হতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটার, করেছেন এসি মেকানিকের কাজ, তার সিনেমাগুলোর আয় ২৫,০০০ কোটি রুপি
কিছু অভিনেতা হয়তো অল্প সময়ের জন্য রুপালি পর্দায় আসেন, কিন্তু দর্শকহৃদয়ে ছাপ রেখে যান আজীবনের জন্য। পর্দায় তারা হয়তো তেমন কথা বলেন না, কিন্তু চোখ দিয়েই রাজ্যের সব কথা সেরে ফেলেন। এই জাতেরই অভিনেতা ইরফান খান।
এই তারকা হতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটার, কিন্তু অর্থাভাবে সেই স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয়েছে। অভিনয়জীবনে সাফল্য পাওয়ার জন্যও সংগ্রাম করতে হয়েছে।
৩০ বছরেরও বেশি সময়ের ক্যারিয়ারে বেশ কয়েকটি হিট ও ব্লকবাস্টার সিনেমা উপহার দিয়েছেন ইরফান খান। শুধু বলিউডেই নয়, হলিউডেও নিজের জাত চিনিয়েছেন।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ব্রিটিশ ও আমেরিকান সিনেমাতেও কাজ করেছেন এই বলিউড তারকা। বিশ্ব চলচ্চিত্রেও অভিনয়ের জন্য সমাদৃত হয়েছেন।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার থেকে এশিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পর্যন্ত বহু পুরস্কার উঠেছে তার হাতে। ছিলেন বলিউডের অন্যতম সফল খান।
ইরফানের জন্ম ১৯৬৭ সালে, রাজস্থানের টঙ্ক-এ, এক মুসলিম পরিবারে। তার মা ছিলেন রাজবংশের মেয়ে, বাবা ব্যবসায়ী। ইরফান হতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটার, কিন্তু টাকার অভাবে সেই স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে বেছে নেন অভিনয়কে। টাকা না থাকায় তিনি টুর্নামেন্টের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারেননি।
এক সাক্ষাৎকারে ইরফান জানিয়েছিলেন, ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছা ছিল তার। ঘরোয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্ট সি কে নাইডু ট্রফিতে খেলার সুযোগও পেয়েছিলেন।
টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়াকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে ইরফান বলেন, 'আমি ক্রিকেট খেলতাম। ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলাম। আমি ছিলাম অলরাউন্ডার। জয়পুরে আমার দলে সবচেয়ে কমবয়সি ক্রিকেটার ছিলাম আমি। (ক্রিকেটে) ক্যারিয়ার করতে চেয়েছিলাম। খুব সম্ভব সি কে নাইডু টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার তখন টাকার টানাটানি ছিল। অন্য কারও কাছে যে টাকা চাইব, সে সাহসও পাইনি। সেদিনই ঠিক করে ফেলি, খেলাটা আমি চালিয়ে যেতে পারব না।'
অর্থকষ্ট ইরফানের পিছু লেগে ছিল অনেকদিন। এমনও সময়ও ছিল, যখন ৩০০ রুপি জোগাড় করাও কঠিন ছিল তার জন্য। অভিনয় শেখার জন্য ন্যাশনাল স্কুল অভ ড্রামায় (এনএসডি) ভর্তি হতে ৩০০ রুপি লাগত। কিন্তু তার কাছে সেই টাকাও ছিল না। শেষে টাকাটা দেন তার বোন।
তিনি বলেন, 'ন্যাশনাল স্কুল অভ ড্রামায় ভর্তি হতে ৩০০ রুপি লাগত। কিন্তু সে টাকা জোগাড় করাও আমার জন্য কঠিন ছিল। শেষপর্যন্ত আমার বোন টাকাটা জোগাড় করে দেয়।'
একসময় মেকানিক হিসেবেও কাজ করেছেন ইরফান। ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে আরেক বলিউড তারকা নাসিরুদ্দিন শাহ সিনেমা জগতে ইরফানের লড়াই ও 'অভিনয়ের পোকা' মাথায় কী করে ঢুকল, সে সম্পর্কে জানতে চান।
তখন ইরফান জানান, তিনি কারিগরি প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। ওই প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে জয়পুর থেকে মুম্বাই আসেন। তখনই একবার রাজেশ খান্নার বাড়িতে যান তার এসি (এয়ার-কন্ডিশনার) সারাতে।
