পশ্চিম বাংলা কি হিন্দুত্বের কাছে পরাজিত হবে?
ভারতীয় উপমহাদেশের যে শহর প্রথম জেনেছিল নির্বাচন শব্দটি, তার নাম কলকাতা।
১৮৫৭ সালে বিহারের মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থতার পরিণতিতে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে এবং বৃটিশ রাজতন্ত্র সরাসরি ভারত শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করে ও বৃটিশ পার্লামেন্টের মাধ্যমে ভারত শাসন পরিচালনা শুরু করে।
১৮৬১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম বেঙ্গল লেজিসলেচার কাউন্সিল গঠন করে যার সংখ্যা ছিল মাত্র ১২ জন। কেউই নির্বাচিত ছিলেন না। তবে সেই প্রথম শুরু হয় ভারতের বহুমাত্রিক শাসন।
আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারতে নিযুক্ত ভাইসরয়ের এই লেজিসলেচার কাউন্সিলের মতামত প্রয়োজন হতো। ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল পদে যোগ দেন দ্য ভিসকাউন্ট ক্যানিং।
এরপর আসে ১৮৯২ সালের ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট। যেখানে লেজিসলেচারের সংখ্যা বাড়িয়ে ২০-এ উন্নীত করা হয়। যার মধ্যে সাতজন সদস্যের নির্বাচনের বিধান করা হয়। বলা যায়, প্রাথমিকভাবে সেটিই ছিল ভারতবর্ষের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের যাত্রা। বৃটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া সেই কাউন্সিল আইন কিছুকাল পরপর পরিবর্তন হতে থাকে।
এরপর ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯০৯ পাস করে বৃটিশ পার্লামেন্ট। আর সদস্য সংখ্যা হয় ৫০। তার দশ বছর পর পাস হয় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯১৯; আর সদস্য বাড়িয়ে করা হয় ১২৫ জন। আর শেষবার করা হয় ভারত শাসন আইন ১৯৩৫; সদস্য ২৫০ জন। এই দীর্ঘ সময়ে কখনোই সর্বজনীন ভোটের অধিকার ছিল না বাঙালির কিংবা অন্য কোনো ভারতীয়ের।
১৯৪৭ সালের নানা পরিক্রমার পথ পেরিয়ে এখন সেই পশ্চিম বাংলার পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা ২৫০ থেকে ২৯৪-তে উন্নীত করা হয়েছে। ভারতীয় সংবিধান বহু ভাগে বিভক্ত বাংলার নাম রাখে পশ্চিম বাংলা।
বাংলা হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের বহুবাদীত্বের আতুড় ঘর। প্রথম নির্বাচন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হওয়া সেই পশ্চিম বাংলার শাসন আজ মমতা ব্যানার্জীর হাতে। এক সময়ের কংগ্রেসের যুবনেত্রী আজ তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী। অটল বিহারী বাজপায়ীর নেতৃত্ব বিজেপি যখন ক্ষমতায়, ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত মন্ত্রীত্ব করেন মমতা। ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ত্যাগ করে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে পৌঁছান। রাজনৈতিক ক্ষমতায় কীভাবে নিজেকে রক্ষা করা যায়, সে কৌশল এ নেত্রী জানেন।
২০০৯ সালে কংগ্রেস কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে আবার কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে মনমোহন সিংয়ের অধীনের মন্ত্রীসভায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীত্ব লাভ করেন তিনি।
মমতা ব্যানার্জী ২০০৬-২০০৭ সালে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন পশ্চিম বাংলার সিঙ্গুর আর নন্দী গ্রামে। এই দুই জায়গাই বামফ্রন্ট সরকার কৃষকের জমি অধিগ্রহণ করে ভারতীয় টাটা আর ইন্দোনেশিয় কেমিক্যাল কোম্পানির জন্য। বামফ্রন্ট দীর্ঘদিন ট্রেড ইউনিয়নের নামে দলবাজি করার ফলে পশ্চিম বাংলায় দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগে সবচেয়ে নিন্ম পর্যায়ে অবস্থান করছিল। ফলে ভারতীয় প্রধান রাজ্যগুলোর মধ্যে পশ্চিম বাংলায় বেকারত্ব ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুর- এ দুই জায়গায়ই উল্লেখযোগ্য মুসলিম জনগোষ্ঠির নিবাস ও স্বল্প জমির মালিকানা। নন্দীগ্রামে প্রায় ৩৪ .৪ শতাংশ মুসলিম আর ১৮.৬ শতাংশ দলিত (২০০১ আদমশুমারি)।
বামফ্রন্টের এক নেতা দলিত এক কিশোরীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ফলে সিঙ্গুরে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয় এবং মমতার দলসহ অন্য একটি বামদল সেই আন্দোলনে অংশ নেয়। সেই ঘটনা ছিল বামদের পতনের মূল। এই দুই জায়গার আন্দোলনের ফসল ২০১১ সালের পশ্চিম বাংলার নির্বাচনে তৃণমূলের জয়লাভ।
২০১১ সালে যখন তৃণমূল জয়লাভ করে, পশ্চিম বাংলায় তখন কেন্দ্রে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার। নন্দীগ্রামের ব্যাপক মুসলিম জনগোষ্ঠির ওপর বামদের নির্যাতনের ফলে বামফ্রন্ট রাজ্য পর্যায়ে মুসলিম সমর্থন হারায়। কংগ্রেসের বাবরি মসজিদ আর বামফ্রন্টের নন্দীগ্রাম নির্যাতনের কারণে তৃণমূল কংগ্রেস বাংলার দরিদ্র মুসলিমদের একমাত্র ভরসার স্থল হিসাবে উপস্থিত হয়। সেই সমর্থন রাজ্য পর্যায়ে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায়। বলে রাখা ভালো, পশ্চিম বাংলায় মুসলিম জনগোষ্ঠি প্রায় ২৭ শতাংশের অধিক।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ২০১১ সালের নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জী প্রথমে অংশ নেননি। দল জয়লাভ করে বামদের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটায়। পরে উপনির্বাচনে জয়ী হন মমতা। আর সেই নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) একটি আসনও লাভ করেনি। বিজেপি নামক যে দল আজ ভারতীয় শাসন কেন্দ্রে, তার জন্ম হয়েছিল ১৯৫১ সালে এই কলকাতায়, জনসংঘ নামক একটি দলের গর্ভ থেকে। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্যামা প্রসাদ।সেই জনসংঘই আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি।
মমতা ব্যানার্জী ক্ষমতায় আসার পরই, ২০১১ সাল থেকে দরিদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠির মন স্থায়ীভাবে জয় করার জন্য ইমাম ভাতা চালু করেন। বিজেপি জোরাল কণ্ঠে এই মুসলিম তোষণ নীতির সমালোচনা করে। পশ্চিম বাংলায় শুরু হয় নতুন মাত্রার ধর্মীয় বিভাজন।
মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে পাঠাগার মন্ত্রীর দায়িত্ব পান জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সর্বভারতীয় পর্যায়ের নেতা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী। যে সিদ্দিকুল্লারা ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তিন তালাক নিষিদ্ধকরণ আইনের বিপক্ষে অবস্থান নেন। মমতার তৃণমূল সংসদ সিদ্দিকুল্লাহদের পক্ষ অবলম্বন করে। যে কারণে আবার মুসলিম নারীদের ব্যাপক অংশের সমর্থন হারায় এই নেত্রীর দল।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তিস্তা চুক্তি রুখে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী ও তার দল; পর্দার অন্তরালে বিজেপির ইশারা। সর্বভারতীয় পর্যায়ে দলটি বিজেপির স্বার্থরক্ষার কৌশল হিসাবে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে বিজেপিবিরোধী ভোটকে বিভক্ত করতে তৃণমূলের প্রার্থী হাজির করে। যার ফলে বিজেপির জয়লাভ সহজ হয়। ভারতের অন্যতম ক্ষুদ্র রাজ্য মনিপুরে বিজেপি ক্ষমতায়; সেখানে তৃণমূলের একমাত্র সাংসদ বিজেপির রাজ্য সরকারের সমর্থক।
২০১১ সালের পর গত ২০১৬ সালে যে নির্বাচন হয়, পশ্চিম বাংলায় তার আগে ২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার গঠন করেছে। ২০১৬-এর নির্বাচনে পশ্চিম বাংলায় বিজেপির জয়যাত্রা শুরু হয় মাত্র ১৬টি আসন নিয়ে। রাজ্যে তৃণমূল নেত্রী যে একলা চলো নীতি গ্রহণ করেছেন, তাতে তার একমাত্র বন্ধু সিদ্দীকুল্লাদের জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দল নেই।
২০১৯ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় নির্বাচনের সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যে জোট তৃণমূল নেত্রী গঠন করতে চেয়েছিলেন, তা-ও প্রকারান্তে বিজেপির পক্ষাবলম্বন। ছিল বিজেপিবিরোধী ভোটকে বিভক্ত করার কৌশল। বিগত লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি আসামের এনআরসিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে সিএএ সংশোধনী- যা হিন্দুত্বের নতুন মাত্রা যোগ করে। পশ্চিম বাংলার মুসলিম ভোট ধরে রাখার জন্য এনআরসি-বিরোধিতা কিংবা সিএএ-বিরোধিতা তৃণমূলের বাহ্যিক পরিচয়ে; অন্তরের গভীরে হিন্দুত্বই প্রধান দর্শন।
তৃণমূল যদি সত্যি বাঙালি দর্শন ধারণ করত, তাহলে '৪৭ সালের বিভাজনের মাধ্যমে সৃষ্ট দুই বাংলার অভিন্ন স্বার্থের কথা সর্বক্ষেত্রে ভাবত। তিস্তার পানিবণ্টন আটকাত না, কিংবা সীমান্তে ফেলানি হত্যা বন্ধে সোচ্চার হতো।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক