'ওরা কারা চলেছে আমাদের আগে আগে, ওরা কারা? ওরাও উদ্বাস্তু'
স্কুলশিক্ষিকা সালমা ফোনে বলল, 'আপা জানেন, পুরোনো ঢাকা এলাকায় আমাদের পাড়াটা খালি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বিল্ডিং থেকেই তিন-চারটি পরিবার চলে গেছে। পাড়ার আরও বাড়িতে টু-লেট ঝুলছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে আপা।' সালমার কথা শুনে এবং পত্রপত্রিকায় মানুষের শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার ছবি দেখে বুকটা হুহু করে উঠছে। স্মৃতিতে ভেসে এলো ১৯৭১ সাল।
মুুক্তিযুদ্ধের সময় একদিন ভোররাতে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম আমাদের বাড়িওয়ালা খালু আব্বাকে ফিসফিস করে ডেকে বলছেন, তিনি তারপুরো পরিবার নিয়ে দেশের বাড়ি কুমিল্লা চলে যাচ্ছেন। আব্বা যেন তার বাড়িটা দেখে রাখেন। বড় বড় মেয়ে নিয়ে ওনারা আর ঢাকায় থাকতে পারছেন না। আমি পাড়ায় চুনিদের বাড়িতে খেলতে যেতাম, দেখলাম, ওরাও বাক্স প্যাটরা বেঁধে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রাতে আর্মি আসতে পারে- এই আতংকে পাশের বাড়ির রাণী মাসীরা যখন চলে গিয়েছিল্রন, তখন তাদের চুলায় ভাতের হাড়িতে ভাত রান্না হচ্ছিল। আম্মা সেই ভাত চুলা থেকে নামিয়েছিলেন, সে কথা আমার এখনো মনে আছে।এইভাবে প্রায় সপ্তাহখানেকের মধ্যে আমাদের পুরো পাড়া খালি হয়ে গেল। শুধু আমরা চার-পাঁচটি পরিবার থেকে গেলাম। আমার সব বন্ধু চলে গেল পাড়া ছেড়ে। যাবার আগে সবাই বলে গিয়েছিল, বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। তবে সবার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।
সেসময় আমরা যারা ঢাকা শহরে ছিলাম, তারা জানি, ঠিক এভাবেই বাড়িগুলো খালি হয়ে যাচ্ছিল। তখন মানুষ চলে যাচ্ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভয়ে, এখন চলে যাচ্ছে অভাব অনটনের কারণে, বেকার হয়ে। সে সময় ফাঁকা বাড়িগুলোতে আর টু-লেট নোটিশ ঝুলেনি, এখন ঝুলছে। তবে অনুভূতিটা ছিল অনেকটা একইরকম। সবাই সবার কাজের জায়গা ছেড়ে, বাচ্চাদের স্কুল-কলেজ বাদ দিয়ে, পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছিল একটু নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের জন্য।
ঢাকা ছেড়ে মানুষের চলে যাওয়া দেখে খুব বিপর্যস্ত বোধ করছি। নিজেদের টিকে থাকা নিয়েও অনেক কিছু মনে হচ্ছে। আরও কিছুদিন পর কি আমাদের অবস্থাও এ রকম হবে? আমাদের সংসার খরচ, সন্তানের পড়াশোনা, বাড়িভাড়া, বিল, গাড়িভাড়া, ওষুধ, বাবা-মায়ের খরচ- সব নির্ভর করে চাকরির বেতনের ওপর। এই বেতন বন্ধ হলে বা কমে গেলে কীভাবে চলবে সবার?
