অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু: শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়
নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় সজীব গ্রুপের জুসের কারখানায় আগুন লেগে অনেকগুলো প্রাণ ঝরে গেল, এখন পর্যন্ত তাদের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। একইভাবে ঝরে গেছে তাজরিন ফ্যাশনে বহু প্রাণ, বহু মানুষ মারা গেছেন রানা প্লাজায়। অজস্র মারা গিয়েছেন বনানীতে, পুরনো ঢাকার লালবাগকে তো বলা হচ্ছে একটা বোমার গুদাম, যে কোনো মূহূর্তে যে কোনো সময়ে কিছু একটা সেখানে ঘটতে পারে। এগুলোকে তাই সংশ্লিষ্টরা আর দুর্ঘটনা বলছেন না, বলছেন কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড, যেখানে মালিকের মুনাফা বৃদ্ধি বা নিছক অবহেলায় শ্রমিকের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
এইসব ঘটনা যখন বিচ্ছিন্নভাবে ঘটে, আমরা তখন ভবন মালিকের শাস্তি চাই, কারখানা মালিকের শাস্তি চাই, গুদাম মালিকের শাস্তি চাই। কিন্তু শাস্তিটা তো চাই প্রতিহিংসা থেকে না, যাতে অন্য মালিকরা দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেন, কারো গাফিলতির কারণে যেন সাধারণ মানুষের প্রাণহানি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতেই আমরা শাস্তিটা দাবি করি। অথচ এই শাস্তিটা হবার কথা ছিল একটা স্বাভাবিক প্রকিয়া। বরং কথা হওয়ার কথা ছিল ঘটনাটাই যেন না ঘটতে পারে, সেটা নিয়ে।
কিন্তু বাংলাদেশে পরিস্থিতিটা সেই পর্যায়ে নাই। দুর্ঘটনার আশঙ্কাই এখন ঘটনা। প্রায় অধিকংশ ক্ষেত্রেই যেখানে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে, সেখানে এটা আগে কিংবা পরে ঘটারই কথা ছিল। কারখানা মালিক, ভবন মালিকের পেছনে আমরা বহু ছুটেছি, তাদের যথাযথ শাস্তি আদায় করা না গেলেও কিছুদিনের জন্য কারাগারে পাঠানো গেছে, কিছু টাকাপয়সাও তাদের খরচা হয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনার মিছিল বন্ধ হয়নি।
দুর্ঘটনা যখন বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা না, বরং প্রতিরোধযোগ্য ঘটনাকে অবহেলার জন্য ঘটতে দেওয়া হয়েছে, তখন আসলে অন্য একটা গুরুতর অপরাধীর অস্তিত্ব আমাদের শনাক্ত করতে হয়: কারা কারখানা মালিকদের এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটতে দিচ্ছেন? তারা কি কারখানা মালিকের চাইতে কম অপরাধী? তারা কি কারখানা মালিকের চাইতে বেশি অপরাধী নন?
২.
দোষী হলে সভ্য সমাজে এই উভয় তরফেরই শাস্তি হবার কথা। কিন্তু খেয়াল করুন, কারখানা মালিকের অপরাধ আর কারখানা মালিককে যাদের তদারক করার কথা, তার অপরাধ ভিন্ন। কারখানা মালিকের প্রধান চিন্তা হলো মুনাফাকে সর্বোচ্চ করা।
এই মুনাফাকে সর্বোচ্চ করার কয়েকটা উপায় আছে, যেমন শ্রমিকের মজুরি যথাসম্ভব কম দেওয়া, সরকারকে কর ফাঁকি দেওয়া, কর্মস্থলকে নিরাপদ করতে যে ব্যবস্থাগুলো করাটা বাধ্যতামূলক, সেগুলো না করা। মালিকরা পারলে সবগুলো উপায়ই অবলম্বন করবেন; রাষ্ট্রের দায় হলো এগুলো নিশ্চিত করা।
আলোচ্য ঘটনাটা দেখা যাক। প্রতিবেদন অনুযায়ী ছাদ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ২৫ জনকে। তারা ৫ম ও ষষ্ঠ তলা থেকে ছাদে উঠে আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন। ৪র্থ তলা থেকে সিঁড়ি বন্ধ ছিল বলে সেখানে মানুষগুলো পুড়ে মারা গিয়েছেন। অথচ, সিড়ির দরোজা কারখানাতে বন্ধ রাখার কথা না। আগুন লাগলে নিরাপদে বের হতে পারার জন্য প্রতিটা তলায় 'অগ্নিনর্গমন পথ' থাকার কথা। আগুনের ঝুঁকি এড়াবার জন্য কাজের জায়গাতে গুদাম থাকা নিষিদ্ধ থাকার কথা।আগুন লাগার ঝুঁকি আছে, এমন দাহ্য উপকরণ উৎপাদনের অংশ হলে বিশেষ অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা থাকার কথা।
এইসব কাজ করতে গেলে সন্দেহাতীতভাবেই কারখানা মালিককের স্থায়ী বিনিয়োগ যাবে বেড়ে। কারখানার আকার বড় করতে হবে, অগ্নিনির্বাপন যন্ত্রের জন্য নিরাপত্তার জন্য খরচাগুলোও বাড়বে। অন্যদিকে এই ব্যয়টা না করে 'সামলানো' গেলে মুনাফা বাড়বে। মালিক কোনটা করবে?
সকল সমাজেই মালিক মুনাফাটা বাড়াবারই চেষ্টা করে। কোনো রকম চাপ ছাড়া নিজে থেকে মালিকরা উদ্যোগ হয়ে কারখানাকে নিরাপদ করার চেষ্টা করেছেন, এমন উদাহরণ জগতে বিরল। সভ্য সমাজ বলতে আমরা যা বুঝি, সেখানে শ্রমিকদের এবং তাদের সাথে মিলে অন্যদের আন্দোলন সংগ্রাম করেই এই নিরাপদ কর্মপরিবেশকে আদায় করতে হয়েছে।
স্মরণীয়, আজ থেকে একশোরও বেশি বছর আগে নিউইয়র্কের ট্রায়াঙ্গল সোয়েটার ফ্যাক্টরির আগুনে ১৪৬ জন শ্রমিক পুড়ে মারা গিয়েছিলেন। মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল দরোজাগুলো বন্ধ থাকায় আগুনের সময়ে শ্রমিকরা কারখানা থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি।
নিউইয়র্কের ওই ভয়াবহ ঘটনায় দুর্বল আইনের কারণে মালিক সামান্য জরিমানা দিয়ে রেহাই পেয়ে যান। কিন্তু এর অভিঘাতে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শ্রমিকদের কর্মস্থলের নিরাপত্তা ও বাঁচার মতো মজুরির দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু হয়, অন্যদিকে এই নির্মাম মৃত্যুদৃশ্যে নাগরিকদের মাঝেও নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবিটি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। এরপর থেকে কারখানা মালিকদের বিরোধিতা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে ধীরে ধীরে কর্মস্থলের নিরাপত্তার নিশ্চিত করার জন্য বহু রকম আইন তৈরি হওয়া শুরু হয়।
৩.
