বিশ্ব যখন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সর্বাত্মক ব্যয় বাড়াচ্ছে, বাংলাদেশ তখন রক্ষণশীল নীতিতে অটল
আর্থিক মন্দার সময় কী করতে হবে সে বিষয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান বলেছেন, নীতিনির্ধারকদের এ সময় দু'টি কাজ করা প্রয়োজন: প্রথমটি হল ঋণের প্রবাহ ফের চালু করা এবং অন্যটি হল অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সময়কালে ব্যয় বাড়িয়ে দেওয়া।
তার প্রামাণ্য বই 'দ্য রিটার্ন অফ ডিপ্রেশন ইকোনমিক্স অ্যান্ড দ্য ক্রাইসিস অব ২০০৮' এ তিনি লিখেছেন, আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলায় আদর্শ পদ্ধতি হল, 'যা হবার হোক' এই মানসিকতা নিয়ে অর্থনীতিতে আরও বেশি মূলধনের যোগান দেওয়া।
সেখানে বলা হয়, "এ পর্যন্ত যা করা হয়েছে তা যদি পর্যাপ্ত না হয়, তবে ঋণ প্রবাহ শুরু হওয়া পর্যন্ত এবং অর্থনীতির সত্যিকারের পুনরুদ্ধার শুরু হওয়া পর্যন্ত আরও কিছু করুন এবং আলাদা কিছু করুন।"
পল ক্রুগম্যানের মতো বিশ্বের আরও অনেক অর্থনীতিবিদ এবং চিন্তাবিদরা মহামারির কারণে অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে যাওয়া বৈশ্বিক অর্থনীতিকে জাগাতে অধিক ব্যায়ের এই ধারণাটির উপর জোর দিয়ে আসছেন।
বিশ্বের উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো স্পষ্টতই ধারণাটি গ্রহণ করেছে। ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে এই সংকটের ধকল কাটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করতে যখন অসাধারণ কোনো পদক্ষেপের প্রয়োজন তখন উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো তাদের সক্ষমতার চেয়েও বেশি ব্যয় করছে।
বিপরীতে, বাংলাদেশ 'যেমন চলছে চলুক' পদ্ধতিটি বেছে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। মহামারিতে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে জাগিয়ে তুলতে বিশ্বজুড়ে যেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে তার অনেকটাই বিপরীতে গিয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য ব্যয় পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি করছে বাংলাদেশ।
অনেক উন্নত অর্থনীতির দেশের নীতিনির্ধারকরা আপাতত চিরাচরিত অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলো ভুলে গেছেন এবং বাজেটের ঘাটতির মতো অনির্বায দিকটি নিয়ে এই মুহুর্তে তারা মোটেও মাথা ঘামাচ্ছেন না।
তাহলে কখন তারা মাথা ঘামাবেন? পল ক্রুগম্যান বলেছেন, "একবার যদি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা ভালভাবে শুরু হয়, তবে এমন সময় আসবে যখন তা 'প্রফিল্যাক্টিক সিস্টেম' এর দিকে যাবে। এর মানে হল, পুরো ব্যবস্থাটির সংস্কার করা যাতে আবার এই সংকট না ঘটে।"
কীভাবে দেশগুলো ব্যায়ের পরিকল্পনা করছে?
যুক্তরাষ্ট্র
ক্ষমতা ছাড়ার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪.৮ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজেট রেখে যান, যাতে মোট খরচের ৬০ শতাংশ সামাজিক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয় রাখা হয়।
গত মার্চে দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কর্তৃক 'আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যান' এর কারণে অর্থবছরের সাত মাসের মাথায় দেশটির বাজেট ঘাটতি ২ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছায় যার অধিকাংশই প্রণোদনা ব্যয় মেটাতে খরচ করা হচ্ছে।
গতবছর দেশটির বাজেটের ঘাটতি ছিল ৩ দশমিক ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বোচ্চ।
আগামী ২০২২ সালের জন্য ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজেট পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছেন জো বাইডেন, যা বার্ষিক ফেডারেল ঘাটতিতে ১ ট্রিলিয়ন ডলার যোগ করবে।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন ব্যয় এবং বিশাল একটি সামাজিক সুরক্ষা জালকে অন্তর্ভুক্ত করা এই বাজেট যদি পাশ হয়, তবে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার সবচেয়ে বড় বাজেট হবে।
চীন
মহামারি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন। ২০২১ সাল চীনের চতুর্দশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম বছর হওয়ায় আধুনিকায়ন এবং উচ্চ-মান বিকাশের জন্য বছরটিকে বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ বছর হিসাবে দেখছে চীন।
২০২১ সালের বাজেটের দর্শন ও ব্যয়ের পরিকল্পনা ৪৮ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছে চীনের অর্থ মন্ত্রণালয়।
করোনা মহামারিতে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়তার জন্য ব্যয়, জীবনযাত্রার মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে ব্যয় এবং বাজার সত্তাগুলোকে রক্ষা করতে গিয়ে ২০২০ সালে চীনের বাজেট ঘাটতি মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশের বেশি হয়েছিল যা ১ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (১৫৫ বিলিয়ন ডলার)। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ট্যাক্স এবং ফি গুলো হ্রাস করা, ভাড়া কমানো, ঋণের সুদহার হ্রাস করা এবং ভোগ ও বিনিয়োগ বাড়ানো।
নতুন বাজেটে দেশটির সামাজিক সুরক্ষা তহবিলে বরাদ্দ বাড়বে ১২০ শতাংশ। এছাড়াও চাল এবং গমের মতো প্রধান ফসলগুলোর কৃষি বীমা প্রিমিয়ামগুলিতে যথেষ্ট বাজেট বাড়ানো হবে বলে ওই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইউরোপের অর্থনীতিকে চাঙা করতে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে সমানতালে চলতে যৌথ পদক্ষেপের বিষয়ে দৃঢ় সংকল্প জ্ঞাপন করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুই বৃহত্তম অর্থনীতি ফ্রান্স ও জার্মানির অর্থ মন্ত্রীরা।
ফরাসী অর্থমন্ত্রী ব্রুনো লে মাইর বলেন, "আমরা অনেক বেশি সময় হারিয়েছি... ইউরোপকে অবশ্যই এই দৌড়ে থাকতে হবে।"
জুলাইয়ের প্রথমদিকেই ইউরোপীয় কমিশনের ৯০৬ বিলিয়ন ডলারের তহবিল থেকে সদস্য দেশগুলিকে অর্থ ছাড় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
মহামারির কারণে সৃষ্ট সংকটে গত বছর ফ্রান্সের অর্থনীতি ৮ দশমিক ৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় গিয়েছে।
এই দুই দেশের অর্থমন্ত্রীরা বলেন, ২০০৮-০৯ সালে বিশ্বজুড়ে মন্দার সময় ব্যয় সংকোচন এবং ঘাটতি বন্ধের দিকে দেশগুলোর যে মনযোগ ছিল, সেই ভুল থেকে পরিত্রাণ পেতে সহায়তা করবে এবারের অর্থ ব্যয়।
লে মাইর বলেন, "বর্তমানে আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে পাবলিক ফাইন্যান্সিংকে সংকুচিত করা নয় বরং সুস্পষ্টভাবে ব্যাপক বিনিয়োগ করা। আমরা অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছি।"
যুক্তরাজ্য
মহামারি মোকাবিলায় নজিরবিহীন রাজস্ব হস্তক্ষেপসহ বিশাল অর্থনৈতিক ধাক্কায় ৩০৩ বিলিয়ন পাউন্ড অর্থাৎ জিডিপির ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ রাজস্ব ঘাটতি দেখা দিয়েছে যুক্তরাজ্যে যা ১৯৪৬ সালের পর সর্বোচ্চ।
ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক আরও বড় ঘাটতি এবং ঋণের আশা করেছেন কারণ তাদের সরকারকে ট্যাক্স ডিফারালদের অর্থায়নের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ঋণ নিতে হবে এবং ব্যবসাগুলিকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করতে হবে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, জনসাধারণের বিশাল অংকের ঋণ 'বহু দশক ধরে বহু সরকারের জন্য একটি বাস্তবতা' এবং খুব শীঘ্রই এই সাহায্য প্রত্যাহার করে নেওয়া দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ হবে।"
