আমি এখনও নিঃশ্বাস নিতে পারছি
গত বছর আজকের ঠিক একদিন [দুই দিন] আগে- ২৫শে মে যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিস শহরে শ্বাসরুদ্ধ করে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যা করেছিল এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ। এর পরপরই দেশটির বিভিন্ন শহরে বিশাল প্রতিবাদ মিছিল হচ্ছিল, ছড়িয়ে পড়ছিল সহিংস দাঙ্গা।
তেমনি একটি মিছিলে একটি কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরীর মুখাবরণীর ওপরে দেখেছিলাম লেখা ক'টি- 'আমরা এখনও নিঃশ্বাস নিতে পারছি'। যতটা বলা, তারচেয়েও না বলা কথা অনেক বেশি ছিল ঐ একটি বাক্যে। সারাদিন ধরে কথাটি আমার করোটি আর হৃদয়ে 'জলের মতো ঘুরে ঘুরে' কথা কইতে থাকল।
মনে হলো, ঐ ছোট্ট বাক্যটির সত্যতা অত্যন্ত সুগভীর এবং বিরাট এক বাস্তবতার এটি একটি সুতীব্র ঘোষণা। এই কিশোরী এখনও হয়তো নিঃশ্বাস নিতে পারছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি বিভাজিত দেশে, একটি বর্ণবাদী সমাজে, এবং শেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী একটি ক্রমপ্রসরমান জনগোষ্ঠীর প্রেক্ষিতে এমন সময় ও ঘটনাপ্রবাহের শিকার কি এ মেয়েটি হতে পারে না, যেখানে সেও হত্যার মুখোমুখি হয়ে জর্জ ফ্লয়েডের মতো বলবে, 'আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না?'
'আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না'- এই কথাটি যে কতবার উচ্চারিত হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর অবদমনে শেতাঙ্গ পুলিশী বর্বরতার মুহূর্তে। আজ থেকে মাত্র সাত বছর আগে ২০১৪ সালে যখন নিউইয়র্কের পুলিশ এরিক গার্নার নামক কৃষ্ণাঙ্গ তরুঙের টুঁটি চেপে ধরে তাকে হত্যা করেছিল, তখনও সে বলেছিল, 'আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।'
১৯৯২ সালে লজ এ্যঞ্জেলসে পুলিশি বর্বরতার শিকার রডনি কিং একই কথা বলেছিলেন। ১৯৬৩ সালে কৃষ্ণাঙ্গ অধিকারের স্বপক্ষের শান্তি মিছিলে আক্রমণের সময়েও আক্রান্তেরা একইভাবে তাঁদের আর্তি প্রকাশ করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর অবদমনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি এতদিনেও তেমন কিছু একটা বদলায়নি। 'আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না'- এ কথাটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর জীবন-বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিনের অবদমন আর অত্যাচারের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পুরো কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর স্বাধীন নিঃশ্বাসের জায়গাটি ক্রমান্বয়ে সীমিত হয়ে আসছিল, সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন বাহিনীর চরম নিপীড়নে তা আজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আট বছর একজন কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপ্রধান দেশ শাসন করলেও অবস্থার তেমন কোনো তারতম্য ঘটেনি।
দিনের পর দিন দারিদ্র্য, বঞ্চনা, বৈষম্য ও অসমতায় যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের জীবন আজ প্রান্তিকতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর্থ-সামাজিক দিক থেকে বিচার করা যাক। শেতাঙ্গদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার যেখানে ৮ শতাংশ, কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে তা ২০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে শেতাঙ্গদের গড়পড়তা আয় যেখানে ৬৯ হাজার ডলার, কৃষ্ণাঙ্গদের তা ৪০ হাজার ডলার। একজন শেতাঙ্গ ব্যক্তি যেখানে ৭৯ বছর বাঁচার প্রত্যাশা করতে পারেন, একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু সেখানে ৭৪ বছর। আজকের করোনা সঙ্কটকালেও যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি সংক্রমিত মানুষের ২৫ শতাংশ একজন কৃষ্ণাঙ্গ, যদিও জনসংখ্যায় তাদের অনুপাত মাত্র ১২ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর অবদমনের ক্ষেত্রে আরও পাঁচটি কথা উল্লেখ্য।
