ভাষাসৈনিক কালা চাঁদ বাবু: প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তুলেন যিনি
চট্টগ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অন্যতম কারিগর কালা চাঁদ বাবু। প্রকৃত নাম শ্রী কৃষ্ণগোপাল সেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে কালা চাঁদ বাবুর আবির্ভাব।
তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে প্রগতিশীলতার যে পত্তন হয়েছিল কালা চাঁদ বাবু ছিলেন তার অন্যতম নির্মাতা। ১৯৪৮ সালে তার প্রেরণায় দেওয়ানজী পুকুরপাড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় অগ্রণী সংঘ।
কালা চাঁদ বাবু অল্পবয়সে বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে যান এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ার দায়িত্ব পান। নন্দনকাননে গড়ে তোলেন যুবসংগঠন- শক্তিসংঘ। এ অঞ্চল ভাগ হওয়ার পর পূর্ববাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির বলয়ে দেখা দেয় টালমাটাল অবস্থা। সংস্কৃতি ও প্রগতিমনা বহুজন সাম্প্রদায়িক বিভক্তির কারণে চলে যান ভারতে।
দেশভাগের পর উত্তাল দিনগুলোতে ১৯৫০ সালে সেকালের যুব নেতা মাহবুব-উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে হরিখোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় পূর্ববঙ্গ সাংস্কৃতিক সম্মেলন। কলকাতা থেকে আসে গণসংগীত শিল্পী সলিল চৌধুরীর নেতৃত্বে গণনাট্য সংঘ। অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক বাতাবরণ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আহুত এ সম্মেলন বানচালের হুমকি দেয় মুসলীম লীগ। সম্মেলন স্থলের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার সার্বিক দায়িত্ব অর্পিত হয় কালা চাঁদ বাবুর ওপর। অগ্রণী সংঘ, শান্তি সংঘ ও চকবাজার নওজোয়ান ক্লাবের সর্বমোট ৬০০ সদস্যের স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগ্রেড গঠন করে পাঁচ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সম্মেলনকে সার্থক করে তোলেন কালা চাঁদ বাবু । মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে নন্দনকাননের সরভুজ মজুমদারের গ্যারেজে প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও কালা চাঁদ বাবু পালন করেন অনন্য ভূমিকা।
২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার আন্দোলনের পর চট্টগ্রামে যে ১৪ জনকে আটক করেছিলো সরকার, কালা চাঁদ বাবু তাদের অন্যতম। দীর্ঘ ১০ মাস কারান্তরালে থাকাবস্থায় একটানা ৪০ দিন অনশন ধর্মঘটের পর তিনি মুক্ত হন। ৬০ এর দশকে প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাসের পর আর্তমানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন কালা চাঁদ বাবু। নিজের তহবিল থেকে ১০০০ টাকা আর্থিক অনুদান দিয়ে সংঘের ১০ জন ছাত্রকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কালা চাঁদ বাবু ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুরে ধ্বজনগর যুব শিবিরের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী তাকে এ দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য এম কফিলউদ্দিন প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতারাও এখানে থাকতেন। '৭১ সালের ২৫ নভেম্বর ভারত সরকারের নির্দেশে চার দিনের মধ্যে বাঁশ দিয়ে একশ বেডের হাসপাতাল তৈরি করেন কালা চাঁদ বাবু, যা নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকার কর্তৃক প্রশংসিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উপ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন সুজাত আলী উদ্বোধন করেন।
শৈশব থেকে বার্ধক্যের সুদীর্ঘ জীবনে দেওয়ানজী পুকুরপাড়ে এবং আশেপাশে হিন্দু-মুসলিম সর্বস্তরের এলাকাবাসী সবাই কালা চাঁদ বাবুর আপনজন। '৭২ সাল পর্যন্ত এলাকার পরিবেশ ছিলো এমন, যেন সবাই একই ঘরের। স্বাধীনতা উত্তরকালে এলাকার যুবশক্তি গঠনের অভিপ্রায়ে পুনরায় উজ্জীবিত করেন অগ্রণী সংঘকে। গড়ে তোলেন পাঠাগার, প্রতিষ্ঠা করেন অগ্রণী সংগীত শিক্ষা কেন্দ্র। জনস্বার্থে ঐতিহ্যবাহী দেওয়ানজী পুকুরের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে পালন করেন অগ্রণী ভূমিকা। কালা চাঁদ বাবু বিশিষ্টজনদের সাথে নিয়ে এলাকার ঐতিহ্য রক্ষায় প্রায় সাড়ে সাত গন্ডা জমিতে স্থায়ী সার্বজনীন পূজামন্ডপ গড়ে তুলেন। গঠন করেন ট্রাস্টি বোর্ড। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে হানাদার পাকিস্তানিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত এলাকার শহীদদের স্মৃতিকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্যে শহীদ মিনার গড়ে তোলেন।
শ্রী কৃষ্ণ গোপাল সেনের (কালা চাঁদ) জন্ম চট্টগ্রামের রাউজান থানাধীন কোয়েপাড়া গ্রামে ১৯২৯ সালের ২৪ নভেম্বর। পিতা যোগেশ চন্দ্র সেন, মাতা স্বর্গীয়া সুহাসিনী সেন। ৯০ বছর বয়সে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর তিনি প্রয়াত হন।
টিবিএস ও নগদ-এর যৌথ উদ্যোগ