করোনা বিশ্ব ভূ- রাজনীতির মানচিত্র পাল্টে দেবে ?
দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মাস পেরিয়ে গেল অথচ বিশ্ব এখনও করোনা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে । তাবৎ শক্তিধর থেকে দরিদ্র দেশ কিংবা জনগন সকলেই করোনার ছোবলে ছিন্নভিন্ন । আশার আলো দেখানোর মতো কোন সান্ত্বনা সূচক সংবাদ কেউ দিতে পারেনি । যদিও কয়েকটি দেশ করোনা সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্রণ করতে পেরেছে, তারপরও এটি ফিরে এসে (বেইজিংয়ে দ্বিতীয়বার) উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। তার সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে দেশে দেশে প্রাকৃতিক দূর্যোগ, ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি। অবস্থা এতটাই খারাপ যে, শক্তিশালী রাষ্ট্রপ্রধান এবং তাদের সহযোগীরাও এক রকম পালিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন, সেখানে আমজনতার কি অবস্থা! তা সহজেই অনুমেয়।
দেশে-দেশে লকডাউন অর্থনীতির চাকা বন্ধ করে দিয়েছে । ফলে মৃত্যু, অসুস্থতা, বেকারত্ব, ক্ষুধা, হতাশা ইত্যাদি অনিশ্চিত অস্থিরতা মানুষকে আতংকগ্রস্ত করে তুলেছে । হতাশাগ্ৰস্ত মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠছে । ব্যর্থতা ঢাকা দিতে দেশগুলো পরষ্পরের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ তুলছে। অন্যদিকে বিশ্বসাস্থ্য সংস্থা কিংবা জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো অতীতের মতো ব্যর্থতার পাল্লা ভারি করছে । প্রশ্ন আসছে এসব শ্বেতহস্তী প্রতিষ্ঠানগুলোর পিছনে মানুষের কষ্টার্জিত টাকা খরচ করে কি লাভ? এদিক থেকে আমেরিকার প্রেসিন্ডেট ট্রাম্পের অভিযোগ অসত্য নয়, কেননা এরা কি প্রকৃতই তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারছে?
ইতিমধ্যে ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষেপে উঠতে শুরু করেছে, যেটি আরো প্রকটভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশংকা করা হচ্ছে দেশে দেশে। কারণ অস্ত্র, যুদ্ধ ইত্যাদিতে ব্যাপক খরচ করা হয়েছে কিন্তু সে অর্থে মানুষের মৌলিক বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়েছ। আজ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে দাঁডিয়ে মানুষের নতুন উপলব্ধি হচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষুধা, বেকারত্ব, অকালমৃত্যু মানুষকে বেপরোয়া করে তুলছে বা তুলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মহামারির প্রভাবে স্তব্ধ অর্থনীতি যদি আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে সীমিত আকারেও ঘুরে দাঁড়াতে না পারে, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আইনশৃংখলার ব্যাপক অবনতি হবে। ফলে ব্যাপক জন অসেন্তোষ তৈরি হবে সর্বত্র। গদি সামলানো কঠিন হবে অনেক সরকারের। মিথ্যা উন্নয়নের গল্প শোনানো রাষ্ট্র নায়কদের এ বিপদ অনেক বেশি।
পৃথিবীর বড় বড় অর্থনীতিবিদরা ইতিমধ্যে শুধুমাত্র চলতি মহামারি শুরু থেকে বছরের মে মাস পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় ঘোষণা করেছে, এত বড় বিপর্যয় কয়েক শতকের মধ্যেও আসেনি। তারপর যদি এ মহামারির প্রলয় আরও কয়েক মাস চলে তাহলে এটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা কল্পনা করাও কঠিন। বিবেচনায় রাখতে হবে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা এখন ৭০০ কোটির বেশি। যা অন্যান্য শতকের মহামারি কিংবা মন্দার সময়কার জনসংখ্যার চেয়ে অনেকগুন বেশী। ফলে মানুষের ন্যুনতম মৌলিক চাহিদা যোগান দেয়া আদতেই চ্যালেঞ্জের | এর মধ্যে বিশ্বের অর্থনীতি এবং রাজনীতির গ্রিনরুমের খেলোয়াড়রা নিশ্চয়ই নতুন হিসেবনিকেশ শুরু করেছেন।