দেশটির অর্থমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিকে ক্ষতির হাত থেকে পুনরুদ্ধার করতে 'যা কিছু করা লাগে' তা করবেন তিনি। মহামারিতে দেশটির ৭ লাখেরও বেশি মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছে এবং অর্থনীতি ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে যা ১৭০৯ সালের পর থেকে গত ৩০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় পতন।
কোভিড সাপোর্ট প্যাকেজ হিসেবে যুক্তরাজ্যের ১ দশমিক ০৫৩ ট্রিলিয়ন পাউন্ডের বাজেট থেকে ৩৫২ বিলিয়ন পাউন্ডের বরাদ্দ রাখা হয়েছে যা দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
ভারত
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ভারত তাদের জিডিপির ৬ দশমিক ৮ শতাংশকে বাজেট ঘাটতি হিসেবে দেখায়, কারণ এ বছর তারা তাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে যথেষ্ট ব্যয় করার পরিকল্পনা করেছে।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ গত বছরের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ১৩৭ শতাংশ বাড়িয়েছেন। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের জন্য ৩৫ হাজার কোটি রুপি আলাদা রাখা হয়েছে বাজেটে।
সংস্কারের বিষয়ে একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে এই বাজেট। কারণ এটি ব্যাংকের মন্দ ঋণ গ্রহণের জন্য একটি অ্যাসেট রিকনস্ট্রাকশন কোম্পানি গঠনের ঘোষণা দিয়েছে এবং দুটি সরকারি ব্যাংক এবং একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বীমা সংস্থা পরিত্যাগ করেছে।
বাংলাদেশ
অর্থ ব্যয়কে উৎসাহিত করার জন্য এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বেশি অর্থ বরাদ্ধ করার বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা সবসময়ই বলে আসছেন। তবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কোনও বড় পরিকল্পনা ছাড়াই আগামী ১ জুলাই থেকে পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নেওয়া হলে, জিডিপির শতকরা হিসাবে ২০২১-২২ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত ব্যয় চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে কম হবে।
আর্থিক ঘাটতির কথা ভুলে গিয়ে প্রশস্ত সামাজিক সুরক্ষার জালকে অন্তর্ভুক্ত করে বড় একটি বাজেটের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বিদেশী উত্স থেকে আরও বেশি পরিমাণে নেওয়ার বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা যে পরামর্শ দিয়েছেন নতুন বাজেটে তা উপেক্ষা করেছেন অর্থ আমলারা।
প্রস্তাবিত নতুন বাজেট বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র ১৭.৪৬% হবে যা এই অঞ্চলের দেশ ভারতের ২৬.৯%, পাকিস্তানের ২২% এবং নেপালে ৩১% এর তুলনায় সবচেয়ে কম।
ধনী দেশগুলো তাদের বাজেটে অনেক বেশি ব্যয় করে। ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং আমেরিকার বাজেটের ব্যয় জিডিপির প্রায় ৬০ শতাংশ।
স্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ এর গবেষণা অনুযায়ী, উচ্চতর বরাদ্দ দেওয়া হলেও বাজেট বাস্তবায়ন ক্ষমতা ব্যয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি অর্থবছরে সরকার প্রথম ১০ মাসে বার্ষিক বাজেটের বরাদ্দের মাত্র ৪২ শতাংশ ব্যয় করতে পেরেছে যা গত বছরের তুলনায় কম।
২০২০ সালে জিডিপির অংশ হিসাবে গড় সামগ্রিক রাজস্ব ঘাটতি উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে ১১.৭%, উদীয়মান বাজার অর্থনীতিতে ৯.৮% এবং স্বল্প আয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলির ৫.৫% এ পৌঁছেছে।
বাংলাদেশের বাজেট ঘাটতি আগামী অর্থবছরের জিডিপির ৬.২% অনুমান করা হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের প্রাক্কলনের তুলনায় কিছুটা বেশি।
অর্থনীতিবিদরা পরামর্শ দিচ্ছেন যে, এরকম মহামারিকালীন পরিস্থিতিতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য যখন বাজারে অধিক টাকার লেনদেন একমাত্র উপায় তখন বাজেটে ঘাটতির বিষয়ে মোটেও দুশ্চিন্তা করা উচিত নয় বাংলাদেশের।
- মূল লেখা: World goes all out for recovery, Bangladesh yet to loosen its purse strings
- বাংলায় অনুবাদ: তারেক হাসান নির্ঝর