কোয়াড ঘিরে ভূ-রাজনীতি: কেমন হওয়া উচিত বাংলাদেশের অবস্থান
কোয়াড্রিলেটারাল সিকিওরিটি ডায়লগ যা সংক্ষেপে কোয়াড নামে পরিচিত, সম্প্রতি এই অনানুষ্ঠানিক সংলাপ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বেশ হৈ চৈ তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত সমন্বিত কোয়াডের প্রধান উদ্দেশ্য ইন্দো প্যসিফিক অঞ্চলকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরো কার্যকরী করে তুলতে এ অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, অবাধ বাণিজ্য ও নৌ চলাচলসহ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নানামুখী সহযোগীতার ক্ষেত্র গড়ে তোলা হলেও চীন এটাকে নিজের বিরুদ্ধে হুমকি হিসেবেই দেখছে। যদিও কোয়াড সামিটে বা কোথাও কোনো বিবৃতে চীনের নাম উল্লেখ করা হয়নি, তথাপি চীন কোয়াডকে ভারত-প্রশান্ত মহসাগরীয় অঞ্চলে চীনের জাতীয় স্বার্থ বিরোধী একটি দল হিসেবেই উল্লেখ করেছে এবং বাংলাদেশকে এমন দলের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার ব্যাপারে ইতোমধ্যে হুঁশিয়ারিও জানিয়েছে।
২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভূমিকম্প ও সুনামির প্রেক্ষিতে গঠিত কমিটি সর্বপ্রথম কোয়াডের ধারণা দেয়। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে আনুষ্ঠানিকভাবে কোয়াডের প্রস্তাব উত্থাপন করেলেও বিগত প্রায় এক দশক যাবত এই সংলাপ প্রায় ঘুমন্ত অবস্থাতেই ছিলো। কিন্তু ২০১৩ সালে শি জিনপিং চীনের ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নামে অর্থনৈতিক যে মহাকর্মযজ্ঞ হাতে নেন, অনেকটা তার জবাব হিসেবেই ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া অঞ্চলে তার তিন মৈত্রী রাষ্ট্র নিয়ে নতুন করে কোয়াড আলোচনা শুরু করে।
গেলো মাসের ১২ তারিখে অনুষ্ঠিত চার দেশীয় ভার্চ্যুয়াল কোয়াড সামিট চীনকে বেশ বিচলিত করে তুলেছে, যার প্রমাণ বাংলাদেশের কোয়াডে যোগ দেয়া, না দেয়ার ব্যাপারে চীনের রাষ্ট্রদূতের প্রতিক্রিয়ায় পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং গত ১০ ই মে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, বাংলাদেশ কোয়াডে নাম লেখালে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের অবনতি হবে। এর আগে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদকে কোয়াড নিয়ে চীনের উদ্বেগের কথা ব্যক্ত করলেও বাংলাদেশ সেখানে নীরব শ্রোতার ভূমিকা পালনের পথই বেছে নিয়েছিলো।
তবে চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন নিরপেক্ষতার নীতির কথাই উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি "সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়" (Friendship to all, malice to none), এখনও পর্যন্ত এইদেশের বিদেশনীতির মূল ভিত্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর রাজনৈতিক বিশ্ব যখন পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দুই ব্লকে ভাগ হয়ে যায়, তখন সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ নিরপেক্ষতার নীতির ভিত্তিতেই ১৯৭৩ সালে যোগদান করে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে (Non-aligned Movement)। জন্ম লগ্ন থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ নিরপেক্ষতার নীতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
তবে কোয়াড প্রশ্নে চীনের আচরণের প্রেক্ষিতে তিনদিক দিয়ে ভারত বেষ্টিত বাংলাদেশকে হয়ত এখন কিছুটা নড়েচড়ে বসতে হবে। চীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় প্রধান বিনিয়োগকারী দেশ। ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে যতগুলো প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে তার প্রায় এক তৃতীয়াংশই চীনের কোম্পানিগুলোর হাতে গিয়েছে। এছাড়া ২০১৯ সালে বাংলাদেশের সবোর্চ্চ বৈদেশিক বিনিয়োগকারী দেশও চীন। সামরিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রেও চীনের অবদান রয়েছে যথেষ্ট। সাবমেরিন, অস্ত্র সরঞ্জাম ও আধুনিক প্রযুক্তি ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে চীনের নাম তালিকার একদম শীর্ষে। করোনা ভাইরাসের টিকার সংকটের মুহূর্তে আজ (১২ মে, ২০২১) চীন ৫ লক্ষ করোনা ভ্যাকসিন ও সুরক্ষা সরঞ্জাম উপহার দিয়েছে। তাই চীনকে অসন্তুষ্ট করে বাংলাদেশ কোনো সিদ্ধান্ত নিলে যে সেটা নেহাত দেশের স্বার্থ খর্ব করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ এমন কোনো সিদ্ধান্তও নিতে পারবে না যেটাতে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র বা এই জোটের মিত্রদের স্বার্থে আঘাত হানে। কেনোনা, বাংলাদেশ তিন দিক দিয়েই ভারত বেষ্টিত। তাই চীনের সাথে সাথে ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশকে একটি ভারসাম্য কূটনীতি (Balance Diplomacy) বজায় রাখতে হবে।
মূলত ভারতের সাথে সীমানা থাকায় ও বঙ্গপোসাগরের সহজলভ্যতার কারণে বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। আর এই কৌশলগত সুবিধা লুফে নিতেই বাংলাদেশের প্রতি চীনের এতটা আগ্রহ। যেহেতু চীন ও ভারত ঐতিহাসিককাল থেকেই চির প্রতিদ্বন্দী দেশ, সেহেতু ভারতের উপর চাপ বজায় রাখতে বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানের কৌশলগত সুবিধা চীন কোনোভাবেই হাত ছাড়া করতে চায়না। আর ঠিক এ কারণেই কোয়াডে বাংলাদেশের যোগদানের সংশয়ে চীন এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
তবে চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং গত দিনের এমন বক্তব্যের জন্য আজ (১২ মে, ২০২১) আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকেই এটা স্পষ্ট করা হয়েছে যে, অর্থনৈতিক, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সংক্রান্ত জোট ব্যতীত কোনো ধরণের সামরিক জোটে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে প্রায় ১৫ দিনের যুক্তরাষ্ট্র সফর, এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি জন কেরি বাংলাদেশ সফর এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে ভারতের সেনা প্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নরভানেক বাংলাদেশ সফর করেছেন। মূলত অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের হাই প্রোফাইল্ড ব্যক্তিদের সাক্ষাৎ চীনকে হয়ত কিছুটা বিচলিত করে তুলেছিলো, যার কারণে প্রতিক্রিয়া হিসেবে চীনা রাষ্ট্রদূতের এমন আগ্রাসী বক্তব্যের শিকার হতে হলো বাংলাদেশকে।
তবে এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, কোয়াডের ব্যাপারে চীনের এমন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ফলে কোয়াড জোট এখন চীনকে চাপে রাখার জন্য আরো দ্রুত গতিতে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। এ অঞ্চলে তাদের তৎপরতা আরো বাড়িয়ে দিবে। প্রতিদ্বন্দ্বীকে যথা সম্ভব চাপে রাখা, এটাই মূলত রাজনীতির খেলা। আর এই খেলার ময়দানে বাংলাদেশকে থাকতে হবে সতর্ক, যেনো কোনো নীতি বা বক্তব্য কোনো দেশ বা জোট ঘেঁষা হয়ে না যায়। কারণ বাংলাদেশ এখন অনেকটা উভয় সংকট পরিস্থিতিতে অবস্থান করছে। তবে কৌশলগতভাবে যেহেতু ভারত ও চীনের কাছে বাংলাদেশের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে তাই বাংলাদেশের সামনে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায়ও অনেক কৌশলত সুযোগ আসবে। এক্ষেত্রে উভয় দেশের সাথে ভারসাম্য কূটনীতি বজায় রেখে সেসব সুযোগকে কাজে লাগানোই হবে বাংলাদেশের দক্ষ কূটনৈতিক দৃষ্টান্ত।
অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগীতার কথা বলা হলেও কোয়াড প্রধানত একটি সামরিক জোট হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছে। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরে কোয়াড জোটের সামরিক উপস্থিতির মাধ্যমেই অন্যান্য সহযোগীতার ক্ষেত্র গুলো এখানে নির্ধারিত হবে। তবে এই জোটের সাফল্য অনেকটা নির্ভর করছে ভারতের উপর। কেনোনা, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জাপানের এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পর্ক রয়েছে বেশ আগে থেকেই। জোটের সদস্যদের মধ্যে শুধুমাত্র ভারতই এর ব্যতিক্রম। আর চীনকে চাপে রাখাতে হলে ভারত মহাসাগরেই এই জোটের প্রধান তৎপরতা চালাতে হবে। এক্ষেত্রে কোভিড সংক্রামণে দিশাহারা ভারত এই মুহূর্তে কোয়াডকে ঠিক কতটা কার্যকর করে তুলতে পারবে সেটা ভাববার বিষয়। এছাড়া অর্থনীতি ও সামরিক অবস্থানেও চীন ভারতের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে। সেই সাথে আঞ্চলিক অন্যান্য দেশও, যেমন বাংলাদেশ, মিয়ানমার কোয়াডের ক্ষেত্রে চীনের পক্ষেই থাকবে বলে ধারণা করা যায়। সব মিলিয়ে চীনের বিস্তারনীতিকে প্রতিহত করতে কোয়াডের ভবিষ্যৎ সফলতা অনেকটা সংশয়ে ঘেরা। তবে জোটভুক্ত দেশগুলো কোয়াডের গঠনতন্ত্র, বিস্তারিত কার্যক্রম, পরিচালনা নীতির মত বিষয়গুলো এখনো সম্পূর্ণরূপে খোলাসা করেনি। এ বিষয়গুলো জনসম্মুখে আসতে আসতে হয়ত চীনও বসে থাকবেনা। কোয়াডকে প্রতিহত করতে চীন যে নতুন কোনো ভূরাজনৈতিক খেলা নিয়ে ময়দানে দ্রুতই হাজির হবে সেটা চীনের বর্তমান অবস্থানের প্রেক্ষিতে মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
- লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
- ইমেইল: [email protected]