অচিন্তকুমার সেনগুপ্তের 'উদ্বাস্তু' কবিতাটি বারবার মনে পড়ছে। আমাদের এই জীবনের সঙ্গে যেন মিলে যাচ্ছে। 'উদ্বাস্তু' কবিতার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন; কিন্তু মূল সুর একই। বাবা তার সন্তানদের এবং স্ত্রীকে তাড়া দিচ্ছেন। সব বাক্স প্যাটরা বেঁধে নিতে বলছেন তাড়াতাড়ি করে। ভোর হওয়ার আগেই রওনা দিতে হবে পুরোনো জায়গা ছেড়ে, নতুন গন্তব্যের দিকে। স্ত্রীকে বলছেন, ঘর ল্যাপার দরকার নাই; গরুগুলোকে বাধারও দরকার নাই। সবগুলোকে ছেড়ে দাও, ওরাও চলে যাক আমাদের মতো, যেদিকে দু'চোখ যায়।
ঘুম মোড়ানো চোখে সন্তান জানতে চাইছে, বাবা আমরা যাচ্ছি কোথায়? বাবা বললেন, জানি না। যেখানে যাচ্ছি, সেখানে কী আছে? বাবা বললেন, সব আছে। অনেক আছে, অঢেল আছে, কত আশা আছে, কত হাসি, কত গান আছে। এখানে কিছুই নাই, যেখানে যাচ্ছি আমরা, সেখানেই সব আছে। সেটাই আমাদের নিজের দেশ। নতুন দেশের নতুন জিনিস; মানুষ নয়, জিনিস। সে নতুন জিনিসের নতুন নাম উদ্বাত্তু।
সেই ছায়া-সুনিবিড় গ্রাম ছেড়ে যে মানুষগুলো একদিন শুধুমাত্র জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে এই কংক্রিটের শহরে এসেছিলেন এবং প্রায় সবাই যুদ্ধ করে একটা আয়ের পথ আর মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছিলেন, সেই মানুষগুলোই আজ পরাজিত সৈনিকের মতো গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন।
মনে প্রশ্ন জাগে, এরা অথবা এদের সন্তানরা কি গ্রামে ফিরে গিয়ে টিকে থাকতে পারবেন? যে জীবন একদিন তারা পেছনে ফেলে চলে এসেছিলেন, সেই জীবন কি তাদের ফিরিয়ে নেবে? শহর থেকে কপর্দকহীন হয়ে গ্রামে গেলে কি আশ্রয় জুটবে? তাহলে আমাদের প্রায় ১০ লাখ অভিবাসী শ্রমিক যখন কাজ হারিয়ে শূন্য হাতে দেশে ফিরে এসেছেন, তাদেরকে কেন নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে থাকতে হচ্ছে?
ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ কীট, নেইকো ভালোবাসা, নেইকো স্নেহ- এই ইটের শহরে কীট হয়ে পড়ে থাকারও একটা নেশা আছে। সেই নেশাটা আয়ের নেশা, চকচকে জীবনের নেশা, উন্নত পড়াশোনা, স্বাস্থ্য সুবিধার নেশা। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষগুলো নগরের কীট হিসেবেই বেঁচে থাকার জীবনকে বেছে নিয়েছিল। আমার বাবাকে দেখেছি অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ঢাকা শহরে সেটেল হয়েছিলেন সেই ষাটের দশকে। জীবনে বহুবার বহু দুর্যোগে ভেবেছেন, এই শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাবেন। কিন্তু সন্তানকে মানুষ করার ইচ্ছা তাকে যেতে দেয়নি। শেষ বয়সে গিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন, তাও পারেননি। দায়িত্ব পালন করতে করতেই শেষ সময় হাজির হয়ে গেল। এইভাবেই কোনো না কোনো নেশা মানুষকে টেনে রাখে নাগরিক জীবনে।
