন্ধুর সঙ্গে চললেন। প্রদর্শনী ঘুরে দেখে মুগ্ধ হয়ে ফিরলেন। প্রতিবাদের ভাবনা কখন যে মাথা থেকে উড়ে গেছে বুঝতেও পারেননি। এরপর সামিট যতদিন চলেছে, ততদিন তিনি সারাদিন প্রদর্শনী দেখেছেন।
পাকিস্তানি শিল্পী সাজিয়া সিকান্দারের উপস্থাপনা তাকে অবাক করেছিল। একটি জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিল একটা মিনিয়েচার পেইন্টিং ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আবার জোড়া লেগে নতুন আরেকটা পেইন্টিং হয়ে যাচ্ছে, আবার ভাঙছে, আবার নতুন একটা হচ্ছে। রুক্সমিনি বলছিলেন, 'সেবার সামিটের একটা প্রদর্শনী থেকে আরেকটা প্রদর্শনী তারপর আরেকটা, এভাবে সবগুলো দেখে আমি একটি গল্প পেয়ে গেলাম আর আমার খুব ভালো লাগল। কিউরেটেড প্রদর্শনীর এটাই সবচেয়ে বড় মজা।'
ওই বছরই তিনি নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর পেয়ে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন—যারা আর্ট সামিট আয়োজন করে—তাদের কাছে সিভি পাঠান।
যথাসময়ে তাকে ইন্টারভিউতে ডাকা হয়। ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা রাজীব সামদানি তাকে জিজ্ঞেস করেন, আর্ট সামিটে কাজ করতে আগ্রহী হওয়ার কারণ কী? রুক্সমিনি সোজাসুজি উত্তর দিয়েছিলেন, 'আমি কিউরেটর হতে চাই।'
ফোর্থ ইয়ার ফাইনাল শেষ হলে রুক্সমিনি কিউরেটরিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে সামদানী ফাউন্ডেশনে যোগ দেন। ঢাকা আর্ট সামিটের চিফ কিউরেটর, বেলজিয়ান ডায়ানা ক্যাম্পবেল তখন ঢাকাতে ছিলেন। রুক্সমিনিকে জিজ্ঞেস করেন, কোন ধরনের আর্ট তোমার ভালো লাগে?
—ইনস্টলেশন বা স্থাপনা শিল্প।
—কেন?
—একটা স্পেসকে নতুন করে দেখার সুযোগ হয়।
ডায়ানা উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। পরের ১৫ দিন রুক্সমিনিকে তিনি ধরে ধরে কাজ শিখিয়েছেন। কীভাবে শিল্পী খুঁজে বের করতে হয়, শিল্পীর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের উপায়, কোন কিউরেটর কীরকম শিল্পীর সঙ্গে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ্য, কীভাবে কনসেপ্ট ডেভেলপ বা ব্যাখ্যা করা যায় বা শিল্পীকে কীভাবে অ্যাকনলেজ করতে হয় ইত্যাদি।
ডায়ানা তখন আরেকটি প্রশ্ন করেছিলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের শিল্পচর্চা সবচেয়ে কম হয়? রুক্সমিনি বলেছিলেন, পারফরমেন্স আর্ট। ডায়ানা সম্ভবত আগেই বিষয়টি ভেবে রেখেছিলেন, তিনিও একমত হলেন।
২০১৬ সালে ভারতের কোচি বিয়েনালে আর্ট মেডিয়েশন ওয়ার্কশপে অংশ নেন রুক্সমিনি। মেডিয়েশন হলো দর্শক ও শিল্পীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের উপায়। তিনি আরও জেনেছিলেন, বিপরীত প্রক্রিয়ায়ও দর্শককে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করা যায়।
যেমন একজন দর্শকের চোখ বেঁধে দেওয়া হলো, গাইড তাকে চলতে চলতে একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। শেষে যখন চোখ খুলে দেওয়া হলো, দর্শক দেখলেন আসলটির সঙ্গে এতক্ষণ ধরে মনে মনে আঁকা ছবিটি মিলছে না। এ সংঘর্ষ তাকে শিল্পটি মনে রাখতে ও বুঝতে বিশেষ সাহায্য করে।
২০১৭ সালে রুক্সমিনি প্রথম এককভাবে পাঁচজন বাংলাদেশি শিল্পীর একটি প্রদর্শনী কিউরেট করেন অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়। ওই প্রদর্শনীর নাম ছিল 'বিপর্যস্ত বাস্তবতা'।
সেদিন আসতে বাকি আছে
সামদানী ফাউন্ডেশনে যোগ দেওয়ার পর রুক্সমিনির প্রথম সামিট আয়োজন ২০১৬ সালে। সামিট মানে শিল্পী, যোগাযোগ, টকশো, প্রকাশনা, প্রদর্শনী উপকরণ, অতিথি আপ্যায়নসহ আরও অনেক কিছু। কিউরেটর ও সহযোগীরা সব কাজেই অংশ নিয়ে থাকেন।
রুক্সমিনি ভেবেছিলেন, ২০১৮ সালের আয়োজনে বোধহয় তিনি আর উৎসাহ পাবেন না, হয়তো একঘেয়ে লাগবে। কিন্তু বছরটি এসেছিল আরও নতুন এক্সাইটমেন্ট নিয়ে, কারণ নতুন সব ভাবনা ও নিরীক্ষা। এখনো প্রতিদিন, প্রতি আসরে রুক্সমিনি শিখে চলেছেন। কিউরেশন একটি সীমাহীন কার্যক্রম বলে এতে শেখার শেষ নেই।
২০২৩ সালের সামিটের থিম ছিল বন্যা। বন্যার শুরুতে যেমন চারদিক থমথমে হয়ে যায়, একটা ভীতিকর পরিস্থিতি। প্রদর্শনীর স্টার্টিং পয়েন্টেও সে ভাব সৃষ্টির প্রয়াস নিয়েছিলেন শিল্পী ও কিউরেটররা। ততদিনে রুক্সমিনি নিজেই কিউরেটর। সবগুলো প্রদর্শনী সবাইকে আকৃষ্ট নাও করতে পারে, কিন্তু নতুন কিছু ভাবনার যে প্রকাশ ঘটেছিল, তাতে সন্দেহ নেই।
রুক্সমিনি চৌধুরী এখন দেশের একমাত্র পেশাদার কিউরেটর। অন্যরা মুক্তজীবী—তাদের মধ্যে আছেন স্থপতি, আলোকচিত্রী, চারুশিল্পী, সমাজবিজ্ঞানী, সাহিত্যিক বা সাংবাদিক।
কিউরেশনকে এখনো পেশা হিসাবে নেওয়ার কথা ভাবা যাচ্ছে না বলে মনে করেন ওয়াকিলুর রহমান। কলাকেন্দ্রে অ্যানোনিমাস নামক কয়েকটি দলবদ্ধ প্রদর্শনী আয়োজন করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল নাম ধরে ছবি দেখার অভ্যাসকে চ্যালেঞ্জ করা, সে সঙ্গে ছবি দেখে শিল্পী চেনার রেওয়াজ চালু করা।
দৃক, বেঙ্গল গ্যালারি, বৃত্ত, বৃহত্ত্ব নতুন নতুন চেষ্টা জারি রেখেছে। শিল্পকলা একাডেমিও কিউরেশনে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছে। এ ধারাবাহিকতায় একসময় যখন কিউরেটেড প্রদর্শনী ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিউরেশন নামক নতুন বিভাগও চালু হবে। ওয়াকিল আরও মনে করেন, সে সময় আনতে হবে, এমনি এমনি আসবে না।
ছবি: সৌজন্যে