আশ্রয়ণ যখন ব্যতিক্রমী উদ্যোগে অনন্য হয়ে ওঠে
ফ্যান্টাসির বাইরে জীবনঘনিষ্ঠতার জন্য লেখক হিসেবে সুখ্যাতি রয়েছে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের। 'পদ্মা নদীর মাঝি' উপন্যাসে তিনি হোসেন মিয়া চরিত্রের হাত ধরে সৃষ্টি করেছেন ময়নাদ্বীপ। শ্বাপদসংকুল ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে চেনা মানুষগুলোকে সেই দ্বীপে একত্র করে হোসেন মিয়া।
জীবন সাহিত্যের মলাটের সুন্দরতম গল্প নয়। তবু কাকতালীয়ভাবে, জীবনকালে দেখা সুন্দরতম একটি গদ্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য হলো প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো করতে গিয়ে।
ফরিদপুর জেলার ছোট আলফাডাঙ্গা উপজেলায় ৬০০টি ঘর এনে দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। জুন মাস নাগাদ শেষ হয়ে যাবে ৫০০ ঘরের কাজ। মাটি ভরাট ও স্থিতিকরণহেতু বাকি কাজ জুলাই মাস নাগাদ শেষ হবে বলে আশা করা যায়। সবগুলো ঘর করতে গিয়ে উপজেলা প্রশাসন উদ্ধার করেছে পঞ্চাশ একরের অধিক বেহাত হয়ে যাওয়া সরকারি খাস জমি।
যা হোক, মোট ৬০০ ঘরের মধ্যে ২০০ ঘর নিয়ে গোপালপুর ইউনিয়নের চরকাতলাসুর গ্রামে একইস্থানে গড়ে তোলা হচ্ছে প্রজেক্ট 'স্বপ্ননগর'। ৭০০ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যেই থাকবে আরও ৫০টি ঘর। এই ২৫০ ঘর নির্মাণ করা আমাদের দায়িত্ব, এটা হয়তো সবাই করে, ঘর তৈরি বাদে বাকি সব কর্মযজ্ঞে আমরা সাহিত্যকথার ছোটখাট চরিত্র।
একদম শুরুর দিকে মোটামুটি হত্যা হুমকি মাথায় নিয়ে ৩১ একর খাস জমি উদ্ধার। এই কাজ খুব কঠিন। ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন, মানুষ তার বাপের সম্পত্তি হারানোর ব্যাথার চেয়ে বাপ হারানোর ব্যথা দ্রুত ভুলে যায়। আমার মনে হয়েছে, কেউ কোনোভাবে সরকারি সম্পত্তি হস্তগত করলে তা বাপের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করে।
এই উদ্ধারকৃত সম্পত্তির ঝোপঝাড় কেটে ঘরের কাজ শুরু। এখানে ঘর করলেও সে অর্থে জায়গাটি প্রতিষ্ঠিত গ্রোথ সেন্টার নয়। আর এখানেই আসলে কাজ করার সুযোগ। ২০০টি পরিবারের মধ্যে ১৭০টির মতো মুসলিম পরিবারের জন্য প্রয়োজন মসজিদ-ঈদগাঁ । ৩০টি সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারের জন্য প্রয়োজন প্রার্থনাগৃহ। আশেপাশে নেই কোনো উচ্চ বিদ্যালয়; কিছু দূরে রয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাজার ৩ কিলোমিটার দূরে। নতুন বাসিন্দাদের দরকার নাগরিক সুযোগ সুবিধা। শিশুদের দরকার খেলার মাঠ। তাই প্রয়োজন সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা।
তবে এটি পরিকল্পনা বা ভবিষ্যতচিন্তা হিসেবে সীমাবদ্ধ নেই। ইতোমধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে ১৬ শতাংশ জমিজুড়ে মসজিদ ও ঈদগাঁ। ৮ শতাংশ জমির বাউন্ডারি রেখে নির্মাণ করা হয়েছে মন্দির। ১.৫ একর জমিজুড়ে স্থাপন করা হয়েছে বাজার। চান্দিনা ভিটির কাজ চলছে। ২ একর জমি রাখা হয়েছে স্কুল ও খেলার মাঠের জন্য। এগুলোর ভূমি উন্নয়নের কাজ চলমান।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার নিমিত্ত কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য ৮ শতাংশ জায়গা আলাদা করে ভূমি উন্নয়ন করে রাখা হয়েছে। এটি কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয় হওয়ায় কিছুটা সময় লাগবে হয়তো। অদূরে ৯ একর জমিজুড়ে কাজ শুরু হচ্ছে নানা প্রজাতির দেশীয় গাছপালা রোপনের মাধ্যমে ইকোপার্ক তৈরি। সবকিছুর পর যেখানে যেতে হবে, সেই কবর স্থানের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ শতাংশ জমি।
কমিউনিটি ক্লিনিক বাদে বাকি সব কিছুর কাজ শেষ হবে জুলাই মাসের মধ্যেই। ২৮টি গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ শেষ হবে ১৫ জুনের মধ্যে। নির্মাণকৃত সবগুলো ঘরের বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে এ মাসের মধ্যেই। ঘর বাদে বাদবাকি সব পরিকল্পনার অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান।
স্বপ্ননগরের আলাদা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বেদখলকৃত খাস জমির প্রাচুর্য্য থাকায় ২০০টি পরিবারের মধ্যে ১৫০ পরিবার পাচ্ছে তিন শতাংশ করে জমি। বাকিরাও ঘরসহ দুই শতাংশ জমির পাশে পাবে ব্যবহারযোগ্য কমন স্পেস, যাতে তারা করে নেবে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলের ক্ষুদ্র খামার ও অল্প বিস্তর মৌসুমী সবজীর চাষবাস করার সুযোগ।
প্রকল্প ঘিরে থাকছে প্রশস্ত চলাচলের রাস্তা। আপাতদৃষ্টিতে উপজেলা পর্যায় হতে যা যা করা সম্ভব, সবই শেষ হবে জুলাই মাসের মধ্যে। মধুমতির নদীভাঙনের কবলে নিঃস্ব হওয়া কিংবা স্থায়ী ঠিকানাহীন মানুষগুলোর ঠাঁই হচ্ছে এ স্বপ্ননগরে।
-
লেখক: উপজেলা নির্বাহী অফিসার, আলফাডাঙ্গা, ফরিদপুর