দেশের শিশু-কিশোর সংগঠন সব গেল কোথায়?
মুকুল ফৌজ, খেলাঘর আসর, কচিকাঁচার মেলা, চাঁদের হাট এই নামগুলোর সঙ্গে পরিচিত নয় এরকম কোনো সত্যিকার শিক্ষিত মানুষ সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না দেশে। শুধু তা-ই নয়, শৈশব-কৈশোরের কোনো না কোনো পর্বে এইসব শিশু-কিশোর সংগঠনের কোনোটার সদস্য কিংবা তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন না, এরকম মানুষের সংখ্যাও আমাদের প্রগতিশীল, সংস্কৃতিলগ্ন সমাজে খুব কমই হবে। বাংলাদেশের সমাজ, ইতিহাস, উত্থান এবং জাতিগঠনের পেছনে এই সংগঠনসমূহ ও তাদের সভ্যদের গুরুত্বপূর্ণ, গৌরবময় ভূমিকা রয়েছে। অথচ এখনকার শিশু, কিশোর, তরুণ এমনকি মাঝবয়সীদেরও অনেকেই এই সংগঠনসমূহের অস্তিত্ব ও তাদের কার্যকলাপ বিষয়ে একেবারেই অবগত নয় বলেই আমার ধারণা। এর কারণ, বাস্তবে এখন আর এই সংগঠনগুলোর তেমন কোনো জোরালো অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। কোথায় হারিয়ে গেল তবে একদা দেশব্যাপী তৎপর এই সুবিশাল ও সদাসক্রিয় শিশু-কিশোর সংগঠনগুলো? আর কেন বা কোন প্রক্রিয়াতেই বা হারিয়ে গেল সমাজের সুস্থ ও সুষম বিকাশের জন্য অত্যন্ত জরুরি এরকম সামাজিক সংগঠনসমূহ? একটু ভেবে দেখা যাক তবে।
লক্ষ করুন, উপরোক্ত চারটি শিশু সংগঠনেরই সূত্রপাত হয়েছিল যথাক্রমে আজাদ, সংবাদ, ইত্তেফাক ও পূর্বদেশের মতো চারটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকার শিশুদের বিভাগকে কেন্দ্র করে। আর এগুলো পরিচালনা করতেন শিশুসাহিত্যিক মোহাম্মদ মোদাব্বের, কবি হাবীবুর রহমান, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই এবং রফিকুল হক দাদুভাইদের মতো প্রগতিশীল ধ্যানধারণার অধিকারী, সৃজনশীল ও সংস্কৃতিমনস্ক মহাপ্রাণ মানুষেরা। মুকুল ফৌজের মাতৃসংগঠন মুকুলের মাহফিল নামটি দিয়েছিলেন খোদ কাজী নজরুল ইসলাম, পরবর্তীকালে যে-সংগঠনটির পরিচালক হয়েছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান এবং বিজ্ঞানী ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীনের মতো দিকপাল ব্যক্তিত্বরা। এই সংগঠনগুলোর নেপথ্যে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন। মুকুল ফৌজ এর অনেক সদস্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ও পরবর্তী সময়েও দেশগঠনের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আর খেলাঘর আসর তো সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির একটি অঙ্গসংগঠনই ছিল।
অন্যদিকে এখনকার বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমানে আমাদের প্রধান দৈনিক পত্রিকাগুলো সব বকলমে একেকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান; সাহিত্য, সমাজ কিংবা জাতিগঠন নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই, থাকার কথাও নয়। সত্যি বলতে কি, অধিকাংশ পত্রিকা থেকে শিশুদের পাতাটি একেবারে উঠেই গেছে, যে-কয়টিতে এখনও টিকে আছে, সেগুলো স্রেফ নামকাওয়াস্তে। আর প্রগতিশীল তথা বামদলগুলো নিজেরাই এখন রীতিমতো অস্তিত্ব-সংকটে ভুগছে, এসব নিয়ে তাদের মাথা ঘামানোর সময় কিংবা সুযোগ কোথায়!