এক. ঐতিহাসিকভাবেই দেখা গেছে যে, কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবদমনে আইনরক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্য মূল হোতা বা মূল নায়ক, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। নামমাত্র কোনো শাস্তি পেয়ে তারা পার পেয়ে যায়। বর্তমান ঘটনায়ও তার ব্যত্যয় ঘটবে বলে আশা করা যায়নি।
দুই. সব ঘটনায়ই দেখা গেছে যে, যখন একজন পুলিশ কর্মকর্তা অত্যাচারের আসল হোতা হিসেবে কাজ করেন, তখন অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তা মূল হোতার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। অথচ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের আইনের আওতায় আনা হয় না।
তিন. কৃষ্ণাঙ্গ অবদমনের মূল শিকার হন সাধারণ দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী। সে ক্ষেত্রে বিত্তবান ও ক্ষমতাবান কৃষ্ণাঙ্গেরা অত্যাচারিত জনগোষ্ঠীর পক্ষে মুখের কথা ভিন্ন কার্যকর ব্যবস্থায় এগিয়ে আসেন না। আট বছর শাসনামলে প্রেসিডেন্ট ওবামা অতি সতর্কতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেছেন তাঁর কৃষ্ণাঙ্গ আত্মসত্তাকে সযত্নে সুপ্ত রাখতে, যাতে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে চিহ্নিত না হন এবং কৃষ্ণাঙ্গদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিহিত না হন। ফলে না কৃষ্ণাঙ্গদের কোনো উপকার হয়েছে, না যুক্তরাষ্ট্রের চিরায়ত বর্ণ ও জাতিভেদ প্রশ্নের কোনো মীমাংসা হয়েছে। তার বদলে নিজের কৃষ্ণাঙ্গত্বকে পরিষ্কারভাবে স্বীকার করে তিনি যদি এই প্রশ্নগুলোকে সরাসরিভাবে মোকাবেলা করতেন, তাতে পরিপূর্ণ সফল না হলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতিহাসে স্মর্তব্য হতেন।
চার. যুক্তরাষ্ট্রের এক ক্ষমতাবান এক বিরাট জনগোষ্ঠী বর্ণবাদী এবং তারা কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। সত্যিকার অর্থে, এ জনগোষ্ঠীর কথাবার্তায় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের সুর প্রায়ই প্রচ্ছন্নভাবে উঠে আসে। সে অবস্থায় এটা ভাবা বাতুলতা যে, যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদের সঙ্কটকে একটি সংবেদনশীল, সহানুভূতিশীল গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ ও জাতিভেদের মূল সমস্যার মীমাংসার জন্যে আন্তরিক কোনো প্রচেষ্টা নেওয়া হবে। কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করা হবে অনেক, দোষারোপ করা হবে আরও, কথা বলা হবে অফুরন্ত; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না।
পাঁচ. বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই বলছেন, সংহিসতা গ্রহণযোগ্য নয় এবং সহিংসতা কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। দুটোই সত্যি। কিন্তু মনে রাখা দরকার, সাধারণ মানুষ শান্তিপ্রিয় এবং প্রথমেই তারা সহিংসতার পথ বেছে নেয় না। মানুষ অবদমন ও অত্যাচার যখন দিনের পর দিন চলতে থাকে, যখন তারা ক্রমাগতভাবে দারিদ্র্য, বঞ্চনা, ও বৈষম্যের শিকার হয়, যখন সব পন্থা অবলম্বন করেও ন্যায্য বিচার তারা পায় না এবং যখন তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়, তখনই তারা সহিংস হয়ে ওঠে। এ কথাটা যেন আমরা ভুলে না যাই।
শেষের কথা বলি। এ জাতীয় ঘটনায় আমাদের মতো বাদামী গাত্রবর্ণীয় মানুষেরা নিশ্চুপ থাকি, নির্লিপ্ত থাকি, গা বাঁচিয়ে চলি। নিজেকেই বলি, 'আজ রাতে ওরা তাদের জন্যে এলে, কাল প্রভাতে ওরা আমার জন্যে আসবে।' যুক্তরাষ্ট্রের বিত্তবান, ক্ষমতাবান অকৃষ্ণাঙ্গ গোষ্ঠীকে বলি, 'দিনে দিনে বাড়িয়ছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ।' 'আজ না হয় কাল, কাল না হয় পরশু।' অস্বীকার তারা করতে পারবে না, 'এ দায়ভাগে তারা সমান অংশীদার?'
-
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক; নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক - লেখাটি তার ফেসবুক পোস্ট (২৬ মে ২০২১) থেকে নেওয়া