মেকানিকের কাজ করতে করতে একসময় ইরফান বুঝতে পারেন, এ জীবন তার জন্য বড় একঘেয়ে। এরপরই অভিনয়ে আগ্রহ জন্মায় তার।
ন্যাশনাল স্কুল অভ ড্রামার মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরও টিভি অভিনেতা হিসেবে সংগ্রাম করতে হয়েছে ইরফানকে।
ইরফান খান প্রথম বড় সাফল্য পান ব্রিটিশ ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা আসিফ কাপাদিয়ার 'দ্য ওয়ারিয়র'-এর (২০০১) হাত ধরে। সিনেমাটি বাফটা পুরস্কার জেতে।
২০০৭ সাল নাগাদ ইরফান বলিউডে বড় তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান। অভিনেতা হিসেবে তিনি সবসময়ই নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসতেন।
২০০৮ সালেই দ্বিতীয় বড় সাফল্যের দেখা পেয়ে যান ইরফান। ড্যানি বয়েলের হিট ছবি 'স্লামডগ মিলিয়নিয়ার' ইরফানের তারকা খ্যাতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নবীন অভিনেতা ফ্রিডা পিন্টো ও দেব প্যাটেলকে রাতারাতি তারকা বানিয়ে দেয়।
'স্লামডগ মিলিয়নিয়ার'-এর সাফল্য ইরফানের জন্যও নতুন সুযোগের দরজা খুলে দেয়। ওই সিনেমার পর থেকে তিনি বড় প্রজেক্টে কাজ পেতে শুরু করেন।
বেশ কয়েকটি হলিউড ব্লকবাস্টার ও অস্কারজয়ী সিনেমায় অভিনয় করেছেন ইরফান খান। তার অভিনীত কয়েকটি আমেরিকান ছবি—'দ্য অ্যামেজিং স্পাইডারম্যান', 'স্লামডগ মিলিয়নেয়ার', 'লাইফ অব পাই', 'জুরাসিক ওয়ার্ল্ড' ইত্যাদি—প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার বা ২২ হাজার ৩৫০ কোটি রুপি আয় করেছে। এর সঙ্গে তার হিন্দি সিনেমাগুলোর আয় যোগ করলে ছবিগুলোর মোট আয় দাঁড়ায় ২৫ হাজার কোটি রুপি।
'জুরাসিক ওয়ার্ল্ড'-এর'প্রচারণার সময় ইরফান বলেছিলেন, ১৯৯৩ সালে যখন এ ফ্রাঞ্চাইজির প্রথম ছবি 'জুরাসিক পার্ক' মুক্তি পায়, তখন তিনি ছিলেন মুম্বাইয়ের এক উঠতি টিভি অভিনেতা। টিকিট কেটে ওই সিনেমা দেখার সামর্থ্য তার ছিল না।
এর প্রায় ২২ বছর পর তিনি সেই ফ্র্যাঞ্চাইজিরই একটি ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন। ছবিটি বিশ্বব্যাপী ১.৭ বিলিয়ন ডলার আয় করে। এর মাধ্যমে ইরফান হয়ে ওঠেন হলিউডের ছবিতে অভিনয় করা সবচেয়ে সফল ভারতীয় অভিনেতা।
বড় তারকা বনে গেলেও ইরফান মনে-প্রাণে ছিলেন অভিনেতা। তিনি অভিনয়টাই করতে চাইতেন অন্তর থেকে। তাই তো হলিউডের বড় প্রজেক্ট ছেড়ে দিয়ে ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আছে এমন ভারতীয় ছবিতে কাজ করেন।
২০১৫ সালে ইরফান রিডলি স্কটের 'দ্য মার্শিয়ান'-এ কাজ না করে দিল্লি ও কলকাতার প্রেক্ষাপটে তৈরি মিষ্টি প্রেমের গল্প 'পিকু'তে কাজ করেন।
ইরফান রিডলি স্কটের 'বডি অভ লাইজ' (২০০৮) ছবিও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে তার সবচেয়ে বড় আফসোস ছিল ক্রিস্টোফার নোলানের 'ইন্টারস্টেলার'-এ (২০১৪) কাজ করতে না পারা, কারণ ওই সময় তিনি 'দ্য লাঞ্চবক্স'-এর শুটিং করছিলেন।
ইরফান যখন মহাতারকা হওয়ার পথে, ঠিক তখনই, ২০১৮ সালের বসন্তে জানতে পারলেন তিনি নিউরোএন্ডোক্রাইন টিউমারে আক্রান্ত। তখন তার বয়স মাত্র পঞ্চাশের কোঠায়।
ক্যান্সারের সঙ্গে দুই বছর লড়াই করে অবশেষে ২০২০ সালের এপ্রিলে মাসে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ইরফান। তার সর্বশেষ ছবি 'আংরেজি মিডিয়াম' (২০২০)। ইরফানের ছেলে বাবিলও পিতার পথ ধরে অভিনয়ে এসেছেন।