বিশ্ব বাণিজ্যের লড়াই: টিপিপি’র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আরসেপ
মুক্ত বাণিজ্য অর্থনৈতিক চুক্তিতে গেলো পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের ১৫টি দেশ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের সমন্বয়ে গঠিত সংগঠন আসিয়ানের ভিয়তনামে অনুষ্ঠিত ৩৭তম সম্মেলনে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ২০১২ সালের নভেম্বরে প্রথম প্রস্তাবিত হওয়ার পর দীর্ঘ ৮ বছরে ৩০ বারের মতো আলোচনা ও সমঝোতার পর অবশেষে 'রিজিওনাল কম্প্রেহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট' (আরসেপ) নামক এ চুক্তিতে পৌঁছাতে পারল ১৫ দেশ।
স্বাক্ষরিত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে আসিয়ানের দশটি দেশ সদস্য দেশ: ব্রুনাই দারুসসালাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইনস্, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পূর্ব এশিয়ার ৩টি দেশ; চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এবং প্যাসিফিক অঞ্চলের ২টি দেশ; অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির প্রথম থেকেই ভারত থাকলেও গত বছরের নভেম্বর মাসে ভারত চুক্তি থেকে ফিরে আসে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত হওয়ায় অনেকে এই চুক্তিকে এশিয়া প্যাসিফিক বাণিজ্য চুক্তি বলেও অভিহিত করছে।
কোভিড-১৯ ভাইরাস এর কারণে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত এবারের আসিয়ান সম্মেলনের মূল বিষয়বস্তু ছিলো আরসেপ চুক্তি। বৈশ্বিক জনগোষ্ঠীর, বিশ্বব্যাপী সামষ্টিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের হিসাবে প্রায় ১/৩ অংশ পরিমাণ দাঁড়ায় চুক্তিতে স্বাক্ষরিত দেশসমূহ।
২০১১ সালের নভেম্বরে কম্বোডিয়ায় অনুষ্ঠিত আসিয়ানের ১৯তম সম্মেলনে প্রথমবারের মতো প্রস্তাবনা আসে আরসেপ গঠনের। তারপরের বছর আসিয়ানের নেতারা আরসেপ গঠনের কাঠামো নিয়ে ঐক্যমতে পৌঁছান। তার ভিত্তিতে ২০১৫ সালের মে থেকে সমঝোতা ও আলোচনা শুরু হয়। তারপর ২০১৮ সালে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত আসিয়ান সম্মেলনে দেশসমূহ বিস্তৃত রূপরেখায় পৌঁছাতে সফল হন। সর্বশেষ ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভারত চুক্তির স্বচ্ছতা ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার অজুহাত দেখিয়ে সমঝোতা থেকে বেরিয়ে আসে। সে অবস্থান থেকে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিলো ২০২১ সালে, কিন্তু কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক স্থবিরতার প্রেক্ষিতে করোনা পরবর্তী অর্থনীতিতে দ্রুত অগ্রগতি সাধনের লক্ষ্যে থাইল্যান্ডের প্রস্তাবে এ বছরের আসিয়ান সম্মেলনেই চুক্তি স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। ৫১০ পৃষ্ঠার এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও আইনিভাবে কার্যকারিতা শুরু হতে হলে আগামী দুই বছরের মধ্যে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর অন্তত ৬টি দেশ ও বাকি ৫টি দেশের মধ্যে অন্তত ৩টি দেশ অভ্যন্তরীণভাবে, অর্থাৎ মূলত সেসব দেশের আইনসভায়, অনুমোদন করতে হবে।
আরসেপ অঞ্চলের এর আওতায় বিশ্বের ২১০ কোটি জনগণ এবং জিডিপির হিসেবে ১৫টি দেশের সর্বমোট জিডিপির পরিমাণ ২৬.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (বৈশ্বিক জিডিপির ২৮%) হওয়ায় এটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও 'ইউএসএমসিএ' বা ন্যাফটা ২.০ কেও ছাপিয়ে বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে এ দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সমঝোতার উল্লেখযোগ্য হল:
১. বাণিজ্যে মোট ৬৫% পণ্য ও সার্ভিস সেক্টরে শুল্ক উঠিয়ে নেওয়া;
২. ধাপে ধাপে পণ্য বাণিজ্যে শুল্ক অন্তত ৯২% ভাগ কমিয়ে আনা,
৩. বাণিজ্যের জটিল বিধিমালাকে পাশ কাটিয়ে শুল্ক প্রক্রিয়া সহজলভ্য করা
৪. অনলাইন গ্রাহক এবং কাগজবিহীন বাণিজ্য ক্ষেত্রগুলোর উন্নতি সাধন
অর্থাৎ, বাণিজ্য শুল্ক কমিয়ে মুক্ত বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে ক্রমাগত ধাপে, সহজতর বাণিজ্য কাঠামোতে দেশগুলোর অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করা।
এসব বিষয়ে সমঝোতা হলেও, আরও কিছু বৈশিষ্ট্য এই চুক্তিতে বিদ্যমান। সেগুলো হল:
১. শ্রম মানদণ্ডের অনুপস্থিতি, যে কারণে শ্রমিকদের সুরক্ষা প্রদানে কোনরূপ নীতিমালার আওতায় আসবে না দেশগুলো
২. অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিপরীতে পরিবেশ সুরক্ষায় কোন ধরনের নীতিমালার অনুপস্থিতি
৩. মেধাসম্পদ, মেধাসত্ত্ব ও বাণিজ্য কৃতিস্বত্ব (পেটেন্ট) সংরক্ষণ বা লঙ্ঘন প্রতিরোধে দৃশ্যমান নীতিমালার অনুপস্থিতি।
সুতরাং, দেশসমূহ বহুপাক্ষিক অর্থনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বায়নের কথা বললেও অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে কেবলমাত্র শুল্ক কমিয়ে বাণিজ্য সহজলভ্যকরণের মধ্য দিয়ে আরসেপ মূলত গত শতাব্দীর অর্থনীতির ধারণাকেই আঁকড়ে ধরে আছে। তবে এ সমালোচনা ও সংশয়ের উল্টো পাশে অন্য বিশেষজ্ঞরা চুক্তিটির মাধ্যমে এ অঞ্চলে গড়ে উঠা বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন, অর্থাৎ লজিস্টিকের উন্নয়ন হওয়ার ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রভাব রাখবে বলে ধারণা করছেন।
তাছাড়া ২০১০ সালে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে আগে থেকেই চীনের স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তি থাকার ফলে, বলা চলে নতুন এ চুক্তিতে মূলত জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড যোগদান করেছে। এ চারটি দেশও নিজেদের মধ্যে ও অন্যান্য আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে টিপিপি (ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) সহ অন্যান্য বহুপাক্ষিক ও পারস্পরিক দ্বিপাক্ষিক মুক্ত অর্থনৈতিক চুক্তিতে ইতিমধ্যে থাকার কারণে, তারা চীনের সাথে সারসরি মুক্ত বাণিজ্যে ঢুকে পড়ছে।
অর্থনৈতিক হিসাবে এটাও পরিলক্ষিত হয় যে এ সমঝোতার কারণে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর বাৎসরিক জিডিপির মাত্র ০.২% বৃদ্ধি পাবে, আলোচনায় যে সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে তার বিপরীতে তা সামান্যই মাত্র। সুতরাং এ চুক্তিটিকে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা উচিত নয়। এ চুক্তি বিশ্লেষণ করতে হলে ২০১৬ সালে স্বাক্ষরিত ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি চুক্তিকে অবশ্যই আলোচনায় আনতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন তখনকার টিপিপি চুক্তিটির ১২ দেশের মধ্যে ৭টি দেশই আরসেপ এ রয়েছে। মূলত ২০১৬ সালের এই চুক্তিটিতে চীনকে বাদ দিয়ে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় এ অঞ্চলে অর্থনৈতিকভাবে একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়ে চীনের জন্য পাল্টা অর্থনৈতিক চুক্তি অতি-জরুরি হয়ে পড়ে। যদিও ২০১৭ সালের জানুয়ারিতেই যুক্তরাষ্ট্র টিপিপি থেকে বেড়িয়ে আসলে, টিপিপি মূলত নিজের সক্ষমতার অনেকটিই হারিয়ে ফেলে।
নিজের রাজনৈতিক সক্ষমতার পরিচায়ক হিসেবে অর্থনৈতিক গুরুত্ব বাড়াতে চীনের জন্য আরসেপ চুক্তিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা একে চীনের নিজেদেরকে কেন্দ্র করে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার একটি পদক্ষেপ হিসেবে মনে করছেন। এতে অন্তত এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ের বাইরে গিয়ে এই নতুন অর্থনৈতিক বলয়ে আনতে পারলো।
অন্যদিকে ভারতের চুক্তিটিতে না যাওয়ার মূল কারন চীন। চুক্তিতে ভারতকে যেকোন সময়ে আসার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যদিও ভারত চুক্তি থেকে সরে আসে ২০১৯ সালেই, মানে এ বছরে ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষের ফলে অর্থনৈতিক স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই। ভারতের ভয় চীনের সহজলভ্য ও স্বল্পমূল্যের পণ্যে তাদের বাজার সয়লাব হলে দেশীয় উৎপাদনে বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। কেবল চীন নয়, কৃষিক্ষেত্রেও যেমন ভারতের অর্থনীতি মুক্তবাজারে নিউজিল্যান্ডের মতো দুগ্ধ শিল্পে উন্নত দেশের সাথে পাল্লা দিতে গেলে হিমশিম খেতে হবে। ভারতের অভ্যন্তরীণ শিল্পের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে নিশ্চিত। অন্যদিকে তৈরী-পোশাক শিল্পও আন্তর্জাতিক বাজারে ভিয়েতনাম, চীন, কম্বোডিয়ার মতো অন্যান্য দেশের সাথে ভারত পেরে উঠবে না। এরকম প্রতিটি ক্ষেত্রে আরসেপ দেশসমূহের সাথে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়তো। আবার ভারতের বিশেষ কোন ফায়দাও নেই তাদের সাথে চুক্তি করে, কারণ ভারতের শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্যে খুব কমই আছে এ অঞ্চলের দেশগুলো। তাছাড়া এ দেশসমূহের বেশিরভাগের সাথে পারস্পরিক শুল্ক কমানোর চুক্তিতে ভারত আমদানিতে শুল্ক ছাড় পেয়ে আসছে, ফলে ভারত এ সংগঠনে যোগ দিলে খুব সামান্যই শুল্ক ছাড় পাবে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে পরিচিত জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়ার এ সমঝোতায় যাওয়ার পেছনের কারণ ভিন্ন। এ তিন দেশ আশা করছে চীন ও আসিয়ানের অন্যান্য দেশ যেমন; ভিয়েতনাম তাদের সাথে একই বাণিজ্য অঞ্চলে আসার ফলে ক্রমান্বয়ে স্বচ্ছতা ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যের বিধিমালা তৈরী হবে এসব দেশে। যেমন অস্ট্রেলিয়ার সাথে চীনের মেধাসত্ত্ব কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে জটিলতা বিদ্যমান। এ চুক্তির মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া সেই জটিলতা নিরসনে চীনের সাথে সমঝোতায় আসার পথ খুঁজবে।
অন্যদিকে এ চুক্তির মাধ্যমে খানিকটা আলোচনার বাইরে চলে আসা জাপান ও কোরিয়ার মধ্যকার অর্থনৈতিক স্নায়ুযুদ্ধের এক প্রকার সমাপ্তির দিকে যাবে। যার ফলে পরোক্ষভাবে লাভবান হবে এ দু'দেশের সাথে ওতোপ্রতভাবে বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ।
সুতরাং জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যান্ডের মতো দেশের জন্য আরসেপ-এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দেবে।
অন্যদিকে বিশ্লেষকদের মতে এ চুক্তির কারণে সবচেয়ে লাভবান হবে মায়ানমার, ফিলিপাইনস, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামের মতো উদীয়মান অর্থনীতি। তাছাড়া চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে বহুদিন ধরে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার প্রক্রিয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে বারবার ভেস্তে যাচ্ছিলো, আরসেপ-এর কারণে তা এক প্রকারে বাস্তবতার মুখ দেখলো। এতে স্বাভাবিকভাবে এ তিনটি দেশ অতীব লাভবান হবে। সর্বশেষে কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে আরসেপ এ পনেরোটি দেশের জন্য টনিকের মতোই কাজ করতে পারে বলে আশাবাদ করা হচ্ছে।
উল্টোভাবে বললে কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক উত্তরণের পরীক্ষা দিয়েই মূলত আরসেপ অথবা রিজনাল কম্প্রেহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্টের যাত্রা শুরু হবে, যা এ অঞ্চলে মুক্ত বাণিজ্য সম্প্রসারণে কেবলই শুরুর পর্যায়ের ধাপ মাত্র। তবে তার আগের শেষ ধাপও জরুরি, আগামী দুই বছরের মধ্যে আসিয়ান দেশগুলোর অন্তত ৬টি দেশ ও বাকি ৫টি দেশের মধ্যে অন্তত ৩টি দেশ চুক্তিটি নিজেরা অনুমোদন করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
টুইটার: Aqib Mohammed Fuad