ঐতিহাসিক মিত্রতা ছাপিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি-আমিরাত দ্বৈরথ
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির অন্যতম প্রধান দুই শক্তি সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এবং সৌদি আরবের দহরম মহরমে সম্প্রতি ভাটা পড়তে দেখা গেছে। এ ভাটা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতেই নয়, বিশ্ব রাজনীতিতেও যথেষ্ট প্রভাব রাখবে বলে ধারণা করা যায়। আধুনিক বিশ্বের শিল্পের চাকা এখনও পর্যন্ত তেলের উপর নির্ভরশীল, যার প্রধান সরবরাহকারী মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল। তাই বিশ্ব রাজনীতিতে এই অঞ্চলের গুরুত্ব বরাবরই বেশি। সেখানে যখন গতানুগতিক মিত্রতা, শত্রুতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা নিরপেক্ষতার ধারায় পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করবে, সেই হাওয়া বিশ্ব রাজনীতিকেও নিশ্চিতভাবেই ছুঁয়ে যাবে। যার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি এবং ইউএই'এর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি নির্ধারণের একটি প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে সেই ঐতিহাসিককাল থেকেই। তবে বিভিন্ন বিষয়ে ছোটোখাট মতভেদ থাকলেও তা কখনো এবারের মত স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেয়নি দুই দেশের নীতি নির্ধারকরা। বিশ্বে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন ওপেক'এর টেবিলে বসে তেলের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে রাখা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে মতভেদ এবার পুরো আলোচনাকেই ভেস্তে দিয়েছে। ফলে ওপেকভুক্ত ১৩টি দেশের এবং ওপেকপ্লাস ২৩টি দেশের মধ্যকার আলোচনাও বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি পরবর্তী আলোচনার তারিখও জানানো হয়নি। আর এ কারণেই বিশ্ববাজারে তেলের দাম বিগত ছয় বছরের মধ্যে উঠেছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
করোনা মহামারির কারণে জ্বালানি তেলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ওপেকের সব দেশের মতামতের ভিত্তিতেই গেলো বছর এক চুক্তিতে কোটাভিত্তিক তেল উৎপাদনে সম্মত হয় দেশগুলো। তবে সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা এ বছরের শেষে। কিন্তু সৌদি আরব এবং রাশিয়া চায় পুরোনো সেই চুক্তির মেয়াদ আগামী বছর অর্থাৎ, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করতে। অন্যদিকে, ইউএই চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর বিপক্ষে। তারা সর্বোচ্চ ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ বর্ধনে মত দিয়েছে। কারণ আবুধাবি জ্বলানি সেক্টরে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে বিগত বছরগুলোয়, সে অনুযায়ী ফলাফল পেতে উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। নতুবা তারা পড়তে পারে আর্থিক ক্ষতিতে। মূলত এখান থেকেই সৌদি-আমিরাত মুখোমুখি সমস্যার সূত্রপাত।
আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা মহামারির সূচনা থেকে এখন পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ মাসে কোটাভিত্তিক জ্বালানি তেলের নিয়ন্ত্রিত উৎপাদনে ইউএই'এর উৎপাদন স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১৮ শতাংশ কম হয়েছে। অপরদিকে এ সময়ের মধ্যে সৌদি আরব উৎপাদন কমিয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। তাই স্বাভাবিকভাবেই সৌদির উপর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দীর্ঘ সময়ের চাপা থাকা ক্ষোভ এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে বের হয়ে এসেছে। সৌদির তুলনায় আয়তনে, সমরে, শক্তিতে, অর্থনীতিতে অনেক ছোট হওয়া সত্ত্বেও ইউএই এবার মুখোমুখিভাবেই সৌদি আরবের সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
