আফগান বিপর্যয়ে আমেরিকা বিশ্ব রাজনীতিতে আগামী দশকের মধ্যেই গুরুত্বহীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে!
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনুপস্থিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনুপস্থিত। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি হয় ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে। ১ লক্ষ ৪০ হাজার নিরীহ মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু এবং তারপরও প্রজন্মের পর প্রজন্ম পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহতা বহন করতে হয়েছে ওই অঞ্চলের মানুষকে।
জাপান যুদ্ধে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরও রুজভেল্ট পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের আগে হিটলারের জার্মানির পতন ঘটে। সেখানকার এক রাজপ্রাসাদে রুজভেল্ট, স্তালিন ও চার্চিল বৈঠকে মিলিত হন। সবাই রুজভেল্টকে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।
পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ভেতর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর রাজনৈতিক অঙ্গনে মোড়ল হিসেবে আবির্ভূত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি পরেই শুরু হয় কোরিয়ান যুদ্ধ; এরপর দীর্ঘস্থায়ী ভিয়েতনাম যুদ্ধ। তারপরে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফগান যুদ্ধ।
প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে মার্কিনিরা কখনোই অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে নাই। সর্বশেষ আফগান থেকে মার্কিনিদের খালি হাতে দেশত্যাগের সাথে ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম থেকে পরাজিত হওয়ার মিল পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাশাপাশি দুটি মার্কিন সামরিক হেলিকপ্টারের ছবি দেখা গেছে। যার একটি ভিয়েতনামের সাইগন থেকে ফিরে যাওয়ার, অন্যটি আফগানের কাবুল থেকে ফিরে যাওয়ার। কী অদ্ভূত সাদৃশ্য। ইতিহাস এভাবেই ফিরে আসে।
১৯৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামি সরকারের পতন রোধকল্পে সৈন্য পাঠানোর মধ্য দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সূত্রপাত করে। তাতে শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জয়ী হতে পারেনি। ১৯৭৫ সালে সাম্যবাদী শাসনের অধীনে দক্ষিণ ও উত্তর দুই ভিয়েতনাম একত্রিত হয়। ১৯৭৬ সালে সরকারিভাবে ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নামধারণ করে। এই যুদ্ধে প্রায় ৩২ লক্ষ ভিয়েতনামি মারা যান। এর সঙ্গে আরও প্রায় ১০ থেকে ১৫ লক্ষ লাওস ও ক্যাম্বোডীয় জাতির লোক নিহত হন। মার্কিনিদের প্রায় ৫৮ হাজার সেনা নিহত হন। এছাড়াও আহত ও পঙ্গু হন তিন লাখ মার্কিন সেনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এত মার্কিন সেনাকে জীবন দিতে হয়নি।
দীর্ঘ ২০ বছর আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনী অবস্থান করে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। এই সময়ে বহু আফগান নাগরিককে তাদের সহযোগী বানিয়েছে। মার্কিনিরা বিভিন্ন সহযোগিতা নিয়েছে তাদের কাছ থেকে। মার্কিনিদের 'এক্সজিট প্লানে' আফগানের ঐ সহায়তাকারি মানুষদের তারা যুক্ত করেনি। ফলে হাজারও আফগানের ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা মারাত্মক আকার ধারণ করে। প্রাণ ভয়ে হাজারও আফগান নাগরিকের বিমানবন্দরে ছুটে যাওয়ার দৃশ্য আমরা দেখেছি। জীবন বাঁচানোর নিদারুণ ও অবিশ্বাস্য চেষ্টা বিশ্ব মানবের বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছে। শত শত মানুষের বিমানে উঠার চেষ্টা এবং চলতে শুরু করা বিমানের সঙ্গে দৌড়ানো বা উড়ন্ত বিমানের ডানা বা চাকা থেকে মানুষের খসে পড়ার দৃশ্য মানুষকে কাঁদিয়েছে।
বিমানে চাকায় মানুষের দেহবাশেষের পরিচয় আজ প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ মাধ্যমে। হতভাগ্য ১৭ বছরের তরুণ একজন ফুটবলার। মার্কিন প্রশাসন বলছে, 'যতটা সময় পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, তার অনেক আগেই কাবুলের পতন হয়েছে।' কীসের ভিত্তিতে 'সময়ের ধারণা' করা হয়েছিল বা এটা কোনো গোয়েন্দা ব্যর্থতা কি না, সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
ভিয়েতনামে মার্কিনিদের পরাজয়ের পর ভিয়েতনাম সাগরে অবস্থান করা যুদ্ধজাহাজে করে প্রচুর ভিয়েতনামিকে ভিয়েতনাম ত্যাগ করতে সহায়তা করা হয়েছিল। প্রায় ২ লক্ষ ভিয়েতনামিকে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার আফগানে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। মার্কিন কৌশলের বদল ঘটিয়ে এবার তারা অন্য দেশগুলোতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা আফগানদের আশ্রয় দেবার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ একটি অতি জনঘনত্বপূর্ণ দেশ হওয়া স্বত্ত্বেও মার্কিন প্রশাসন চেষ্টা করেছে এখানে আফগান শরণার্থি পাঠাতে। প্রায় ১৫ লক্ষ রোহিঙ্গার ভারে আক্রান্ত এই দেশে মার্কিন প্রস্তাব অনেকটা 'মড়ার ওপর খাড়ার আঘাতের' মতো। বাংলাদেশ মার্কিন প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে।