বাংলাদেশের প্রশ্নে বললে খুব সোজাভাষাতেই বলা যায়, কর্মস্থল নিরাপদ করতে এখানে আইনের তেমন কোনো অভাব নেই। কিন্তু শ্রম আইন বাস্তবায়ন হতে পারে দুভাবে। একদিকে শ্রমিকদের সংগঠন, যারা আইন বাস্তবায়নের জন্য চাপ প্রয়োগ করবে। বাংলাদেশের আইন বরং শ্রমিক সংগঠনগুলোর গড়ে ওঠাকে খুব কঠিন বা অসম্ভব প্রায় করে তুলেছে। অন্যদিকে, শ্রম আইন কার্যকর করার আইনসঙ্গত দায় সরকারের। তাদের অনেকগুলো দপ্তর, অধিদপ্তর আছে, মন্ত্রণালয় আছে যাদের দেখভাল করার কথা কারখানা ভবন স্থাপত্যগত দিক দিয়ে নিরাপদ কি না, সেখানে আগুন বা অন্য কোনো দুর্ঘটনার ঝুঁকি রোধ করার বন্দোবস্ত যথাযথভাবে আছে কি না, বিপদের মূহূর্তে দ্রুত বেরিয়ে আসার পথ আছে কি না এইসব।
এগুলো যথাযথভাবে পালন হচ্ছে কি না, তা নিয়মিত তদারক করাটাই তাদের কাজ, সেজন্য তারা রাষ্ট্রের তরফ থেকে বেতন পান।
মালিকদের আইন মানতে যারা বাধ্য করবে, তারা যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলে মালিকরা তাদের মুনাফাকে সর্বোচ্চ করার অবারিত সুবিধাটি কাজে লাগাবে সানন্দে। এবং এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, এই শ্রম আইন যাদের বাস্তবায়ন করার কথা, তারা বিনা লাভে, কোনো রকম লোভের বশবর্তী না হয়েই ঘুমিয়ে থাকেন। বরং কারখানাগুলো পরিদর্শন যে একটা অত্যন্ত লোভনীয় চাকরি, সেটা খুবই পরিষ্কার।
কথার কথা হিসেবে বলা: কারখানা মালিক যদি বছরে এক কোটি টাকা বাড়তি খরচ বাঁচাতে পারেন একটা মাঝারি আকারের কারখানায় শ্রমিকদের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়ে, তাহলে বছরে লাখ তিরিশেক খরচ করতে তিনি কি আপত্তি করবেন? এই সহজ অর্থনীতির নিয়মেই এইভাবে শত শত কারখানা একেকটা মৃত্যুকূপে পরিণত হয়ে মালিকদের মুনাফা বৃদ্ধি করছে, পরিদর্শকদের, তাদের উপরস্থদের পকেটও ভারি করছে।
এখানে অন্য একটি প্রসঙ্গও বিবেচ্য। এ ধরনের জবাবদিহিতার আওতায় শুধু ছোট চাকুরেকে আনলে কোনো লাভ হবে না। কারখানা নিরাপদ কি না, সেটা নিশ্চিত করতে পরিদর্শনের কাজে একেবারে নিচের সারিতে যারা আছেন, তারা দুর্নীতি পরায়ন হন বা না হন, তারা তাদের পদস্থদের হুকুম বরদার হয়ে থাকতেই বাধ্য হন। রাজনৈতিক কিংবা আর্থিক যোগাযোগের সূত্রে তাদের কাছে তাদের উর্ধ্বতনদের যে হুকুম আসে, সেটা তারা পালন করতে একরকম বাধ্যই।
অন্যদিকে, কারখানা মালিকের মতোই নিচের সারির পরিদর্শকদেরও একটা ঝুঁকি নেওয়ার একটা রীতিমতো অর্থনৈতিক হিসাব আছে, চাকরি যাবার ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা তার বাড়বে যদি বেতনের চাইতে ঘুষের পরিমাণ বহুগুণ আকর্ষণীয় হয়। কিন্তু 'আকর্ষণীয়' বেতনে যারা চাকরিটা করেন, সেই উচ্চপদস্থদের চাকরিকে ঝুঁকির মাঝে ফেলে দেখুন, এই ধরনের দুর্নীতি বহুগুণ কমে যাবে। কারখানাগুলো বহুলাংশে নিরাপদ হয়ে উঠবে। তারা তাদের নিজেদের স্বার্থে কারখানার মালিকদের বাধ্য করবেন কারখানাকে শ্রমিকের জন্য নিরাপদ করতে।
এ কারণেই যে কোনো দুর্ঘটনায় এই পরিদর্শকদের দেখনদারি করাটা যাদের দায়িত্ব, তাদেরকেই কঠোরতম জবাবদিহিতার আওতায় আনাটা জরুরি। রানা প্লাজা, তাজরিন বা ট্যাম্পাকোর ঘটনায় আমরা দেখব, প্রতিটা কারখানা অনুপযুক্ত ছিল, সেখানে যথাযথ শ্রম পরিবেশ ছিল না। শ্রমিকদের জীবন নিয়ে মালিকরা বলা চলে জুয়া খেলেছেন। কিন্তু এটা দেখার দায়িত্ব যাদের ছিল, সেই শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কিংবা মাঠের কাজটি যাদের করার কথা, সেই কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বলা চলে বিনা জবাবদিহিতায় এই প্রতিষ্ঠান দুটি দিব্যি হাসিখুশি কাল কাটিয়েছে।
৪.