প্রশ্ন হতে পারে, সব সময় সৌদি নীতি মেনে চলা বাধ্যগত রাষ্ট্রের ভূমিকা থেকে হঠাৎই কেনো এমন ফুঁসে উঠলো ইউএই? এই প্রশ্নের উত্তর সহজেই পাওয়া যাবে আরব আমিরাতের বিগত দুই/তিন দশকের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি বিশ্লেষণ করলেই।
মাত্র ৩২,৩০০ বর্গমাইলে প্রায় ১ কোটি জনসংখ্যা নিয়েই আরব আমিরাত বিশ্ব অর্থনীতিতে ৩৪তম অবস্থানে আছে। আয়তনে এবং জনসংখ্যা বেশ কম হলেও দেশটি অর্থনৈতিকভাবে বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। প্রথম কোনো আরব দেশ হিসেবে গেলো বছর ইউএই মঙ্গল অভিযানের খাতায় নাম লিখিয়েছে। দেশকে বিভিন্নভাবে প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত করানো এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে উপসাগরীয় অঞ্চলের 'বিজনেস হাব'-এ পরিণত হয়েছে দেশটি।
বিবিসি'র এক সাক্ষাৎকারে আমিরাতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আনোয়ার গারগাস বলেছিলেন, "আমরা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ হতে চাই। বিশ্বে ভূমিকা রাখতে চাই। সেই লক্ষ্য অর্জনে ঝুঁকি নিতে হলেও আমরা তা নেব।"
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সেই বক্তব্যের প্রতিফলনই হয়ত সৌদি নীতিকে সরাসরি এভাবে প্রত্যাখ্যান করা। গত বছর আরব বিশ্বের তোয়াক্কা না করে চিরশত্রু ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে আমিরাত। ২০১৫ সাল থেকে সৌদি আরবের সঙ্গে একযোগে ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের বিপক্ষে যে অভিযান চালিয়ে আসছিলো দেশটি সম্প্রতি সেখান থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে, যা সৌদি আরবকে বেশ হতাশ করেছে। সব মিলিয়ে দেশটি জাতীয় স্বার্থ এবং আরব বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ এক শক্তি হয়ে ওঠার দৌড়কেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
আমিরাতের বিগত দুই দশকের কূটনৈতিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, দেশটি বিশ্ব শান্তি স্থাপনের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বিভিন্ন রণক্ষেত্রে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইথিওপিয়া, কসোভো, সোমালিয়া সহ বেশ কয়েকটি যুদ্ধ বিধস্ত এবং সংকটাপন্ন দেশে আমিরাতের সৈন্য ও স্বেচ্ছাসেবী দল বেশ বড় ভূমিকা রেখেছে। আফগানিস্তানে স্কুল, মসজিদসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণেও দেশটির ভূমিকা অনন্য। কিন্তু আমিরাতের এইসব ভূমিকার কথা খুব কমই জানে বিশ্ববাসী। এছাড়া পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোতে ইসলামী জঙ্গিবাদ দমনেও দেশটি যথেষ্ট তৎপর। এ অঞ্চলে ছোট ছোট বেশকিছু সামরিক ঘাঁটিও স্থাপন করেছে ইউএই।
পূর্বে আমিরাতের অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে জ্বালানি তেলের উপর নির্ভরশীল থাকলেও তা এখন কমিয়ে আনতে চাচ্ছেন বর্তমান যুবরাজ শেখ মোহম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। তার নেতৃত্বে আমিরাত অস্ত্র ক্রয়ে মনোযোগী হয়েছে। সেই সঙ্গে তেল ব্যতীত অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ইসলামিক ঐতিহ্য এবং অবকাঠামোগত আকর্ষণের ফলে পর্যটন শিল্পের বেশ প্রসার ঘটেছে দেশটিতে। উপসাগরীয় অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। মোটকথা দেশটি আরব বিশ্ব তথা বিশ্ব রাজনীতিতে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে চায়।
অন্যদিকে আবার এ অঞ্চলের আরেক শক্তি সৌদি আরবের লক্ষ্যও ঠিক আরব আমিরাতের মতই। অর্থনীতিতে, সমরে, শক্তিতে আরব বিশ্বের সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠা এবং বিশ্ব রাজনীতিতে অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। এখানেই হয়েছে প্রধান সমস্যা। একই ভূখন্ডে যেমন দুই রাজা রাজত্ব করতে পারেনা, ঠিক তেমনই আরব বিশ্বের সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার দৌড়ে সৌদি ও ইউএই একে অপরের সামনে হয়ে উঠতে শুরু করেছে প্রতিদ্বন্দ্বী।
প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলস্বরূপ চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে সৌদি সরকার কর্তৃক বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে তাদের আঞ্চলিক সদরদপ্তর ২০২৪ সালের ভেতর সৌদি আরবে স্থানান্তর করার আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। অন্যথায়, সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে কোন চুক্তি তাদের সঙ্গে করা হবে না। যেহেতু ওই এলাকার বিজনেস হাব আবুধাবি, তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যে সৌদি আরব আমিরাতকে বিপাকে ফেলতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া ইসরায়েলের শুল্ক সুবিধা পায় এমন উপসাগরীয় দেশ থেকে পণ্য ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা এবং আবুধাবিতে বিমান চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়ে ইউএই'এর পর্যটন শিল্পেও বেশ আঘাত হেনেছে সৌদি আরব।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, দুই দেশের লক্ষ্য একই হওয়ার কারণেই ঐতিহাসিক মিত্রতা থেকে এখন সময়ের প্রয়োজনে তারা হয়ে উঠছে প্রতিদ্বন্দ্বী। পূর্বে দুই দেশের আগ্রহের জায়গায় মিল থাকতে দেখা গেলেও এখন সেই মেলবন্ধনের ছন্দপতন হতে দেখা যাচ্ছে। এখানে উদাহরণ হিসেবে ইয়েমেনের হুথিদের বিরুদ্ধে সৌদি-ইউএই যৌথ অভিযানের কথা বলা যেতে পারে। ২০১৫ সালে দুই দেশ উদ্যমের সঙ্গে ইয়েমেনে অভিযান শুরু করে। কিন্তু বছর দুয়েক আগে আমিরাত তার সেনা সংখ্যার বড় অংশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
কিন্তু প্রত্যাহার করে নিয়েছে কেনো? ধারণা করা হয়, প্রত্যাহারের কারণ হলো ইরান। মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া প্রধান দেশ ইরান ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়ে থাকে। আর ইরানকে ক্ষেপাতে চায় না আরব আমিরাত। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণে বোঝা যায় ইরানকে কিছু সমীহ করেই চলার নীতি গ্রহণ করেছে আমিরাত। কারণ আরব উপদ্বীপের বিজনেস হাব হরমুজ প্রণালী দিয়ে ইরান ও আরব আমিরাত সংযুক্ত। তাই যেকোনো ইস্যুতে ইরানে অস্থিরতা কিংবা দেশটির সঙ্গে বড় ধরণের মনোমালিন্য আমিরাতের জন্য ভালো হবে না বলেই ধরে নেয়া যেতে পারে।
অবশ্য ঠিক একই যুক্তি সৌদি-আমিরাত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়। তাই বিশ্লেষকগণ মনে করেন, সম্প্রতি জ্বালানি তেল উৎপাদন নিয়ে ওপেক ও ওপেক প্লাস দেশগুলোর মধ্যে যে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে তা দ্রুতই সমাধান হয়ে যেতে পারে। কারণ সম্প্রতি সৌদি যুবরাজ বিন সালমানের রাজনৈতিক আচরণে নমনীয়তা দেখা গেছে। তিনি ইরানকে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে সম্বোধন করে পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। অর্থাৎ চিরশত্রু শিয়া রাষ্ট্রের প্রতি নমনীয়তায় বিন সালমান যেহেতু পিছপা হননি, তাই ধরে নেয়া যেতে পারে আমিরাতের সঙ্গেও দ্রুতই মনমালিন্য ঘোচানোর পদক্ষেপ নিতে পারেন তিনি।
অন্যদিকে, আমিরাত আরব বিশ্বের অন্যতম শক্তিতে পরিণত হয়ে উঠেলও সৌদি আরব থেকে শক্তিতে অনেক পিছিয়ে আছে নিঃসন্দেহে। তাই সৌদিকে একেবারে তোয়াক্কা না করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যে দেশটির ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে না সেটাও ইউএই ঠিকই বোঝে।
তাই ধারণা করা যায়, ওপেকের এই মত বিরোধকে খুব গভীরে যেতে না দেয়ায় উভয় দেশই এগিয়ে আসবে। তবে এখানে কোনো কিছুই একেবারে নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও সৌদি-আমিরাতের যুবরাজদ্বয়ের বন্ধুত্বে ফাটল এবং দুই দেশের মাঝে একই আসন অর্জনের প্রতিযোগিতা সম্পূর্ণরূপেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আর এই প্রতিযোগিতা আরব বিশ্ব তথা বিশ্ব রাজনীতিকে যথেষ্ট প্রভাবিত করবে বলেই ধরে নেয়া যেতে পারে।
- লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
- ইমেইল: [email protected]