করোনা মোকাবেলায় বিশ্ব নারী নেতৃত্বের সাফল্য, আগামির বিশ্ব কাদের হাতে?
বিশ্বের নারী সরকারপ্রধানরা করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কেন সফল হয়েছেন? পরিসংখ্যানে দেখা গেছে নারীরা যখন ড্রাইভ করেন, তারা খুবই সতর্ক থাকেন। এই অসমতার পৃথিবীতে কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, নারীদের ঠাণ্ডা মাথার সর্তকতা এবং সূক্ষ্ম চিন্তার সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে পাওয়া আজ করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিশ্ব নারী নেতাদের সফলতার ক্ষেত্র থেকে খুবই স্পষ্টভাবে দেখা যায়, বিশ্ব পরিচালনায় নারীদের অংশগ্রহণ প্রতিটি ক্ষেত্রে কতটা জরুরি।
শুধু তাই নয়, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অসমতা এবং তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া লিঙ্গবৈষম্য দেখিয়ে দেয়, আজ এই বৈশ্বিক জরুরি সংকট মোকাবেলায় আমরা কতটা পিছিয়ে।
যখন আমরা নারী-পুরুষের নেতৃত্ব নিয়ে কথা বলি, তখন এই নারীদের দিকে তাকিয়ে দেখি না তারা কিভাবে মোকাবেলা করেছেন করোনা দুর্যোগের এই কঠিন পরিস্থিতি? অবশ্যই বিশ্বে আরও বেশি নারী নেতা এবং রাজনীতির সর্বস্তরে নারীর সমান প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজন- এটি যে কোনো জাতিকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বলা হয়ে থাকে, একটি পরিবারকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য যেমন বাবা এবং মা- দুজনের ভূমিকাই অপরিসীম, তেমনি একটা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নারী-পুরুষ উভয়ের নেতৃত্ব অনস্বীকার্য।
আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন পর্যন্ত, এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনুপাতিক সংখ্যক নারী নেতার সাফল্যে জেন্ডার সাম্যতা বিশ্ব জনস্বাস্থ্য এবং আন্তর্জাতিক সুরক্ষার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ!
প্রমাণ মিলেছে এবার নারী নেতাদের করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে। নারী নেতারা মহামারিটি সামলানোর ক্ষেত্রে একটি দুর্দান্ত কাজ করছেন। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় নেতাদের অবদান সত্যি প্রশংসনীয়।
করোনাভাইরাস মহামারিতে চিত্তাকর্ষক দেশ পরিচালনার জন্য প্রশংসিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী এই নারী নেতৃত্ব। মহামারি মোকাবেলায় নারী-নেতৃত্বাধীন সরকারগুলোর সাফল্য আরও লক্ষণীয়। এমন দেশগুলোর সরকারপ্রধানরা প্রথম থেকেই বিষয়টি আমলে নিয়েছেন। প্রাথমিক ও বৈজ্ঞানিক হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে তারা মহামারিটি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে এনে জনসাধারণের আস্থাযুক্ত হয়েছেন।
তারা ব্যাপক পরীক্ষা, মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসা সরঞ্জামের সহজ সরবরাহ, সংক্রমিত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা এবং সামাজিক জমায়েতের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ প্রয়োগ করেছেন।
১.
প্রথমে যেমন দেখতে পাচ্ছি, তাইওয়ানের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো করোনভাইরাসকে এত সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে, তারা এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যদের সহায়তার জন্য লক্ষ লক্ষ মাস্ক রপ্তানি করছে। যদিও মূল ভূখণ্ড চীন থেকে শুরু হওয়া মহামারিটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা ছিল তাইওয়ানের মানুষদের জন্য, কিন্তু প্রেসিডেন্টের সুদক্ষ দেশ পরিচালনার জন্য তা হয়নি।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট যখন গত বছরের ডিসেম্বরে উহানের নাগরিকদের একটি রহস্যজনক নতুন ভাইরাসে সংক্রামিত হওয়ার কথা শুনেছিলেন, তিনি তৎক্ষণাৎ উহান থেকে আগত সব বিমানকে পরিদর্শন করার নির্দেশ দেন। এরপর তিনি একটি মহামারি কমান্ড সেন্টার স্থাপন করেন, মুখের মাস্ক ও ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামাদি তৈরি করেন এবং মূল ভূখণ্ড চীন, হংকং এবং ম্যাকাওয়ে আসা-যাওয়ার সমস্ত ফ্লাইটকে সীমাবদ্ধ করেন।
এবার এশিয়া সফরের সময় আমি তাইওয়ান গিয়েছিলাম। ওই সময় চীনের উহানে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রচুর। আমি জাপান থেকে যখন তাইওয়ান এয়ারপোর্টে নেমেছিলাম, তখন দেখেছি করোনাভাইরাস মোকাবেলায় তাদের কঠোর প্রস্তুতি। প্রত্যেক যাত্রীকে আলাদা করে তাপমাত্রা চেকআপ করা থেকে শুরু করে তখনই জায়গায় জায়গায় হুশিয়ারি নোটিশ ঝুলয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার ওই সফরের সময়টা ছিল জানুয়ারির ২৪ তারিখ, তখন মাত্র তাইওয়ানে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩ জন।
তাইওয়ানের প্রাথমিক ও আক্রমণাত্মক হস্তক্ষেপমূলক পদক্ষেপগুলোর কারণে দেশটিতে এ পর্যন্ত মাত্র ৪২৪ জন আক্রান্ত এবং ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ডব্লিউএইচওর বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদে তাইওয়ানকে পর্যবেক্ষক মর্যাদা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে দেশটির করোনভাইরাস সাফল্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
২.
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল ঠিক একইভাবে তার দক্ষ দেশ পরিচালনার মাধ্যমে এই ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে এনেছেন অনেকটা। জার্মানি ইউরোপের বৃহত্তম মাপের করোনাভাইরাস পরীক্ষা কার্যক্রমের তদারকি করেছে, প্রতি সপ্তাহে ৩৫ লাখ নমুনা পরীক্ষা করেছে; রোগীদের কার্যকরভাবে আলাদা করতে এবং চিকিৎসা করার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ভাইরাস শনাক্ত করেছে।
জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি আইসিইউ এবং ইউরোপের বৃহত্তম স্কেলে করোনাভাইরাস পরীক্ষা কার্যক্রম রয়েছে।
হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান হ্যান্স-জর্জ ক্রুসাল্লিচকে বলেছেন, 'জার্মানিতে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি জনগণের কাছে সরকার যে আস্থা অর্জন করছে, তার সঙ্গে সরকারের উচ্চ স্তরের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
৩.
নিউজিল্যান্ড যেমন একটি অপূর্ব সুন্দর দেশ, প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন মানুষ হিসেবেও দারুণ। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই প্রধানমন্ত্রীর খুবই ভক্ত।
নিউজিল্যান্ড প্রায় পাঁচ মিলিয়ন দ্বীপপুঞ্জের দেশ, যা পর্যটনের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। তারপরও প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন টুরিজম বন্ধ করতে এবং সারা দেশে এক মাসব্যাপী লকডাউন চাপিয়ে দেওয়ার জন্য প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
জেসিন্ডা আর্ডারন ১৯ মার্চ নিউজিল্যান্ডের সীমানা বিদেশি দর্শকদের কাছে বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং ২৩ মার্চ দেশের চার সপ্তাহের লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনা বা কাছাকাছি ব্যায়ামাগারে যাওয়া ব্যতীত সমস্ত অপ্রয়োজনীয় কর্মীদের বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেন তিনি।
দেশটিতে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। সেখানে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা খুব কম। আর্ডারন তার জনগণকে বুঝিয়েছেন, এখনো অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি।
৪.
আমরা নর্ডিক দেশগুলির দিকে যদি তাকাই, দেখতে পাবো- পাঁচটি দেশের চারটির নেতৃত্বে রয়েছে নারী। এগুলোর প্রত্যেকটিতে ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় করোনভাইরাসে মৃত্যুর হার কম।
উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বের কনিষ্ঠ সরকারপ্রধান, ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, ৩৪-বছর বয়সী সানা ম্যারিনের কথা বলে যেতে পারে। তার দেশের ৫.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ১৭২ জন করোনাভাইরাসে মারা গেছেন। তিনি মহামারি প্রতিরোধে প্রাথমিক প্রস্তুতির জন্য ও বর্তমান সময় পর্যন্ত কার্যকরি ভূমিকা রাখার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছেন।
৫.
আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্যাটরিন জ্যাকোবসদ্দিয়ার দেশটিতে প্রথম দিকে আক্রমণাত্মকভাবে যোগাযোগ-সন্ধান এবং সন্দেহভাজন করোনভাইরাস কেসকে পৃথকীকরণে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। যার ফলে আক্রান্তের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে সেখানে।
৬.
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানও অনস্বীকার্য। তিনি বাংলাদেশের মতো ছোট্ট একটি দেশের ১৭ কোটি জনগণকে অনানুষ্ঠানিক লকডাউনের মাধ্যমে ঘরবন্দি করতে সক্ষম হয়েছেন এবং করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আশা করি বাংলাদেশের মানুষ কিছুটা হলেও এর মাধ্যমে রক্ষা পাবে।
এই হস্তক্ষেপবাদী প্রতিক্রিয়াগুলো সুইডেনের সঙ্গে তুলনা তুলনা করলে দেখা যায়, সেটিই একমাত্র নর্ডিক দেশ, যেখানে নারীর নেতৃত্বে সরকার চলছে না। দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্টেফান লোফভেন লকডাউন চাপিয়ে দিতে অস্বীকার করেছেন এবং স্কুল ও ব্যবসা-বাণিজ্য উন্মুক্ত রেখেছেন। এর ফলে দেশটিতে মৃত্যুর হার ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় যথেষ্ট বেড়েছে।
করোনাভাইরাসের কেন্দ্রবিন্দু এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথমদিকে ডেমোক্র্যাটিক দলকে ভাইরাসটিকে 'ছলনাহার' হিসাবে রাজনীতির জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন এবং কয়েক মাস ধরে শীর্ষ বিজ্ঞানীদের দেওয়া একাধিক সতর্কতামূলক পরামর্শ অবলম্বনে ব্যর্থ হয়েছেন।
দেশটিকে মৃতের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে, আক্রান্ত প্রায় ৯ লাখ নাগরিক।
এখন সময় এসেছে রাজনীতির সর্বস্তরে সমানভাবে নারীদের অংশগ্রহণ করতে দেওয়ার। করোনাভাইরাস বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং সঠিকভাবে জীবন রক্ষার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন বলে কোন নেতারা আদর্শ হিসেবে আবির্ভূত হবেন, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না এখনই। তবে উপরের উদাহরণগুলো দেখায়, প্রথমদিকে এবং নিজ দেশের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা সরকারপ্রধানদের মধ্যে অনেকেই নারী।
বিশ্বে আরও বেশি নারী সরকারপ্রধান এবং রাজনীতির সর্বস্তরে নারীর সমান প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনুপাতিক সংখ্যক নারী নেতার সাফল্য আমরা দেখতে পাচ্ছি। তাতেই বোঝা যাচ্ছে, জেন্ডার সাম্যতা বিশ্ব জনস্বাস্থ্য এবং আন্তর্জাতিক সুরক্ষার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
- লেখক: অভিযাত্রী; সর্বাধিক রাষ্ট্র ভ্রমণকারী প্রথম বাংলাদেশি