বারখা ডাত...বিজেপির ঘৃণার রাজনীতিতে জ্বলছে দিল্লি
ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক বারখা ডাত। গত ২১ বছর ধরে কাজ করেছেন দেশটির অন্যতম প্রসিদ্ধ গণমাধ্যম এনডিটিভিতে। তার অপরিসীম কর্মদক্ষতা, উদ্ভাবনী শক্তি, সাংগঠনিক গুণ ও সাহসী সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠানের বিকাশ হয়েছে আন্তর্জাতিক স্তরে।
অসাম্প্রদায়িক অবস্থানের কারণে বারখা ডাত ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির একজন ঘোর সমালোচক বলেই পরিচিত। দুই বছর আগে তিনি এনডিটিভির চাকরিতে ইস্তফা দেন। এখন তিনি মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টের একজন নিয়মিত কলাম লেখক।
বুধবার ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক কলামে বারখা ডাত ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিস্ফোরণ এবং এর সঙ্গে বাকি বিশ্বের নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন নিয়ে তীব্র কটাক্ষ করেন। নিন্দা করেছেন উগ্রবাদী রাজনীতির উত্থান এবং তার কারণে দিল্লির সাম্প্রতিক দাঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে। তুলে ধরেন মানবিক বিপর্যয় এবং পুলিশি বর্বরতার চিত্র। বারখা ডাতের স্পষ্টভাষী এই প্রতিবাদ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-
মঙ্গলবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন এক মহাসমারোহে নৈশভোজে ব্যস্ত। কাজু আর উপাদেয় মশলা দেওয়া স্যামন মাছ, গরম ধোঁয়া ওঠা বাসমতি চালের খাসির বিরিয়ানি, ভেড়ার ভাজা ভাজা নরম রান, কাঠবাদামের পুর দেওয়া অ্যাপেল পাই কি ছিলনা সেখানে!
ঠিক ওই সময়েই নয়াদিল্লির গুরু তেগ বাহাদুর হাসপাতালে শাহিদ খানের পরিবার কি কারণে তাকে হত্যা করা হলো, তা বুঝে ওঠার চেষ্টা করছিল। ২২ বছর বয়সী এই রিক্সাচালক ছিল চার ভাইয়ের মাঝে সবার ছোট। তবে দুর্ভাগা সে একা নয়, মোদি-ট্রাম্পের জৌলুসের আয়োজন চলাকালে শাহিদের মতো এক ডজনের বেশি মানুষ তখন দিল্লির সহিংসতায় প্রাণ দিয়েছেন।
বিজেপি সরকারের বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) এর প্রতিবাদ ঘিরেই সংঘর্ষের সূত্রপাত। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সিএএ সমর্থকদের পাথর ছোড়াছুঁড়ি পুলিশি মদদে এখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নির্মূল অভিযানে রূপ নিয়েছে। ফলে রাজধানী দিল্লি পরিণত হয়েছে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক সংঘাতের যুদ্ধক্ষেত্রে।
এসব কিছু যখন চলছে, তখন রাষ্ট্রপতি ভবন নামক রাজপ্রাসাদে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে জাকজমকপূর্ণ আর আনুষ্ঠানিকতায় ভরা এক সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছিল। আর এবারের সফর ট্রাম্প বেশ পরিস্থিতি বুঝে করেছেন বলেই মনে হয়।
উল্টাপাল্টা কোনো মন্তব্য নেই, হাঙ্গামা নেই এ যেন অন্য ট্রাম্প। এই সফরে ট্রাম্প বরং মোদি সরকারের পক্ষে যায় এমন সব কথাই বলেছেন তিনি। পরিকল্পনা মাফিক সব আয়োজন শেষ হওয়ায় পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে মোদি প্রশাসন।
এরপরও ভারতের অধিকাংশ গণমাধ্যমের শিরোনাম থেকে ট্রাম্পের সফর এখন সরে গেছে। সেখানে স্থান করে নিয়েছে দিল্লির দাঙ্গা। মোদির প্রতি সহানুভূতিশীল ভারতের অধিকাংশ গণমাধ্যমেও এখন ট্রাম্পের সফর দ্বিতীয় সারির শিরোনাম ভারি করছে।
এমনটা অবশ্য মোটেই হওয়ার কথা ছিল না। ট্রাম্পের সফরের মাধ্যমে অতি-সাম্প্রতিক দিল্লি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার জখমে ব্যান্ডেজ বাঁধার চেষ্টা করেছিলেন মোদি। চেয়েছিলেন দুর্বল অর্থনীতি আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশ নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ক্রমাগত সমালোচনার মুখ অন্যদিকে ফেরাতে। প্রদর্শনের আকাঙ্খা ছিল ভারতের ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক সক্ষমতাও।
সুযোগ সন্ধানী ছিলেন ট্রাম্প নিজেও। এই সফরের মধ্য দিয়ে ভারতীয় বংশদ্ভুত ধনী ও প্রভাবশালী মার্কিন নাগরিকদের আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে নিজ শিবিরে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি।
এসব আকাঙ্খা পূরণ হয়নি, কারণ প্রাথমিক গোলযোগের রেশ কেটে যাওয়ার পর দিল্লির দাঙ্গা এখন পূর্ণমাত্রায় মুসলিমদের ওপর নিপীড়নে রূপ নিয়েছে। সংঘাতের প্রথম দিকে সিএএ বিরোধী এবং পক্ষে দুই শিবির থেকেই হামলা ও পাল্টা হামলার সংবাদ শোনা গিয়েছিল। কিন্তু এখন সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে হেঁয়ালি করার অবকাশ কোনো বিবেকবান মানুষের থাকতে পারে না।
ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুষে রাখা ঘৃণার বিষবাস্প এখন দিল্লির অলিতে-গলিতে। যে শহরে হিন্দু ও মুসলমানরা বহু বছর পাশাপাশি বসবাস করতো, এখন সেখানে দাঙ্গার আগুন জ্বলছে। ভেঙ্গে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা।
পুলিশ শুধু অকার্যকর তাই নয় বরং তারা হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজদের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে অনেক অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে বার্তা পেয়েছি। এসব বার্তায় আতঙ্ক আর বেঁচে থাকার আকুতি ছিল।
হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থীরা এখন মুসলমানদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের ঘর থেকে টেনে বের করছে। এই অবস্থায় অনেক মুসলমান পুলিশ হেল্প লাইনে ফোন করে সাহায্যের আবেদন করছে। পরিস্থিতি অবর্ণনীয়। তারপরও বর্ণনা দেওয়াটা সময়ের দাবি। এনডিটিভির একজন ফিল্ড প্রডিউসার এক মুসলিম যুবকের দেখা পান। ওই যুবক উগ্রপন্থীদের নির্যাতন থেকে প্রাণ বাঁচাতে আগুন জ্বলছে এমন এক মসজিদের মিনারের ওপরে অবস্থান নিয়েছিলেন।
এই অবস্থায় পুলিশ কি করেছে? তারা দাঁড়িয়ে থেকেছে আশ্চর্য নির্লিপ্ততা নিয়ে। নয়তো নিজেরা নির্যাতনকারীর দলে যোগ দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া খবরে একজন হেড কনস্টেবল নিহত হওয়াসহ আরও ৫০ জন পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার খবর আসলেও, প্রকৃতপক্ষে একটি নিরপেক্ষ শক্তি হিসেবে দিল্লি পুলিশের বিলুপ্তি ঘটেছে।
অনলাইনে এখন পুলিশি তৎপরতার বেশ কিছু ভিডিও দেখা আপলোড হয়েছে। এর মাঝে এক ভিডিওতে লাঠি এবং পাথর হাতে মারমুখো দাঙ্গাবাজদের তাণ্ডব স্বত্ত্বেও পুলিশ সদস্যদের আনন্দ সহকারে তা উপভোগ করতে দেখা গেছে।
আরেক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পুলিশের মারপিটে গুরুতর আহত সিএএ বিরোধী কিছু যুবককে জোর করে করে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করছে পুলিশ সদস্যরাই। এসময় তাদের 'বন্দে মাতরম' বলানোর জন্যেও পেটানো হয়। আহত যুবকদের অনুনয়, আকুতি বা ক্ষমাভিক্ষা কোনো কিছুই পুলিশি নির্যাতন বন্ধ করেনি।
রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়াও ছিল লক্ষ্য করার মতো। মোদির ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দিল্লির শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে বেশকিছু বৈঠক করেছেন। কিন্তু সকল ইস্যুতে সরব অমিত শাহ দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে জনসম্মুখে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও মঙ্গলবার দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি। এদিন এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে ভারতীয় সাংবাদিকরা দিল্লির সহিংসতা এবং ভারতের নাগরিকত্ব আইন নিয়ে তার মন্তব্য জানতে চান। আর ট্রাম্পও তাদের নিরাশ করেননি। জানিয়েছেন আস্থা রেখেছেন যোগ্য লোকের কথাতেই।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে আমি নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা করেছি। তিনি একজন 'অসাধারণ ব্যক্তিত্ব'। মোদি ধর্মীয় স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে কঠিন পরিশ্রম করছেন এবং আগামী দিনেও তা বজায় রাখার 'প্রতিশ্রুতি' দিয়েছেন।
বিশ্বনেতা ও পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো গণতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে এটাই ছিল ট্রাম্পের দায়িত্বশীল বক্তব্য। অথচ প্রকৃত পরিস্থিতি ট্রাম্পসহ পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা ভালো করেই জানেন। এইতো কিছুদিন আগেই সরকারি দলের এক প্রভাবশালী নেতা কপিল মিশ্র বিক্ষোভকারীদের সড়ক থেকে নিশ্চিহ্ন করার হুমকি দেন। এসময় তার পাশেও একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন।
গত দু'মাস ধরে শাহিনবাগে মুসলিম নারীদের যে সিএএ বিরোধী অবস্থান আন্দোলন চলছে, তা ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। সেখান থেকে ভারতীয় পতাকা, সংবিধান এবং জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু গত ৭২ ঘণ্টায় উগ্রবাদীদের পাল্টা বিক্ষোভ পূর্ণ হিংস্রতা নিয়ে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করতেই মাঠে নেমেছে। তাদের মুখে মুখে এখন স্লোগান 'সড়ক পরিষ্কার কর, দেশ পরিষ্কার কর'।
এমনই একদল সিএএপন্থী লোকজনের সঙ্গে আমার কথা হয়। সিএএ বিরোধী বিক্ষোভ বন্ধ করাটাই এখন তাদের প্রধান মিশন। মুসলিম বিদ্বেষ গোপন না করেই এদের একজন বলে ওঠেন, ট্রাম্প নিজেও জানেন পৃথিবীতে কিছু ভুল ধর্ম ও সে সব ধর্মের মানুষ আছে। দেশে শান্তি ফেরাতে হলে এদের শায়েস্তা করতে হবে।
পরিস্থিতি দৃষ্টে মনে হচ্ছে, শুধু ট্রাম্প নন বরং পুরো বিশ্ব ভারতের সাম্প্রদায়িক উগ্রতার তাণ্ডব নীরবে উপভোগ করতে প্রস্তুত।