ফল যা হবার তা-ই হয়েছে। দেশের জনগোষ্ঠীর একটা সুবৃহৎ ও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ অংশ, জাতির ভবিষ্যৎরূপী এই শিশু-কিশোরেরা আমাদের সম্মিলিত অবহেলা, অবজ্ঞা ও উপেক্ষার শিকার হয়ে এখন বলতে গেলে একটি অনাথ, অভিভাবকহীন প্রজন্মে পর্যবসিত হয়েছে। তাদের দিকে চেয়ে দেখার, তাদের কথা ভাবার এবং তাদের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য আন্তরিকভাবে কিছু করার জন্য কোথাও কেউ নেই আজ! তাদের বাবা-মায়েরা ব্যস্ত বৈধ, অবৈধ পথে বিত্তার্জন আর সংসারের পার্থিব জৌলুস বৃদ্ধির নিরন্তর ইঁদুরদৌড়ে; শিক্ষকেরা মগ্ন ক্লাসঘরের বাইরে যথেচ্ছ কোচিং, ট্যুশন করে টুপাইস কামানোর ধান্দায়, আর খোদ রাষ্ট্র লিপ্ত এইসব কোমলমতি শিশু-কিশোরদেরকে গিনিপিগ বানিয়ে, শিক্ষাব্যবস্থার নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষার নামে তাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করার কাজে।
বিগত বছরগুলো গেছে এমসিকিউ, সিজিপিএ, পিএসসি, জেএসসি পরীক্ষা আর সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরি ও ফাঁসের ডামাডোলের মধ্য দিয়ে। তারপর এলো করোনা! এবং যথারীতি এরও সবচেয়ে সহজ ও করুণতম শিকার হলো, দেশজুড়ে আমাদের অগণিত শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরাই। টানা দেড়টি বছর ধরে এদের স্কুল কলেজ খোলার কোনো নামগন্ধ নেই; তথাকথিত অনলাইন ক্লাসের এক চলমান প্রহসনের নামে শিক্ষার মতন একটি সার্বজনীন অধিকারের বেলায়ও গ্রাম-শহর আর ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানটুকু আরেক প্রস্থ বাড়ানোই হয়েছে সার; এসএসসি, এইচএসসি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলো বন্ধ রেখে, কখনো অটোপ্রমোশন কখনোবা অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতির মুলো ঝুলিয়ে এদের শিক্ষার বারোটাই বাজানো হচ্ছে কেবল; তবু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কুম্ভনিদ্রার অবসান কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থার টনক নড়তে দেখছি না আমরা এখনও।
কথায় কথায় কিঞ্চিৎ প্রসঙ্গান্তরই ঘটে গেল বুঝি। কেননা এই নিবন্ধের উপজীব্য ঠিক করোনাকালে আমাদের শিশু-কিশোরদের শিক্ষা নয়, বরং শিক্ষারই আরেকটি অনিবার্য অনুষঙ্গ সংস্কৃতি ও সমাজবোধ নিয়ে, যার সূচনাটুকু হতে হয় একেবারে শিশুকাল থেকেই। আর ঠিক এই কাজটিই আমাদের দেশে এতকাল ধরে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এবং নিঃস্বার্থভাবে করে আসছিল উল্লেখিত শিশু-কিশোর সংগঠনসমূহ। এদের কল্যাণেই আমাদের ছেলেমেয়েদের অন্তত একটি অংশ এতদিন কিছুটা হলেও পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়া, হাতে-লেখা দেয়ালপত্রিকায় একটু আধটু লেখালেখির চর্চা, অবসরে খানিকটা গান-বাজনা-নাটক করা, ছবি আঁকা, খেলাধুলা, শরীরগঠনের সুযোগ এবং সেইসঙ্গে শৃঙ্খলাবোধ, প্রকৃতিপ্রেম, সমাজসেবা আর মানবিকতার দীক্ষা পেত জীবনের প্রারম্ভপর্বেই।
কিন্তু এই শতকের গোড়া থেকেই, সম্ভবত বিশ্বায়ন আর পুঁজি ও প্রযুক্তির অন্ধ আগ্রাসনের প্রভাবে, এর মধ্যে একটা ভাটার টান লক্ষ করতে থাকি আমরা। প্রগতিশীল রাজনীতিতে ধস নামার কারণে তাদের সেইসব নিঃস্বার্থ, স্বেচ্ছাসেবক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কর্মীরা একদিকে হতাশা আর অন্যদিকে জীবিকার টানে হারিয়ে গেল মূলত এনজিও-পেশার আত্মঘাতী আবর্তে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রেণিবৈষম্যের শেকড় গেড়ে বসলো শক্তভাবে: বিত্তবানের ছেলেমেয়েরা ইংরেজিমাধ্যমের বিজাতীয়পনা, গ্রামীণ ও শহুরে নিম্নবিত্তের সন্তানেরা মধ্যযুগীয় মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষা আর মধ্যবিত্তের বংশধরেরা মুখস্থবিদ্যা ও পরীক্ষাপাশের কোচিংসংস্কৃতির অসহায় শিকার হয়ে শিক্ষার আদত উদ্দেশ্য থেকে সরে গেল যোজন দূরত্বে। তার সঙ্গে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যুক্ত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির অনিবার্য আগ্রাসন। বুড়োদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সব বয়সের বাচ্চারাও এখন লেখাপড়া ও অন্যান্য বয়সোপযোগী কাজকম্ম ভুলে, স্মার্টফোন আর ট্যাবের পর্দায় বুঁদ হয়ে ক্রমে আত্মকেন্দ্রিক, অসামাজিক ও পরিবার-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি নানাবিধ বদভ্যাস, পর্নাসক্তি, ভিডিও গেমের দুর্নিবার নেশার ফলে মানসিক অবসাদ ও অসুস্থতা, এমনকি অনৈতিক অনলাইন-অপরাধ চক্রে জড়িয়ে পড়ে ভয়ংকর, বিধ্বংসী সামাজিক সমস্যার জন্ম দিচ্ছে, যার অভিঘাত সামলাতে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছে বহু পরিবার ও সম্প্রদায়ের মানুষ।
এমতাবস্থায় এই শিশু-কিশোরদেরকে আবারও খেলার মাঠ, ক্লাব, পাঠাগার, সাংস্কৃতিক মঞ্চ, সংগঠনচর্চা, জাতীয় দিবসসমূহ পালন, ঋতুভিত্তিক ও অন্যান্য সামাজিক উৎসবসমূহে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ ও স্বদেশ অভিমুখী করে তোলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আর এই কাজগুলো করতে পারে উল্লেখিত শিশু সংগঠনগুলোর মতো বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ। ফলে আর বিলম্ব না করে, সবাই মিলে দেশজুড়ে শিশু সংগঠনগুলোকে পুনরায় গড়ে তোলার আন্দোলনকে জোরদার করতে হবে।
আমরা জানি, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই প্রয়াত হবার পর তাঁর হাতেগড়া সংগঠন কচিকাঁচার মেলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিশিষ্ট ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও সমাজচিন্তক ইব্রাহিম খালিদ। সেই কাজে তিনি যথেষ্ট সফলও হয়েছিলেন তাঁর একান্ত নিষ্ঠা ও নিবেদনের জোরে, কচিকাঁচার মেলা দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয়তার পরে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সপাটে। তাঁর উত্তরসূরিরা এই মহতী সংগঠনটির নবযাত্রাকে আরও বেগবান করে তুলবেন এই প্রত্যাশা আমাদের। আর বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টির সংগঠন খেলাঘর আসর এখন যদিও দ্বিধাবিভক্ত, তবুও তারাই এখনও দেশের সবচেয়ে সুসংগঠিত এবং সক্রিয় শিশু সংগঠন। আমি নিশ্চিত, পার্টি চাইলে তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নকে কাজে লাগিয়েই এই সংগঠনটিকে আরও শক্তিশালী, সুবিস্তৃত এবং সক্রিয় করে তুলতে পারে অনতিবিলম্বে। এবং সেটি করা তাদের এই মুহূর্তের একটি জাতীয় দায়িত্ব বলেই মনে করি।
পাশাপাশি সরকারেরও উচিত হবে ঢাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় শিশু একাডেমি এবং প্রতিটি জেলায় এর যে শাখাগুলো রয়েছে, সেগুলোকে আমলাতন্ত্রের খপ্পর থেকে বের করে এনে, সঠিক ও সুযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে পরিচালনার ভার ন্যস্ত করে, এই মূল্যবান অবকাঠামোটিকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করা। দেশব্যাপী শিশু-কিশোরদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক বিকাশের দিকে লক্ষ্য রেখে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে তার আশু বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হওয়া।
অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে, দেশ স্বাধীন হবার পরে খোদ বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে সূর্যসেনা নামে একটি জাতীয় শিশু-সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং কিছুদিন বেশ জোরেসোরেই তার কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। পঁচাত্তরের পৈশাচিক পটপরিবর্তনের পর বলাবাহুল্য সেই মহতী উদ্যোগটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছিল। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর ও জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে অত্যন্ত অর্থবহ নামের এই চমৎকার সংগঠনটিকে পুনরুজ্জীবিত করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া গেলে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে বলে আমার বিশ্বাস। আর এই কাজটির দায়িত্ব সারা দেশজুড়ে বিস্তৃত শিশু একাডেমি খুব সুচারু ও সুন্দরভাবেই পালন করতে পারবে বলে মনে করি। সবাই স্বীকার করেন শিশুরাই একটি জাতির প্রকৃত ভবিষ্যৎ। আমাদের সেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রকৃত শিক্ষা, সুরক্ষা ও সার্বিক সমৃদ্ধির জন্য এইটুকু বিনিয়োগ সরকার করবেন, একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি বিনীত এই আহ্বান রইলো।
লেখক: সাহিত্যিক ও অনুবাদক