আবারও মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কারখানা মালিকরা ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করবেন, এটা তাদের অধিকাংশের বৈশিষ্ট্য। কারণ শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গেলে একটা বাড়তি বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। এটা তিনি করতে আগ্রহী না। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো তার নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা। ফলে কারখানা মালিককে এই কাজে বাধ্য করাটা রাষ্ট্রের কর্তব্য। এই কর্তব্যের প্রশ্নে কোনো অবহেলা বা ছাড়ের প্রশ্ন নেই। রাষ্ট্রের তরফ থেকে যারা এই কাজটি করার জন্য বেতন পান, সেই শ্রম সচিবের ও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের দায়িত্ব পালনরত অতিরিক্ত সচিব জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য।
কারখানা মালিকের শাস্তি একটা আইনি, পুলিশি ও বিচারিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে দীর্ঘসূত্রিতায় তারা বেঁচে যান এই কারণে যে, কারখানা মালিকের কাছ থেকে বহুরকম উপঢৌকন পাবার সুবাদে এই বিচার প্রক্রিয়াকে আর কখনোই যথাযথভাবে চালু করা হয় না। বরং সময় এসেছে এই পরিদর্শক, মহাপরিদর্শক, অতিপরিদর্শক ইত্যাদি কাতারভুক্তদের জবাবদিতিহার আওতায় আনা।
দুর্ঘটনাগুলো যে জায়গাতে ঘটেছে, সেখানকার নিচ থেকে উচ্চ পর্যন্ত কর্মকর্তারা যথাযথ প্রতিবেদন দিয়েছিলেন কি না, তারা যথাযথভাবে দুর্ঘটনার আশঙ্কা তুলে ধরে থাকলে তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কি না, পরিদর্শকদের প্রদত্ত প্রতিবেদনের সাথে মাঠের বাস্তবতার মিল আছে কি না—এইসব বিষয়েই তদন্ত হোক। শুধু একটা ঘটনা প্রসঙ্গে তদন্ত না, এটাকে একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হিসেবেই রাখা হোক। যে কোনো অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড ঘটলেই মালিকের শাস্তির পাশাপাশি এই অব্যবস্থা চলতে দেওয়ার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত শাস্তির আওতায় আনা গেলে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড ঘটতে দেওয়াটাই তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।
একটা প্রশ্ন আসতেই পারে, দায় স্বীকার বা শাস্তির প্রসঙ্গে শ্রমমন্ত্রীর বদলে শ্রম সচিবের কথা কেন বলা হচ্ছে? উত্তরটা তো আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সম্প্রতি দিয়েছেন, তিনি স্বীকার করেছেন আমলাতন্ত্রের সামনে শাসক দলের রাজনীতিবিদরা এখন ম্লান। কাজেই দেশটা যারা চালান, তাদেরকেই জবাবদিহিতার আওতায় আনার পদ্ধতি নিয়েই এখানে ভেবেছি। যারা 'গণতন্ত্রের অলঙ্কারস্বরূপ' আছেন, তাদের নিয়ে অযথা সময় নষ্ট করা কেন!
-
লেখক: প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও রাজনীতিক