যেমন সেদিন সাদেক ফোনে বলল, 'খালা, আমরা প্রতি রোজার ঈদ আর কোরবানি ঈদে বাড়ি যাই বাবা মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে। এইবার রোজার ঈদে যাই নাই। এখন যাচ্ছি। তবে এই যাওয়া ঈদের যাওয়া নয়, ঢাকা ছেড়ে একদম চলে যাওয়া। আমরা আর ঢাকায় ফিরে আসতে পারব না। বহু কষ্ট করে যে কাজটা যোগাড় করে ১০-১২ বছর টিকে ছিলাম, সেই কাজটাও চলে গেল। শুধু ভাবছি বাচ্চাগুলোর কথা। গ্রামীণ জীবনে, স্কুলে ওরা কি মানিয়ে নিতে পারবে? খালা, দোয়া করবেন।'
আজ এতগুলো বছর পর করোনার কারণে কাজকর্ম হারিয়ে, বেকার হয়ে চলে যেতে হচ্ছে মানুষকে গ্রামে। মানুষ গ্রাম থেকে একটু একটু এই শহরে এসে ভীড় করেছিল পড়াশোনা, জীবিকা অর্জন, উন্নত জীবন ও নাগরিক সুবিধাদি পাওয়ার জন্য।
বাংলাদেশ গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক দেশ বলে পরিচিত হলেও গত কয়েক বছরে খুব দ্রুত নগরায়ন হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল ৬৮ লাখ। এরপর ২০১৮ সালে জনসংখ্যা বেড়ে ১ কোটি ৭০ লাখ ছাড়িয়েছে (জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেকটাস)। এ থেকেই নগরবিদরা ধারণা করেছিলেন, শহরের জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে ২০৪৭ সাল নাগাদ দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ ভাগ শহরেই বাস করবে। সেইসঙ্গে তারা এও আশংকা করেছিলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলাফল হতে পারে খুব ভয়াবহ এবং চ্যালেঞ্জিং। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য নগরায়ন দরকার। কিন্তু যখন এটা খুব দ্রুত ও পরিকল্পনা ছাড়াই ঘটে, তখনই সেটা চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়।
গ্রামীণ জীবনকে পেছনে ফেলে মানুষ কি শুধু শহরের চাকচিক্যের আকর্ষণে শহরে ছুটে এসেছিল? জনসংখ্যা বৃদ্ধি, গ্রামীণ মানুষের ভূমিহীন অবস্থা, বেকারত্ব, একটার পর একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন, যথাযথ শিক্ষা-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার অভাবে লোকজন দলে দলে ঢাকায় এবং অন্যান্য শহরে এসে ভীড় করেছে। রাজধানী ঢাকাতে নগরায়ন ও কাজকর্মের ব্যবস্থাপনাটা অপরিকল্পিত হওয়ায়, এখানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ বস্তিতে বা পথেঘাটে এবং দারিদ্র সীমার নিচে বাস করছে।
নগরায়নের গ্রোথটা সার্বিক উন্নয়নের জন্য যথোপযুক্ত ছিল না বলে অধিকাংশ মানুষের জীবনযাপন খুব কষ্টের। অনেকদিন ধরে শহরে থাকলেও অর্থনীতিতে এবং সামাজিক ব্যবস্থায় এদের প্রবেশাধিকার খুব সামান্য। আর সেইকারণেই আমাদের অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছে, এর ভার বহণ করতে হচ্ছে শহরে যুদ্ধ করে টিকে থাকা এইসব পরিবারকে। চাকরি, ব্যবসা- সব হারিয়ে শহরে আসা মানুষগুলো আবার ফিরতে শুরু করেছে গ্রামে। ঢাকায় আজ তাদের নেই কোনো আশ্রয়; নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। তাই সাদেক যাওয়ার আগে বলল, 'ঢাকা আর আমার শহর নয়; আমার শহর হয়নি এবং হবেও না।'
পত্রিকায় দেখছি, মানুষ বাড়ি ভাড়া পুরো দিতে পারছে না, ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে দিয়ে চলে যাচ্ছে। বাড়িওয়ালাদেরও অনেকেই বিপাকে পড়েছেন। কারণ অনেকের সংসার চলে বাড়িভাড়ার ওপর। অনেকের বাড়ির ওপর ঋণ আছে। কাজেই বাড়িভাড়া মওকুফ করে দেওয়াটা তাদের পক্ষে অসম্ভব।
বস্তিবাসীরা প্রায় প্রত্যেকেই দিনমজুরি, ছোটখাট ব্যবসা ও বাসায় খণ্ডকালীন গৃহশ্রমিকের কাজ করতেন। তাদের সবাইকে চাকরিচ্যূত করা হয়েছে করোনার কারণে। ফলে এরা সবাই আশ্রয়হীন, সম্বলহীন হয়ে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। এদের খাওয়ার চাল নাই, ঘরভাড়া দেওয়ার টাকা নাই।
শুধু কি দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ ঢাকা ছাড়ছেন? না; অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারও কাজ হারিয়ে শহর ছেড়ে যাচ্ছে। ব্র্যাক, ডেটাসেন্স এবং উন্নয়ন সমুন্বয় যৌথভাবে চালানো এক গবেষণায় বলেছে মহামারির কারণে দেশে ১০ কোটি ২২ লাখ মানুষ আর্থিক ঝুঁকিতে পড়েছে। ইতোমধ্যে ৭৪ শতাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে।
করোনায় অভ্যন্তরীণ অভিবাসন নিয়ে ব্র্যাক একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করছে। শেষ হওয়ার আগেই তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। সিপিডি আর ব্র্যাকের গবেষণা বলছে, এরইমধ্যে সারাদেশে আরও নতুন করে ৫ কোটি লোক দারিদ্র সীমার নিচে নেমে গেছে। যারা আগে নিম্নবিত্ত ছিল না, তারাই এখন সীমানা অতিক্রম করে দরিদ্র হয়ে গেছে।
দিনমজুর শ্রমিকরা কিছু কিছু কাজ পেলেও দরিদ্র হয়ে পড়ছেন ছোট ছোট স্কুলের শিক্ষক, মাদ্রাসার শিক্ষক, দোকানদার, রেস্টুরেন্ট কর্মচারি। ঢাকা শহরের রেস্টুরেন্টগুলোতে কাজ করা প্রায় ৯ লাখ কর্মী বর্তমানে বিনা বেতনে ছুটিতে আছেন। হয়তো এরা আর সবাই চাকরি ফিরে পাবেন না। অনেকেই রাজি হয়েছেন সংস্থার বেতন কমানোর প্রস্তাবে। তারা গ্রামে সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়ে নিজে মেসে আছেন। সেরকমই একজন আব্দুল করিম বলেছেন, 'জানেন, ঢাকা শহর আমাদের তেমন কিছুই দেয়নি; কিন্তু এই শহরটা ছেড়ে যেতেও পারছি না!'
আমি ভাবছি, ঢাকার মোটামুটি ভালো আয়ের মধ্যবিত্তদের অভাবটা করোনাকালে এত প্রকট আকার ধারণ করার পেছনে কি শুধু চাকরিহীনতাই দায়ী? নাকি আমাদের কপট নাগরিক জীবনযাপনও কিছুটা দায়ী? আমাদের অনেক ব্যয়ই যে অপ্রয়োজনীয় ছিল, তা আজকে বুঝতে পারছি। সেজন্য আমাদের হাতে যতটুকুও সম্বল থাকা উচিত ছিল, তা নেই। বাসার অভাবের দিনে মায়ের গোপন বাক্সে যে জমানো টাকা থাকত, আজ তাও নেই। কেন নেই?
আসলে ঠাটবাট, শহুরে চাকচিক্য নিয়ে বেঁচে থাকতে গিয়ে আমরা অনেকেই ভবিষ্যত নিরাপত্তার দিকটিকে অবহেলা করেছি। করোনাকালে বুঝতে পারছি, আমাদের জীবনমান নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে সামগ্রিক অর্থনীতিই নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। শুধু আর্থিক বিপর্যয় নয়, মানসিক বিপর্যয়ও আমাদের অস্থির করে তুলছে। মনে হচ্ছে, সবদিক দিয়েই আমরা উদ্বাস্তু হয়ে যাচ্ছি।
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন