কর মওকুফ বড় ও মাঝারি শিল্পগুলোকে সহায়তা করবে, অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির জন্য এটি নয়: দেবপ্রিয়
বাজেট নিয়ে আমার প্রথম বক্তব্য হলো দেশে এ মূহুর্তে করোনা পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং অতিমারির দ্বিতীয় ধাক্কার মধ্য দিয়ে দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তৃতীয় ধাক্কাও আসতে পারে। পুরো বাজেটে একটি মাত্র বাক্য আছে দ্বিতীয় ধাক্কা সম্বন্ধে। কিন্তু ওই ধাক্কাটার তাৎপর্য কি, অভিঘাত কি হবে, এটার পরিণতি কি হবে এ সম্বন্ধে কোনো বিস্তৃত আলোচনা ওখানে নেই।
বাজেট শুনে এবং পড়ে আমার মনে হয়েছে এটা আমাদের প্রথম ধাক্কার পরে ডিসেম্বরের পরপরই সম্ভবত প্রণীত হয়েছে যেখানে দ্বিতীয় ধাক্কাকে আত্মস্থ করা হয়নি। তৃতীয় ধাক্কা সম্বন্ধে কোনো আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়নি।
গত অর্থ বছরে যেভাবে হয়েছিল- ২/৩ মাসে করোনা কেটে যাবে, তারপর আমরা স্বাভাবিক জীবনে চলে যাবো ঐ রকমই একটা অনুমানের ভিত্তিতে এ বাজেটটি করা হয়েছে। যেটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য না।
দ্বিতীয়ত, করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের যদি স্বাস্থ্যঝুঁকি নাও থাকে অর্থনৈতিক ঝুঁকি আমাদের বহুদিন থাকবে। ২/৩ বছর থাকবে দারিদ্র পরিস্থিতি, বর্তমান কর্মসংস্থান পরিস্থিতি। এজন্য ২/৩ বছরের জন্য মধ্যমেয়াদী প্রক্ষাপন থাকলে ভালো হতো।
আরও সমস্যা হয়ে গেছে এখানে বাজেটের মধ্যে বিভিন্ন তথ্যের বিভ্রাট সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এই মূহুর্তে আমাদের ৩টি মূল দলিল আছে। একটি হচ্ছে বাজেট বক্তৃতা, আর একটি হচ্ছে মধ্য মেয়াদী সামাজিক অর্থনীতির প্রাক্কালন (২০২১ থেকে ২৪ পর্যন্ত) আর আছে আমাদের ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। এই তিনটি দলিলের ভিতরে প্রচুর অসামঞ্জস্য আছে।
উদাহরণ হিসেবে যদি আমি বলি, ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে আছে ক্রমান্বয়ে দারিদ্র কমে ১৭ শতাংশে যাবে কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে ১৪ শতাংশে যাবে। হত দরিদ্রদের কথায়ও একইভাবে ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার চেয়ে উচ্চ বা বেশি বিভিন্ন সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ আমরা জানি এ করোনার সময়কালে দারিদ্র পরিস্থিতি কি রকমভাবে অবনমন ঘটেছে। কিন্তু কোথায় যেন করোনার পরিস্থিতি সম্বন্ধে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একটা সমস্যা আছে বলে আমি মনে করছি। এটার গভীর উপলব্ধিটা পরিলক্ষিত হয় নাই।
আরেকটি বিষয় হলো, নেতিবাচকের সাথে অবশ্যই ইতিবাচক দিক আছে এ বাজেটে। ইতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে কর ছাড়ের অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ কর ছাড়ের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই মাঝারি শিল্প ও অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী শিল্প উপকৃত হবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এ বিষয়ের আমি পক্ষে আছি। যদিও মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে কর দেওয়ার বিষয়ে কিছু বিতর্ক হতে পারে এটাকে আমি তুলনামূলকভাবে নাতিক্ষুদ্র বিষয় মনে করি। কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো এ পুরো কর ছাড় টা যেটা হবে সেটা প্রাতিষ্ঠানিক খাতে যারা বড় বড় উদ্যোক্তা আছে তাদের জন্য। অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে যে ৮০ শতাংশ মানুষ আছে তাদের জন্য এ সুবিধা থাকছে না।
রাস্তার ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে পরিবহন শ্রমিক- তারা কিন্তু এ সুবিধার মধ্যে থাকবে না। সেহেতু যে কর্মসংস্থানটা হবে সেটা আদৌ হবে কতোখানি, সেটা সম্বন্ধেও কিন্তু পুরা বাজেটে প্রাক্কলন নেই। কর্মসংস্থানের প্রাক্কলন নেই, যুব কর্মসংস্থানের তো নাই ই। শুধু যুব কর্মসংস্থানের বিষয়ে প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছে। কর্মসংস্থান সম্বন্ধে নেই।
আমরা বার বার বলেছি প্রবৃদ্ধি থেকে সরে এসে কর্মসংস্থানমুখী উন্নয়নের ভিতরে ঢুকতে হবে। আসলে সেটা শেষ পর্যন্ত কত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে!
কর ছাড়গুলোকে যদি কর্মসংস্থানের সাথে যুক্ত করা যেত তাহলে কর্মসংস্থানের সাথে কর নেয়াকে মেলানো যেত।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দিয়ে হবে না। অর্থমন্ত্রী খুব ভালোই জানেন যে, এদেরকে প্রত্যক্ষ অর্থ দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। যে সামাজিক ব্যয় বাড়ানো হয়েছে সেটা জিডিপির আধা শতাংশও না। এবং যেটুকু বাড়ানো হয়েছে সেটা পুরো বাজেটের ১ শতাংশও না। তাহলে গরিব মানুষদের জন্য পুরো বাজেটে আর কিছু বরাদ্দ দিতে পারি না।
আমার করোনাকালীন যে অভিজ্ঞতা সেটা হলো, দুস্থ মানুষ অনেক বেশি আঘাত পেয়েছেন।
কথা হচ্ছে, এ কর্মসংস্থানের সুযোগটি সেই মানুষগুলোর জন্য হবে কিনা। আমাদের আশঙ্কাও হচ্ছে এটা তাদের জন্য নয়। হয়তো উচ্চাভিলাষীদের জন্য হবে কিন্তু খেটে খাওয়া অপ্রাতিষ্ঠানিক মানুষটির জন্য সেটা হবে না। এছাড়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যারা তাদের ব্যবসা চালাতে পারছেন না তাদের উপকার হবে কিনা সেইটা আমি জানি না।
উপকার কারো কারো হবে কিন্তু সবার উপকার হবে না।
অর্থনীতিতে বলে, করোনাকালীন সময়ে দুইভাবে ঠেকা দিতে পারে। একটা হলো নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং আর্থিক সহযোগিতা প্রত্যক্ষভাবে দেওয়া।
বাংলাদেশের কথা চিন্তা করলে আমি দেশে এক দুস্থ নারীকে দেই ৫০০ টাকা অথচ তার ন্যূনতম প্রয়োজন ১ হাজার ৮০০ টাকা। আর ভারত ঐ একইরকম দুস্থ নারীকে দেয় এক হাজার টাকা। তাহলে যদি আমাদের মাথাপিছু আয় ভারতের থেকে বেড়ে গিয়ে থাকে এবং আমরা এটা নিয়ে গর্বও করি তাহলে কেন আমি দুস্থ নারীকে সেই সমান সুযোগ দিচ্ছি না?
বাংলাদেশের যে উন্নতি হলো সেই সুযোগ, সেই সুফল কেন আমরা গ্রামের সেই দুস্থ নারীটিকে দিচ্ছি না? এটিই আমরা কেউ কখনও ভেবে দেখিনা।
মাথাপিছু আয় যে ২২০০ ডলার হয়েছে এটার বড় একটা অংশ হচ্ছে রেমিট্যান্স আয়। এটা অভ্যন্তরীণ উৎস না, এটা বৈদেশিক উৎস। গত এক-দেড় দশক ধরে বৈষম্য বাড়ছিল, এই সময়কালে আরও বৈষম্য বেড়েছে। যাদের প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি আছে তাদের সমস্যা হয়নি, সমস্যা হয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে।
স্মরণাতীতকালের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সবচেয়ে কম বাস্তবায়িত হয়েছে। ১০ মাসে ৪৯ শতাংশ হয়েছে। আর তার ভিতরে সবচেয়ে পার্থক্য দেখা গেছে স্বাস্থ্য খাতে; যেখানে সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল এই করোনাকালে। আমি বাজেটের ভিতর একটা লাইনও খুঁজে পাইনি যেখানে আমাকে আশ্বস্ত করবে যে, আগামী বছর এই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি যেটা দেওয়া হয়েছে সেটা যথাযথভাবে মানুষের উন্নয়নে বাস্তবায়িত হবে।
সরকার বাজেটে বরাদ্দ কাজের বাস্তবায়নের জন্য যে মনোভঙ্গি নিয়ে আগান সেটা সুবিধাজনক না। কর দিলেই যে মানুষের উন্নতি হবে সেটা আমি মনে করি না। অর্থনীতি বলে, বাজারে সুবিধা নেওয়ার সক্ষমতা সব মানুষের নাই। বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ মানুষের নাই, ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের নাই। তারা ব্যাংকে কিভাবে ঋণ নিতে হয় সেটাও জানেনা। এখনো সরকারের প্রদত্ত প্রণোদনার ২২ শতাংশও ব্যবহার করতে পারে নাই। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো তো পারেই নি।
এখানে দুটো সমস্যা বিদ্যমান। সরকারের মধ্যে এখনও অনীহা ও অস্বীকারের মনোভাব আছে। করোনা যে কতখানি গভীর এবং দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার সৃষ্টি করছে সেটা সম্বন্ধে অনুধাবন, উপলব্ধি অথবা স্বীকৃতির অভাব রয়েছে বলে আমি মনে করি। যার ফলে সরকার যে কাঠামো দাঁড় করান সেটা যেকোনো দিনের মতো। আসলে পৃথিবী তো যেকোনো দিনের মতো নাই আর। কখন যে কি অবস্থায় যাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে বিশেষ করে বাংলাদেশ। এই স্বীকৃতি তো নাই।
গত ৫ বছরে আমরা যা লাভ করেছিলাম সেটা গত ৫ মাসে চলে গিয়েছে। আমাদের আবার ২০১৫ তে ফেরত নিয়ে গেছে। তাহলে আমাদের ১০ বছরের প্রস্তুতি নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত হলো, সকলেই শুধু বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা করে। বাস্তবায়ন নিয়ে আমরা বলি কিন্তু খরচের গুণমান সেরকমভাবে বলি না। বাস্তবায়ন গুণমানের জন্য কাঠামোগত সংস্কার দরকার। সংস্কারের অন্যতম জায়গা হলো স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে যে ব্যয়টা হচ্ছে স্থানীয় মানুষের পক্ষে সেটা দাঁড় করাতে হবে।
সরকার যে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো করলো, এই করোনা মহামারির সময়ে সেগুলো কি সেবা দিতে পারলো? ওখানে কোন ডাক্তার ছিল? ওখানে কী ওষুধ টা গেছে! এটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী গর্বও করেছিলেন। এ হচ্ছে তার নমুনা।
গত বছর ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দিয়েছিল তা খরচ হয়নি। এ বছরও দিয়েছে খরচ হবে না। দেশে টিকা দেওয়ার যে প্রক্রিয়া চলছে এতে ২৫ বছর লাগবে সবাইকে টিকা দিতে। এটাতো কোনো ব্যবস্থা না। এখানে যদি সংস্কার না হয়, এখানে যদি জনমানুষের সম্পৃক্ততা না থাকে, স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা না আসে তাহলে এই টাকার বরাদ্দ সেই অর্থে কোনো সুফল বয়ে আনবে না।
এবারের বাজেটে ঘাটতি হচ্ছে দেশজ আয়ের ৬ শতাংশের নিচে। এটা নিয়ন্ত্রণযোগ্য। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। এরকম সময়ে অন্য দেশে ঘাটতি আরও বাড়িয়েছে। এটাকে আরও এক শতাংশ বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তি এখনও আছে।
আমার চিন্তা হচ্ছে ব্যয় নিয়ে। এখনই সময় সংস্কারের। আজকে যদি সংস্কার করা হয় সরকার রাজনৈতিকভাবে মানুষের সমর্থন পাবে। সংস্কারের পরে মানুষ প্রশংসাই করবে।