এ বাস্তবতা এবং পৃথিবীর ইতিপূর্বের সকল দূর্যোগ, মহামারি পরবর্তী কাল, অর্থনৈতিক মহামন্দা ইত্যাদি বিবেচনায় বলা যায়, পৃথিবীর ভূ- রাজনীতিতে একটি নতুন খেলা শুরু হবে। চীন -ভারত লাদাখ সীমান্তে ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছে। আমেরিকা পারস্য উপসাগরে নিজেদের রণতরীগুলোর ১০০ মিটারের কাছাকাছি যে কোন ইরানি নৌযান ধ্বংসের সরাসরি নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। ইরানের পাল্টা হুমকি চলমান আছে। হঠাৎ কি এমন হলো যে, ইতিমধ্যে প্রতিবেশী নেপাল, শক্তিধর ভারতের বিরুদ্ধে কঠিন হুংকার দিয়েছে, এমনকি তাদের মানচিত্রে বর্তমান ভারতের অংশবিশেষ চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতালিসহ কয়েকটি দেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবার বিষয় বিবেচনা করছে। তেল নিয়ে আমেরিকা তার প্রিয় বন্ধু সৌদি আরবকে সরাসরি হুমকি দিয়েছে।
আজ হোক কাল হোক নতুন তৃতীয় বিশ্বযুদ্বের সূচনা হতে পারে। শুরুটা হবে রাষ্টনায়করা যখন তাদের পিঠ বাঁচাতে চাইবে, আর এ খেলায় কোচ হবে কর্পোরেট জগতের প্রভুরা। পুঁজিবাদের ধর্ম অনুযায়ী নতুন জায়গা বা বাজার তৈরি করতে হলে শূন্যস্থান তৈরি করা দরকার, সেটি যুদ্ধের মাধ্যমে হোক কিংবা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে হোক, বাজার টিকে থাকতে হবে। তাতে যদি পৃথিবীতে ব্যাপক প্রাণহানিও হয় অসুবিধা নেই। পুঁজিবাদ তো থাকবে। এদের প্রতিহত করার কোনো শক্তিও কারোর নেই, কারণ কম বেশি সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা এদের হাতে জিম্মি কিংবা এদের কারণেই ক্ষমতায় এসেছেন । দেশে বিদেশে কর্পোরেট প্রভুরা এখন সব ক্ষমতার মালিক।
জনগণ নয়- গণতন্ত্রের সংজ্ঞা এখন পরিবর্তিত হয়েছে । প্রয়াত আব্রাহাম লিংকনের- " জনগণ কর্তৃক, জনগণ দ্বারা, জনগণের জন্য "গণতন্ত্রের এ সংজ্ঞা এখন খুব কষ্ট করে পৃথিবীর দু-একটি দেশে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান প্রভুদের ক্রীড়নক শুধু রাষ্টপ্রধানরাই নয়, এমনি কি আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহও। কারণ তাদের চাকুরি কিংবা বেতন নির্ভর করে এদের উপর। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের অবস্থান বিশ্লেষণ করলে এটি বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়।
সুতরাং এটি নিশ্চিত বলা যায়, একদিকে লক্ষ কোটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যে আক্রান্ত দিশেহারা মানুষ আর অন্যদিকে গ্রিনরুমের কর্পোরেট প্রভুরা। মানুষের দৃষ্টি ফেরাতে কিংবা বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করার জন্য, বর্তমান স্তাবকদের ছুঁড়ে ফেলে, তৈরি করবে নতুন সহযোগী। যেহেতু মানুষ ঐক্যবদ্ধ নয়, তা হওয়া সম্ভবও নয়, কিংবা পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনো শক্তিধর মানবিক রাষ্ট্রও নেই, তাই দাবার গুটিতে পরিণত হতে হবে মানুষকে। হয়তো উন্মেষ হবে নতুন এক পৃথিবীর , যার রাজনৈতিক চিত্র তো বটেই, ভৌগলিক চিত্রও পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। করোনা সংকট থেকে বেঁচে গেলে সেটি হয়তো দেখা যাবে, না হয় যারা বেঁচে থাকবে তারাই দেখবে।