চিকিসৎককে প্রশ্ন করা যাবে, তবে…
ধরা যাক আপনার ডায়াবেটিস অনেক বেড়ে গেছে। রক্তে সুগার মেপে চৌদ্দ বা পনেরো মিলিমোল দেখে আপনার মাথা খারাপ হবার দশা। ছুটে গেছেন আপনার ডাক্তারের কাছে। তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন যে এবার ইনসুলিন লাগবে, ওষুধে আর চলছে না। স্বাভাবিকভাবেই এটা মানতে আপনার কষ্ট হচ্ছে, মন:পুত হচ্ছে না ইনসুলিন দেবার বিষয়টা। হাজার হোক রোজ চামড়া ফুটো করে একটা ইনজেকশন দেবার হ্যাপা। তো আপনি প্রথমে গাঁইগুই করলেন। ইনসুলিন না দিয়ে কি আর একটু চেষ্টা করা যায় কিনা তা জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু চিকিৎসক অনড়। ইনসুলিন দিতেই হবে। এটাই শেষ কথা। কারণ 'আপনি' অর্থাৎ রোগী নিশ্চয় বেশি বোঝেন না, আর 'তিনি' বা চিকিৎসক যেহেতু এক্সপার্ট, তিনি এ ব্যাপারটা আপনার চাইতে বেশি বোঝেন সেটাই স্বাভাবিক। সে কারণে তার সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত। এক্ষেত্রে আর দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ নেই।
এইখানে আমাদের মেডিকেল প্রাকটিসে হেলথ লিটারেসির অভাবের প্রকটতা খুবই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। হেলথ লিটারেসি আর হেলথ এডুকেশন কিন্তু এক জিনিস নয়। আমরা এখন হেলথ এডুকেশন বা স্বাস্থ্য শিক্ষার ওপর জোর দিতে শিখেছি বই কি। যেমন-একজন ডায়াবেটিসের রোগীকে কীভাবে খেতে হবে, চলতে হবে, দিনে কত মিনিট হাঁটবেন, কয় কাপ ভাত খাবেন, কীভাবে ইনসুলিন ইনজেকশন নেবেন, কীভাবে বাড়িতে সুগার মাপবেন-ইত্যাদি আজকাল শিখিয়ে দেয়া হয়। ডায়েট চার্ট হাতে দেয়া হয়। জীবনযাপন প্রণালী সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া হয়। এটা হল হেলথ এডুকেশন। মানে স্বাস্থ্যশিক্ষা। এটুকুতেই আমরা খুশি। কারণ আমরা রোগীকে অনেক জ্ঞান দিতে পেরেছি। রোগ সম্পর্কে শিক্ষিত করে তুলতে পেরেছি। আমাদের রোগীরাও বেশ আধুনিক হয়ে উঠছেন। গুগল করেই তারা জানতে পারেন কোন খাবার খেলে ইউরিক এসিড বাড়ে বা কিডনির রোগীর কী কী খাওয়া বারণ। আমরা এমনকি লিফলেট পড়ে বা ইন্টারনেট ঘেঁটে ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো জেনে ফেলেছি। কিন্তু এই জানা আর হেলথ লিটারেসি এক কথা নয়।
আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কেবল হেলথ এডুকেশন নয়, হেলথ লিটারেসিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। হেলথ লিটারেসি হল আপনার রোগ ও তার চিকিৎসা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করার একটি প্রক্রিয়া, যাতে আপনি নিজে চিকিৎসা বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেবার বা বেছে নেবার অধিকার লাভ করতে পারেন, অংশীদার হতে পারেন চিকিৎসা পদ্ধতির।
উদাহরণ দেয়া যাক। আপনার কেন ইনসুলিন দরকার, তার বদলে ওষুধ খেতে থাকলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসার সম্ভাবনা কতটা কম, ইনসুলিনের চেয়ে ওষুধ বাড়িয়ে খাবার কারণে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে, আর দ্রুত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না এলে এর বিরূপ প্রভাব কী কী পড়তে পারে আপনার শরীরের ওপর-এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানবার পর হয়তো আপনি নিজেই ইনসুলিনের পক্ষে মত দেবেন। কিন্ত তখন এ সিদ্ধান্ত আপনার ওপর চাপিয়ে দেয়া আর মনে হবে না। কারণ আপনি নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন। জেনে বুঝে আর সম্যক জ্ঞানের আলোকে। এই সিদ্ধান্তের দায় তখন আর চিকিৎসকের একার নয়। আরও আছে। আপনাকে যদি বলা হয় যে অনেক রকমের ইনসুলিন আছে বাজারে। দেশি, বিদেশি। কোনটা আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন, কোনটা পুরনো সিস্টেম। কোনটা দামি, কোনটা একটু কম দাম। এমনকি বার বার সুইঁ ফুটাতে হয় না এমন সার্বক্ষণিক পরিবহনযোগ্য ইনসুলিন পাম্পও আছে। এখন কোনটার কি সুবিধা আর অসুবিধা, কোনটার কত ব্যয় ইত্যাদি বিস্তারিত জানার পর আপনি নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কোন ধরণের ইনসুলিন নেবেন। এমন নয় যে চিকিৎসক খস খস করে প্রেসক্রিপশনে যেটি লিখলেন সেটি নিতে আপনি বাধ্য। আপনাকে অপশনগুলো বুঝিয়ে বলা হল। এই যে পুরো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আপনি গেলেন-এটা হল হেলথ লিটারেসি।
তো বাংলাদেশের সিস্টেমে আমার প্রথমেই ধরে নিই যে রোগী অশিক্ষিত বা ইলিটারেট, তাদের পক্ষে এত জটিল জিনিস বোঝা মুশকিল, তাই সব কিছু বোঝাতে গেলে বিপদ। এমনিক শিক্ষিত মানুষের পক্ষেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের জটিল ভাষা বোঝা মুশকিল। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা উল্টো। যত বেশি আমাদের রোগীর হেলথ লিটারেসি উন্নত হবে, তত চিকিৎসকের ওপর অভিযোগের চাপ কমবে। কারণ তখন সিদ্ধান্তগুলো আর চিকিৎসকের একার থাকে না। রোগী নিজে এর ভাল মন্দের অংশীদার। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে হেলথ লিটারেসির অভাব যত প্রকট যে সমাজে, সেখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তত বেশি বিশৃঙ্খল, মানুষ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর তত কম আস্থাবান, আর সুস্বাস্থ্য লাভে সফলতার হারও তত কম।
এটা ঠিক যে হেলথ লিটারেসি বাড়াতে হলে মানুষের মধ্যে সাধারণ লিটারেসির হারও বাড়াতে হবে। কমাতে হবে অশিক্ষা আর কুসংস্কার। তারপরও রোগী যতই অশিক্ষিত ও পিছিয়ে পড়া হোক না কেন, তাকে কিছু না কিছু বিষয়ে অংশীদার করাই যায়। এটা অসম্ভব নয়। শিক্ষার অভাব ছাড়াও এ ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় দুটো জিনিস। এক, চিকিৎসক ভাবেন যে রোগীকে এত কথা বলে লাভ নেই, তিনি এসব বুঝবেন না। শুধু শুধু সময় নষ্ট। রোগী ভাবেন এত কিছু বুঝে আমার লাভ কি, ডাক্তারের দায়িত্ব আমাকে সুস্থ করে তোলা। তিনি যা বলবেন আমাকে তাই করতে হবে।
আর দ্বিতীয় কারণটি হল সময়ের অভাব। ধরুন যে সরকারি হাসপাতালের বর্হিবিভাগে বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে একজন চিকিৎসক এক দিনে আড়াইশ জন পর্যন্ত রোগী দেখতে বাধ্য হচ্ছেন, তার কাছে রোগীকে 'লিটারেট' করে তোলার আশা করাই বোকামি। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে হেলথ লিটারেসি বাড়ানোর চেষ্টা সম্মিলিতভাবেই করা যায়। ২০১৬ সালে সাংহাই ডিক্লারেশনে এসডিজি গোল পূরণের জন্য সমাজে হেলথ লিটারেসি বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়েছে। অথচ আমরা যে এতে চরমভাবে ব্যর্থ তার প্রমাণ এই কোভিড১৯ অতিমারি। কেবল জনগণকে মাস্ক পরাতে গিয়েই সরকার হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। জরিমানা করে, কান ধরিয়েও লাভ হচ্ছে না। নিজের ভাল নিজে না বোঝার এই একগুঁয়েমি প্রবণতা, বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাকে গ্রহণ না করে উড়িয়ে দেবার সংস্কৃতি আর গুজব ও ভ্রান্তির প্রতি আকর্ষণ-এই ভয়াবহ শত্রুগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য আগে মানুষকে হেলথ লিটারেট করে তুলতে হবে। অথচ আজ থেকে অনেক আগে স্যানিটারি টয়লেট বা ওরস্যালাইন নিয়ে লিটারেসি আন্দোলন এই দেশেই কি চমৎকার ভাবে সফল হয়েছিল।
আবার হেলথ লিটারেসি মানে এও নয় যে আপনি গুগল করে বা ইন্টারনেট ঘেঁটে, কিংবা একে ওকে জিজ্ঞেস করে নানা মানুষের মতামত নিয়ে বিজ্ঞ হয়ে উঠবেন। ইন্টারনেট এর সব তথ্যই সত্য নয়, বিজ্ঞানসম্মতও নয়। তথ্য সংগ্রহে সাবধানী হতে হবে। বর্তমানে লিটারেসির অন্যতম শত্রু হল এই গুজব বা ভ্রান্ত তথ্য। ইনফোডেমিক। তথ্য পাবার জন্য ইন্টারনেট বা পাড়া প্রতিবেশির ওপর নির্ভর না করে আপনি আপনার চিকিৎসক বা স্বাস্ত্যকর্মীকেই বেছে নিতে পারেন। এই টেস্টগুলো করলে আসলে কি বোঝা যাবে, বা কেন আমাকে এই ওষুধ টি দেয়া হচ্ছে, এই ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে-চিকিৎসককে এসব প্রশ্ন করা কোন অপরাধ নয়। আপনার চিকিৎসক এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য। আর এতে আপনাদের মধ্যে দুরত্ব কমবে, কমবে ভুল বোঝাবুঝির প্রবণতা। ওষুধটা খেয়ে কোন সমস্যা হলে আপনি তখন জানবেন এটা হতেই পারে আর আপনার চিকিৎসকও নির্ভার বোধ করবেন কারণ এ বিষয়ে তো আগেই বলা হয়েছে।
কোন কোন ক্ষেত্রে এ ধরণের লিটারেসি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ক্যানসার চিকিৎসায়। আপনি যদি জানতে পারেন যে এই কেমোথেরাপির পর আপনার সারভাইবাল ৪ মাসের জায়গায় বড়জোর ৬ মাস হবে কিন্তু তার বিনিময়ে আপনাকে একটা দু:সহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে-তাহলে আপনি দু'মাস বেশি বেঁচে থাকার আশায় এটা নেবেন কিনা সে সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবে নিতে পারেন। কিংবা নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে আপনার আপনজনটিকে ভেন্টিলেটরে দেবার পর তার ফিরে আসার সম্ভাবনা কত শতাংশ জানতে পারলে আপনি সহজে একটি যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবেন।
নিজের শরীর আর স্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা আর রোগ নিণর্য় বা চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা কেবল আপনার অধিকারই নয়, জরুরিও বটে। সেবাগ্রহীতা আর সেবাদানকারী উভয়ের জন্যই সুফল বয়ে আনে এটি।
- লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনলজি