পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসনের আশংকা!
এতদিন শাসকদল তৃণমূল যে অভিযোগ করে আসছিল সেই একই অভিযোগ করলো, বামফ্রন্টের শরিক সিপিআইএম। তারা বলছে, রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় বিজেপি'র লোক। তারা রাজ্যপালকে সাংবিধানিক সীমা লংঘনের অভিযোগ এনে তাকে কল ব্যাক করার দাবি তুলেছে। রাজ্যপাল সম্প্রতি উত্তরবঙ্গ সফর করেছেন, যেখানে কেবল বিজেপি নেতাকর্মীকে সফরসঙ্গী করেছেন। রাজ্যভবনে বিজেপি'র ৫০ জন বিধায়ক নিয়ে বৈঠক করছেন, এ সবই তার সাংবিধানিক সীমা লংঘন। সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে নৈতিক ও সরকারি প্রটোকল মেনে চলার কথা, তা করছেন না। সিপিএম অভিযোগ করছে, গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তিনি 'বিজেপি'র হয়ে কাজ করেছেন। এটা চলতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বিষিয়ে যাবে। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে প্রকাশ, রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে যখন নানা বিতর্কের ঝড় তখন তিনি দিল্লিতে নানা দরবারে ঘুরছেন। রাজ্যপালের এবারের দিল্লি সফরের ওপর রাজনৈতিক মহল নজর রাখছে। ধারণা করা হচ্ছে, আজকালের মধ্যে ফিরেই তিনি নতুন কোন ঘোষণা দিতে পারেন। কী সেই ঘোষণা? তবে কি তিনি রাষ্ট্রপতি শাসনের প্রস্তাব দিতে যাচ্ছেন? পশ্চিমবঙ্গ কি আবার প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের রাষ্ট্রপতি শাসনের অভিজ্ঞতা নিতে যাচ্ছে? কলকাতার এই গুঞ্জন একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
বস্তুত ভারতীয় শাসন ব্যবস্থায় রাজ্যপালের সাথে মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধ নতুন কিছূ নয়। কেন্দ্র এবং রাজ্য ভিন্ন দল হলে বিরোধ যে চরমে পৌঁছবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরের কাছে তীর্যকভাবে জানতে চেয়েছেন, 'আপনি কি সেকুলার হয়ে গেলেন! করোনার দোহাই দিয়ে মন্দিরগুলো এখনো খুলছেন না?' ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনাতেই বলা হয়েছে, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সেখানে 'রাষ্ট্র ধর্ম' বলে কিছু নেই। সেখানে মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল ভগত সিং কোশিয়ারির দৃষ্টিতে সেকুলার হওয়াটা অপরাধ। আসলে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে নন। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল প্রতিদিন যে সব টুইট করেন তা দেখলে যে কারো মনে হবে, এটা বিরোধী বিজেপি'র কোন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। অথচ সাংবিধানিকভাবে তিনি একজন 'দল নিরপেক্ষ' মানুষ।
ভারতীয় সংবিধানের ১৫৪(১) নং ধারা অনুযায়ী রাজ্যের শাসন ক্ষমতা রাজ্যপালের হাতে ন্যস্ত। রাজ্যের শাসন বিভাগ রাজ্যপাল ও রাজ্য মন্ত্রীসভা নিয়ে গঠিত। রাজ্যপাল হলেন রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান বা নাম সর্বস্ব প্রধান। তত্ত্বগতভাবে রাজ্যের শাসনবিভাগীয় প্রধান অর্থাৎ রাজ্যপালের নামেই শাসনকার্য সম্পাদিত হয়। রাজ্য আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রীকে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাজ্য মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যদেরও তিনি নিযুক্ত করে শপথবাক্য পাঠ করান। তিনি রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গের অজুহাতে সংবিধানের ৩৫৬ ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সুপারিশ করতে পারেন। আসলে ভারতে অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপালের দ্বৈত ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। একদিকে তিনি রাজ্যের নিয়মতান্ত্রিক শাসন প্রধান, অন্যদিকে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে কেন্দ্রের প্রতিনিধি। তিনি যখন স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করেন এবং কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন তখন তিনি মন্ত্রীসভার পরামর্শমাফিক চলতে বাধ্য থাকেন না। এইসমস্ত ক্ষেত্রে তিনি রাষ্ট্রপতি তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক্রমে পরিচালিত হন।
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ক্রমে জটিল হয়ে উঠছে। বিধানসভার বিরোধী দলীয় নেতার সাম্প্রতিক দিল্লি সফর নিয়ে রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানিয়ে বলছেন, "উনি (শুভেন্দু অধিকারী) কেন দিল্লি গিয়েছেন তা দিল্লির নেতারাই বলতে পারবেন।" অথচ শুভেন্দু অধিকারীরা দলে যোগ দেওয়াতে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন দিলীপ ঘোষ এ কারণে যে, মুকুল রায়ের গুরুত্ব ও কর্তৃত্ব এবার 'কমবে' সেই চিন্তায়। মুকুল রায় বিজেপিতে যোগ দিয়েই বেশ চমক দেখান। ২০১৮ লোকসভা নির্বাচনে বিস্ময়কর সাফল্য পায় বিজেপি। যার ধারাবাহিকতায় বিধানসভায় 'নিশ্চিত বিজয়' ভেবেই এগোতে থাকে গেরুয়া শিবির। 'বিজয়ের মঞ্চ' প্রস্তুত করা হয় রাজ্যব্যপী, যার দ্যুতি কেন্দ্র পর্যন্ত ছড়িয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের ফলে সাজানো বাগান মুহুর্তে তছনছ হয়ে যায়। তৃণমূল ছেড়ে যাওয়া নেতাদের 'ঘরে ফেরা' মুকুল রায়দের তৃণমূলে ফিরে আসা বিজেপি'র সংকট আরো বাড়িয়ে দেয়। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি'র এখন ছন্নছাড়া অবস্থা। এ অবস্থায় দিল্লি নেতাদের কপালের ভাঁজ আরো দীর্ঘ হচ্ছে। সংকট উত্তরণের নানা উপায় নিয়ে ভাবছে দিল্লি। শুভেন্দুর দিল্লি সফরকালেই দিলীপ ঘোষ বিধায়কদের নিয়ে রাজ্যভবনে রাজ্যপালের সাথে বৈঠক করেন, দলীয় বিধায়কদের নেতাকে ছাড়াই। শুভেন্দুর ফিরে আসার পরদিনই দিল্লি উড়াল দেন রাজ্যপাল জয়দীপ ধনখড়। খবরে প্রকাশ, ধনখড় ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন, বিজেপি'র বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে বৈঠকের মধ্য দিয়ে।
১৯৯২ সালে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব বাবরি মসজিদ প্রশ্নে বিজেপির ভারতব্যাপী রথযাত্রা বিহারে আটকে দেন। '৯৮ সালে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার গঠনের পর প্রতিশোধ নিতে ভুলেনি। দুর্নীতির অভিযোগে লালু প্রসাদকে গ্রেফতার করা হয় এবং তারপর রাজ্যে আইন শৃঙ্খলার অবনতির কথা বলে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে লালু প্রসাদ যাদবের সরকার বরখাস্ত করে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়। লালু প্রসাদ যাদব কারাগারে যাওয়ার প্রাক্কালে স্ত্রী রাবড়ি দেবীকে মুখ্যমন্ত্রী মনোনীত করেছিলেন। রাবড়ি দেবী সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সেই সময় সুস্পষ্টভাবে সরকারের কাছে জানতে চান, কী কারণে রাবড়ি দেবীর সরকারকে বরখাস্ত করা হলো। সরকার তার অনুকূলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তা প্রত্যাখ্যান করে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে রাবড়ি দেবীর সরকারকে প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতীয় সংবিধানের ৩৫৬ ধারা অনুযায়ী, কোনও রাজ্যের সরকার সাংবিধানিক শর্ত অনুসারে রাজ্য শাসনে অসমর্থ হলে কেন্দ্রীয় সরকার সেই রাজ্যের সরকারকে বরখাস্ত করে রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিজের হাতে তুলে নিতে পারে। এরপর প্রশাসনিক শাসনভার অর্পিত হয় কেন্দ্রীয় সরকার নিয়োজিত রাজ্যপালের মাধ্যমে। তবে রাষ্ট্রপতি শাসন-সংক্রান্ত ধারাটিতে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে অবাধ ক্ষমতা দেওয়ায় ভারতে একাধিকবার এই ধারাটির অপপ্রয়োগ হয়েছে এবং সেই জন্য এই ধারাটি সমালোচিতও হয়েছে বহুবার।
১৯৯৪ সালে বোম্বাই বনাম ভারত সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় দানের পর থেকে সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারিতে ছেদ পড়ে৷ বোম্বাই মামলার সূত্রপাত, কর্ণাটকে রাষ্ট্রপতি শাসন জারিকে কেন্দ্র করে৷ সেই সময় আর ভেঙ্কটরমন ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি৷ কর্ণাটকের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীকে সরিয়ে সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির বিরুদ্ধে মামলার রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে:
১. কোনও রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সিদ্ধান্ত যদি কেন্দ্রীয় সরকার নেয়, তা হলে সেই সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত সব নথিপত্র খতিয়ে দেখার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে দেশের সংবিধান অনুসারেই।
২. রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সিদ্ধান্তের উপর কোর্ট স্থগিতাদেশ জারি করতে পারে৷
৩. রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়ার পরও সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করতে পারে; যদি সেই বিল সংবিধান বিরোধী হয়৷ সুপ্রিম কোর্ট ওই রায়ে আরও বলে যে, ক) কেন্দ্রীয় সরকারকেই প্রমাণ করতে হবে যে সংশ্লিষ্ট রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের সিদ্ধান্তের পিছনে যথেষ্ট কারণ ও উপাদান রয়েছে৷ এবং খ) রাষ্ট্রপতি শাসনের ঘোষণা যদি অসাংবিধানিক হয়, তা হলে বাতিল হওয়া রাজ্য সরকারকে পুনর্বহাল করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে৷ অবশ্য রায় দানের সময় সুপ্রিম কোর্ট এ-ও বলে যে, কোনও রাজ্য সরকার যদি রাষ্ট্রের ধর্ম নিরপেক্ষতায় আঘাত হানে, তাহলে বিনা দ্বিধায় কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারবে৷ বোম্বাই মামলার রায়ের পর আইনগত দিক থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধানের ৩৫৬ অনুচ্ছেদ রাজ্যের উপর প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারবে না।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সেই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ অবস্থান আজও অটুট আছে কিনা সেটা আজ এক প্রশ্ন। বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত মামলায় রায় ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে যাওয়ায় মানুষের বিস্ময় কাটার আগেই ঐ মামলার রায় প্রদানকারী বিচারক প্রধান বিচারপতি ক্ষমতাসীন দল বিজেপিতে যোগ দেন এবং অল্প দিনের মধ্যেই রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন। এই জাতীয় ঘটনা মানুষের মনে সংশয় তৈরি করে। মানুষ আদালতকেই শেষ আশ্রয়স্থল মনে করতে চায়।