কেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উত্তর কোরিয়া প্রাসঙ্গিক?
পূর্ব এশিয়ায় পীত সাগর তীরবর্তী সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী উত্তর কোরিয়া, পৃথিবীর সবচেয়ে অবরুদ্ধ দেশ হিসেবে পরিচিত। তবে এই অবরুদ্ধ অবস্থা উত্তর কোরিয়ার ভূখণ্ডগত নয় বরং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। বছরের পর বছর ধরে দেশটির একরোখা মনোভাব এবং প্রায় দুই দশক ধরে পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়নের ফলে অর্পিত অবরোধ, উত্তর কোরিয়াকে বহির্বিশ্বের রাজনীতি থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তবে জাতিসংঘ ও পশ্চিমাবিশ্ব কর্তৃক অবরোধের ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উত্তর কোরিয়ার তেমন অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকলেও দেশটি পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হওয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
১৯১০ থেকে ১৯৪৫ সাল অর্থাৎ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত কোরিয়া উপদ্বীপ জাপানের উপনিবেশ হয়ে ছিলো। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে কোরিয়া উপদ্বীপ বিভক্ত হয়ে পড়ে। তবে মাঝের তিন বছরে কোরিয়ার উত্তরাংশ সোভিয়েত প্রভাবে এবং দক্ষিণাংশ মার্কিন প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিলো খুব ভালোভাবেই। বিভক্তির পর সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ব্লকে যোগ দেয় উত্তর কোরিয়া এবং পুঁজিবাদী পশ্চিমা ব্লকের বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও অর্থনৈতিক একচ্ছত্র সমর্থন লাভ করে দক্ষিণ কোরিয়া, যা এখন অব্দি বিদ্যমান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে কোরিয়া উপদ্বীপ পুনরায় একত্রীকণের চেষ্টা করা হলেও মার্কিন ও সোভিয়েত মতাদর্শগত প্রভাবের ভিন্নতার দরুণ তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ফলে ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর উত্তর কোরিয়াও স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু দুই কোরিয়া সরকারই দাবী করে তারা পুরো কোরিয়া উপদ্বীপের শাসক। মূলত দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ এটাই। আর এই দাবীর প্রেক্ষিতেই ১৯৫০ সালে শুরু হয় কোরিয়া যুদ্ধ। বলা হয়ে থাকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও অধিক সংখ্যাক বেসামরিক মানুষ মারা যায় কোরিয়া যুদ্ধে, যার সংখ্যা প্রায় ৩ মিলিয়ন। এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় উত্তর কোরিয়া। জনসংখ্যার ১২-১৫ শতাংশই যুদ্ধে নিহত হয় এবং এর সাথে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকারও হতে হয়েছিলো উত্তর কোরিয়াকে। ১৯৫৩ সালে এক যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। তবে উল্লেখ্য যে, এরপরে দুই কোরিয়ার মাঝে কোনো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি।
প্রায় ৩৫ বছর জাপানের উপনিবেশিক শাসন, কোরিয়া উপদ্বীপ বিভক্তি, এবং সর্বশেষ প্রায় তিন বছরের যুদ্ধের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার উছিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর তান্ডব উত্তর কোরিয়ার একরোখা মনোভাবকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। উত্তর কোরিয়া মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ফলেই কোরিয়া বিভক্ত হয়ে তার জাতীয় ঐক্য হারিয়েছে। ফলে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রকেই নিজের প্রধান শত্রু হিসেবে মনে করে এবং শত্রুকে টক্কর দিতে ও চাপে রাখতে পারমাণবিক অস্ত্রও তৈরি করেছে।
উত্তর কোরিয়ার বর্তমান শাসক কিম জং উনের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য হলো দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন ও পুঁজিবাদী হুমকি থেকে বাঁচাতে শক্তি অর্জন করা। আর উত্তর কোরিয়ার কাছে এই শক্তি সামর্থের প্রধান মাপকাঠি হলো সামরিক শক্তি। বিশ্বের ৪র্থ বৃহৎ সামরিক বাহিনীর অধিকারী উত্তর কোরিয়ার কর্মরত সেনা সদস্য সংখ্যা প্রায় ১.২ মিলিয়ন। এছাড়া দেশটিতে অনেক প্যারামিলিশিয়া সদস্যও রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক কিংবা অভ্যন্তরীণ যেকোন নীতিতে উত্তর কোরিয়ানরা সামরিক শক্তিকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
পঞ্চাশের দশকে যখন দুই কোরিয়ার মাঝে উত্তেজনা বাড়তে থাকে তখন সীমান্তবর্তী রাশিয়া ও চীন মার্কিন বিরোধী নীতির ফলে এবং আদর্শগত ঐকের দরুণ উত্তর কোরিয়ারকেই সমর্থন করেছিলো। এমনকি এখনো পর্যন্ত বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্ক বলতে চীন এবং রাশিয়াকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় উত্তর কোরিয়া। তবে পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়নের ফলে চীন-কোরিয়া সম্পর্কে প্রায়ই শীতলতাও দেখা যায়। ২০০৬ সালে যখন উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় তখন অন্যান্য পশ্চিমাদের সাথে চীনও জাতিসংঘে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছিলো। তবে সম্প্রতি সময়ে ২০১১ সালে উত্তর নেতৃত্বে কিম জং উন এবং চীনের নেতৃত্বে শি জিনপিং আসার পর সম্পর্কের উন্নয়নের আভাস পাওয়া যায়। বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হলো চীন। আমদানীর প্রায় অর্ধেকই আসে চীন থেকে এবং রপ্তানির একটি উল্লেখ্যযোগ্য অংশও চীনে রপ্তানি করে উত্তর কোরিয়া। এছাড়া ২০১৯ সালে কিম জং উন সস্ত্রীক চীন সফরে যান এবং একই বছর প্রেসিডেন্ট শি উত্তর কোরিয়া সফরের পূর্বে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, "আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যতটা পরিবর্তনই আসুক না কেনো চীন সব সময় উত্তর কোরিয়ার পাশে আছে।"
বিশ্লেষকগণ মনে করেন, চীন কখনই চাইবে না উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া একত্রিত হোক। কেনোনা যদি উভয় কোরিয়া এক হয় এবং দক্ষিণ কোরিয়ার উছিলায় সেখানে মার্কিন পদচারণা পড়ে, সেটা নিঃসন্দেহে হবে চীনের জন্য একটি খারাপ সংবাদ। কারণ চীনের সাথে উত্তর কোরিয়ার ১,৪১৬ কিলোমিটার লম্বা সীমানা রয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই চীন সব সময়ই চাইবে উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক শাসক স্থায়ী হোক। আর যেহেতু বিশ্বায়নের যুগেও উত্তর কোরিয়া অনেকটা বিছিন্নভাবেই বেঁচে আছে, তাই চীনের সমর্থন ছাড়া সম্পূর্ণভাবে "আইসোলেশনিস্ট" হয়ে চলাও কঠিন হয়ে যাবে দেশটির জন্য। অন্যদিকে, আবার 'বাফার স্টেট' হিসেবে উত্তর কোরিয়াকেও চীনের প্রয়োজন। অর্থাৎ, মিউচ্যুয়াল ইন্টারেস্টের জায়গা আছে এখানে। তবে উত্তর কোরিয়া চীনের উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে পড়তে চায় না বলেই হয়ত পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে ঝুঁকেছে। এইদিক দিয়ে দেশটি বেশ চতুরতার পরিচয় দিলেও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক আবরোধ দেশটিকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মারাত্মকভাবে পিছিয়ে দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশগুলোর একটি হলো উত্তর কোরিয়া, যেখানে যত্রতত্রই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটে।
তবে সম্প্রতি অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন দাদা কিম ইল সাং এবং বাবা কিম জং ইলের পর কিম পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্র ও বর্তমান শাসক কিম জং উন উত্তর কোরিয়াকে আধুনিকায়নের দিকে নিয়ে যাবেন। ইতোমধ্যে বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে প্রেসিডেন্ট কিম আগ্রহও দেখিয়েছেন। পার্শ্ববর্তী রাশিয়ার সাথেও উত্তর কোরিয়ার রয়েছে বেশ উষ্ণ সম্পর্ক। আদর্শগত ঐক্যের দরুণ দেশটির জন্মলগ্ন থেকেই রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে। কোরিয়া যুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া উত্তর কোরিয়াকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছিলো সবচেয়ে বেশি। সে সুসম্পর্ক এখন অব্দি বর্তমান।
অন্যদিকে আবার, চীন-উত্তর কোরিয়া সুসম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র নিজের জন্য, প্রশান্ত মহাসাগরে তার ঘাঁটি গুয়াম ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য হুমকি মনে করে। ফলে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া সীমান্ত, যা মিলিটারি ডিমার্কেশন লাইন হিসেবে পরিচিত সেখানে ভারী সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ কোরিয়া। ২০১৮ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও প্রেসিডেন্ট কিমের মাঝে সিঙ্গাপুরের সন্তোষে এক বৈঠক হয়েছিলো উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দ্যশে। প্রেসিডেন্ট কিম তখন সাময়িক সময়ের জন্য পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় আবারও পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে শুরু করে উত্তর কোরিয়া। এবছরের শুরুতে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরপরই প্রেসিডেন্ট কিম যুক্তরাষ্ট্রকে উত্তর কোরিয়ার প্রধান শত্রু হিসেবে ঘোষণা দেন। বলা বাহুল্য, এমন ঘোষণা নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে বেশ দুঃশ্চিন্তার মুখে ফেলেছে। কিমের কাছ থেকে এমন ঘোষণা আসার পরই বিশ্লেষকগণ অপেক্ষায় ছিলেন মার্কিন প্রতিক্রিয়া ও পদক্ষেপের। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন কর্তৃক জারীকৃত নতুন নিরাপত্তা কৌশলপত্রে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে তেমন স্পষ্ট নীতির উল্লেখ পাওয়া যায়নি। শুধু বলা হয়েছে পিয়ংইয়ং এর পরমাণু এবং মিসাইল প্রকল্পের বিরুদ্ধে মার্কিন কূটনীতিকদের অবস্থান দৃঢ় করতে হবে।
উত্তর কোরিয়ার দাবি, তাদের কাছে এমন সব ক্ষেপণাস্ত্র আছে যা দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এমনকি মার্কিন ভূখণ্ডে পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম। এছাড়া একটি হাইড্রোজেন বোমাও রয়েছে তাদের। মূলত এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়াকে নজরে রাখে সব সময়। তবে উত্তর কোরিয়া এবছরের শুরুতেও ঘোষণা দিয়েছে যতদিন না পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র তার বৈরী নীতি (Hostile policy) বর্জন করছে ততদিন পর্যন্ত উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে কোনো সমঝোতায় আসবে না। বরং দেশটি তার পারমাণবিকীকরণকে নিবারণ নীতি (Deterrence policy) হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছে।
উদ্বেগের বিষয় হলো যদি সত্যিই মার্কিন ভূখণ্ড পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম এমন পারমাণবিক অস্ত্র উত্তর কোরিয়ার কাছে থেকে থাকে তাহলে সেটা নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক শান্তির ক্ষেত্রে বড় ধরণের ঝুঁকি। তবে দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপানের ভূখণ্ডে আঘাত হানতে পারে এমন সক্ষমতা যে উত্তর কোরিয়ার অর্জন করেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই পূর্ব এশিয়া তথা বৈশ্বিক পারমাণবিক উত্তেজনা কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে উত্তর কোরিয়ার সাথে পুনরায় আলোচনা শুরু করা। ২০১৮ সালের সিঙ্গাপুর ঘোষণার ভিত্তিতেও এ আলোচনা নতুন করে শুরু করা যেতে পারে। এতে করে কোরিয়া উপদ্বীপে উত্তেজনা কমার সাথে সাথে উত্তর কোরিয়ার বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে, দেশটির মানবাধিকারেরও উন্নয়ন হবে বলে আশা করা যেতে পারে। তবে এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপার তা হলো দেশটির উপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধে শিথিলতা। সেটা নিঃসন্দেহে দেশের সাধারণ জনগণের জন্য হবে আশীর্বাদস্বরূপ।
- লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
- ইমেইল: [email protected]