আমাদের রোহিঙ্গার বিষয়েও আরও কঠোর সিদ্ধান্তে যাওয়া উচিত ছিল। রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবতা দেখাতে গিয়ে আজ সেটা গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে।
মার্কিন অর্থনীতির সঙ্গে যুদ্ধের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে প্রায় আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। আফগানে এই পরিমাণ অর্থ ব্যয় হওয়া স্বত্ত্বেও ২০ বছরের এই যুদ্ধ মার্কিন অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে। মার্কিন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান, অস্ত্র ব্যবসায়ী সকলেই এই টাকার ভাগ নিয়েছে এবং তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় উৎপাদন ব্যবস্থাকে সহায়তা করেছে।
এ রকমের একাধিক যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরাজিত হওয়া স্বত্ত্বেও বিশ্ব অঙ্গনে দেশটি এ ধরনের যুদ্ধ অব্যাহত রাখবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজর এখন চীনের ওপর। যে কারণে অনেকের ধারণা, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের অন্যতম কারণ হচ্ছে, দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে নতুন উত্তেজনা ছড়ানো। যা দেশটিকে এই অঞ্চলে আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান কিংবা সামরিক অভিযানকে সহায়তা করবে। ইতোমধ্যে জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে কৌশলগত নিরাপত্তা জোট কোয়াড গঠন করছে। এই নিরাপত্তা জোটের প্রধান লক্ষ্য দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণ।
দক্ষিণ চীন সাগরের জলসীমা নিয়ে ভিয়েতনাম ও চীনের মধ্যে সংকট দীর্ঘদিনের। ভিয়েতনাম এক সময় চীনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধে চীনাদের সহযোগিতা ছাড়া মার্কিনিদের পরাজিত করা সম্ভব ছিল না। সেই ভিয়েতনামিরা এখন মার্কিনিদের অনেক কাছের। চীনাদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরের জলসীমা নিয়ে।
ভিয়েতনামের অর্থনীতি এখন বহুলাংশে মার্কিনিদের ওপর নির্ভরশীল। টেক্সটাইল শিল্পসহ বহু শিল্পপণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম রপ্তানি করছে। চীনাদের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে ভিয়েতনাম। মার্কিন বাজারে তাদের প্রবেশকে অনেক বেশি সহজসাধ্য করে দিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। কারণ, সেই দক্ষিণ চীন সাগর।
আন্তর্জাতিক পরিসরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি মার্কিনিরা ভালো চোখে দেখছে না। দীর্ঘকাল চীনা পণ্যের ওপর নির্ভরশীল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের আগমনকে প্রতিহত করার লক্ষ্যেই অগ্রসরমান। সেই বিবেচনায় উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রেসিডেন্ট একাধিক বৈঠক করেছেন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। যদিও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমঝোতা এখনো কার্যকর হয়নি।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ইসরাইলের সঙ্গে যে সংকট বিরাজমান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘকাল ধরে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক নানা প্রক্রিয়ার সেই সংকটকে মোটামুটিভাবে ইসরাইলে অনুকূল একটা পরিবেশে নিয়ে যেতে পেরেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ইসরাইলের সঙ্গে বিভিন্ন রকমের সহযোগিতা চুক্তির বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। ইসরাইলকে এখনো স্বীকৃতি দেয়নি সৌদি আরব। তবে ইসরাইলের সঙ্গে অপর দেশগুলোর সম্পর্কোন্নয়নে সৌদি আরব সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে অব্যাহতভাবে বাণিজ্য অবরোধ সৃষ্টি করে তার অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে; যেমন তারা করেছে কিউবাতে। চীন সেখানে বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসছে বিকল্প অর্থনীতি নিয়ে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই গ্রহণ করবে না। চীন বেশ কিছু দেশের সঙ্গে ইতোমধ্যে দ্বিপাক্ষিক মুদ্রা ব্যবস্থায় বাণিজ্য শুরু করেছে। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে দ্বিপাক্ষিক মুদ্রায় পরিশোধিত হচ্ছে। চেষ্টা ছিল ভারতের সঙ্গেও এই ব্যবস্থার প্রচলন করার। কিন্তু ভারতের উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সংকট তা একটু পিছিয়ে দিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব রাজনীতিতে আগামী দশকের মধ্যেই একটি গুরুত্বহীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলে অনেকের ধারণা। যেমনটি হয়েছে এককালের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের।
-
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক