ব্যবসায়ের খরচ কমিয়ে মুনাফা বাড়াবেন কীভাবে
প্রশ্নটি আমার নয়; আপনার নিজের, আপনার নিজের কাছে। অনেক বছর ধরে ব্যবসা করছেন: কেউ ১০, কেউ ২০, আবার কেউ-বা ৪০ বছর ধরে; কিন্তু এতদিন ধরে যে মুনাফা করেছেন, সেটা কোথায় গেছে?
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনি জানেন না! আপনার প্রচুর মুনাফা হয়েছে, অথচ, আপনি সেই মুনাফা ধরে রাখতে পারেননি। এখন হাতে বেশি কাজ নেই, ব্যবসাসংক্রান্ত ব্যস্ততাও নেই; এখন ভাবুন, গভীরভাবে ভাবুন, কোনো কূল-কিনারা করতে পারেন কি না।
এখানেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনি কোনো হিসাব পাবেন না; কারণ আপনার রেকর্ড রাখার অভ্যাস নেই বা কম। যেখানে ব্যবসা হচ্ছে হিসাব-নিকাশের ব্যাপার, সেখানে হিসাব নেই কেন- যুৎসই উত্তরও নেই, যাতে প্রশ্নকর্তা নিজে নিজের উত্তরে খুশি হবেন।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমার সখ্য প্রায় দুই দশকের অধিক সময়ের। ছোট ব্যবসাকে বড় হতে যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি অনেক বড় ব্যবসাকে শেষ হয়ে যেতে। যারা ব্যবসা করতে গিয়ে এক সময় ব্যবসা থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাদের ইতিহাস দেখলে আপনি খেয়াল করবেন, স্বেচ্ছায় ব্যবসা থেকে বিদায় নিয়েছেন খুব কম ব্যবসায়ী। টিকে থাকতে পারেননি, তাই বিদায় নিতে হয়েছে। স্টার্ট-আপ কোম্পানির ক্ষেত্রে দেখা যায়, শুরু করার এক বছরের মধ্যে ৮০ শতাংশ নেই; আর ৫ বছর টিকে থাকে মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ।
যারা ব্যবসা থেকে বিদায় নেন বা যাদের ব্যবসা দুর্বল হতে থাকে, তারা কি মুনাফা করেন না? যদি করেন, তাহলে তারা টিকে থাকতে পারেন না কেন? নাকি তাদের খরচ অনেক বেশি, যে কারণে মুনাফা বেশ কম বা লোকসান দেন এবং এক সময় টিকতে না পেরে ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়েন?
করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশের সব ধরনের ব্যবসা সঙ্কটের মধ্যে পড়বে। অনুমান করা যায়, সব ব্যবসায়ী খরচ কমিয়ে মুনাফা ঠিক রেখে টিকে থাকতে সচেষ্ট হবেন।
আজকের নিবন্ধে ব্যবসায়ে খরচ কমিয়ে কীভাবে মুনাফা ধরে রেখে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যাবে, সে বিষয় নিয়ে পরামর্শ রাখা হয়েছে।
করোনা পরবর্তী সময়ে দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, ব্যবসার ধরণ পাল্টাবে, মুনাফা কমে যাবে বিক্রি ও দাম কমার কারণে- এটা সত্য; কিন্তু এখন থেকেই যিনি প্রস্তুতি নিবেন, তার জন্য সমস্যা অতটা প্রকট হবে না, যতটা প্রকট হবে প্রস্তুতিহীনদের জন্য। মূলকথা হচ্ছে, ব্যবসা থেকে মুনাফা বের করে আনতে হবে এবং পুঁজি হারানো যাবে না। কারণ মুনাফা না হলে এক সময় ব্যবসা টিকবে না। এখন মূলত টিকে থাকার লড়াই।
বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা কোম্পানির বিজনেস, ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক পরামর্শকের কাজ করছি। সেই কারণে অনেক কাস্টমার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। আমরাও চেষ্টা করছি টেলিফোনে কিছু গাইডলাইন দিতে। সবার মধ্যে যে উদ্বেগ সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে, সেটা হলো- কীভাবে টিকে থাকা যাবে।
ব্যবসায়ে মুনাফা- অল্প করে হলেও-অব্যাহত রাখতে পারলেই শুধু টিকে থাকা সম্ভব; না হলে সম্ভব নয়।
মুনাফা অব্যাহত রাখতে হলে যা যা করণীয় :
১। আপনি যে ধরনের ব্যবসাই করেন না কেন, আপনাকে আপনার ব্যবসায়ের ইনকাম স্টেটমেন্ট ও ব্যালান্সশিট সম্পর্কে ভালোমতো জ্ঞান রাখতে হবে এবং সেটা বিশ্লেষণ করা জানতে হবে। অবশ্য তার আগে সেটা তৈরি করা আবশ্যক। অনেক বড় বড় কোম্পানিতে দেখা যায়, ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করার সময় প্রয়োজনে পড়ে কোম্পানি আর্থিক বিবরণী বা ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট তৈরি করে, যেটাতে তাদের প্রকৃত আর্থিক চিত্র ফুটে ওঠে না। কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা বা আর্থিক স্বাস্থ্য জানা মালিকদের জন্য অত্যাবশ্যক। বিশেষ করে ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্ট দেখা খুব জরুরি।
নিজের ব্যবসায় কত নগদ টাকা ঢুকছে আর কত বের হচ্ছে, সেটার পরিষ্কার হিসেব আপনার কাছে থাকতে হবে, সেটা আপনাকে চেক করতে হবে নিজে। অনেকেই ব্যাংকের ঋণকে ক্যাশের ইনফ্লো হিসেবে বিবেচনা করেন, এটা ভুল। ঋণ আপনি ব্যবহার করতে পারবেন সুদের বিনিময়ে, কিন্তু ওটা আপনার প্রকৃত ক্যাশফ্লো নয়। আপনি যখন দৈনিক আপনার ব্যবসায়িক ক্যাশফ্লোর ওপর নজর রাখবেন, আপনার অযাচিত খরচ, অপচয় কমে যাবে। তবে কোম্পানির সবাইকে বুঝতে হবে, আপনি হিসেবে খুব যত্নবান।
২। ধরা হয় কোম্পানির ২০ শতাংশ কর্মী আপনার কাছে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ; কেননা, তারা আপনার কোম্পানির প্রায় ৮০ শতাংশ উন্নতির কারণ। আপনার এখন উচিত সেই ২০ শতাংশ কর্মীকে ভালোভাবে মূল্যায়ন করা। তাদের উপরে এখন আপনার কোম্পানির টিকে থাকা নির্ভর করছে। তাদের কোনোভাবে চটানো যাবেনা বা তাদের কোনো ধরনের সুবিধা কমানো যাবে না। বরং তাদের সুন্দর ব্যবহার দিয়ে সবসময় কোম্পানির প্রতি আন্তরিক করে রাখতে হবে; কারণ, তারা তাদের সামর্থ্যের পুরোটা দিলে এই খারাপ অবস্থায়ও কোম্পানি ভালো করবে।
যারা অদক্ষ, অসৎ, অকর্মণ্য- তাদের ব্যাপারে আপনাকে কঠোর হতে হবে। কোম্পানিতে করপোরেট গভর্নেন্স চালু করতে হবে, যেখানে নিয়োগ থেকে শুরু করে সমুদয় ব্যবস্থাপনা নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হবে। তাহলে আপনার কাছের অথর্ব লোকটি আপনার ব্যবসার কোনো ক্ষতির কারণ হবে না।
৩। আপনার ব্যবসা যদি হয় ট্রেডিং, তাহলে পণ্য প্রকিউরমেন্টের দিকে নজর দিন। একই টিমকে অধিক সময় ধরে একই দায়িত্বে না রেখে নিজে মাঝে মাঝে চেক করার পাশাপাশি টিম লিডার পরিবর্তন করলে অনেক টাকার সাশ্রয় হবে; চুরি, অপচয় ও অব্যবস্থাপনা কমে যাবে। আপনি যাকে বিশ্বাস করে ওই দায়িত্বে রেখেছেন, তার নৈতিকতা যাচাই করা জরুরি। বিক্রয়ের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ম্যানুফাকচারিং কোম্পানির জন্যও এই একই সতর্কবাণী।
৪। আপনার অফিস, ফ্যাক্টরি ও গুদামঘরের খরচ কমানোর দিকে মনোযোগ দরকার। আমরা একটু আরাম ও বিলাসপ্রিয়। এখন সময় একটু হিসেবি হওয়ার। যার ১০০০ স্কয়ার ফুট হলেই চলে, তার হয়তো রয়েছে ৩০০০ স্কয়ার ফুট অফিস স্পেস। বড় স্পেসের ভাড়া যেমন বেশি, অপব্যবহারও বেশি। আপনার পরিষ্কার করতে খরচ বেশি, লোকবল বেশি লাগে, ইউটিলিটি খরচও বেশি। এদিকে একটু মনোযোগ দিলে অনেক খরচ কমে আসবে।
যার দুটো ফ্লোর রয়েছে, তিনি এক ফ্লোরে চলে আসুন। তাছাড়া মেইন রোড থেকে একটু ভেতরে গেলে খরচ অর্ধেকে নেমে আসবে।
৫। আপনার অনেকগুলো ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। সেগুলো কমিয়ে আনা যায় কি না, দেখুন। কর্মীদের মাল্টিটাস্কার হতে অনুপ্রাণিত করুন। আপনি তো মাল্টিটাস্কার, তারা তা হতে পারবেন না কেন? অবশ্যই পারবেন।
তাছাড়া, এখন থেকে অনেক কাজ আপনি আউটসোর্সিং করতে পারবেন। তাতে কাজের গুণগত মানও ভালো হবে, সঙ্গে আপনার স্পেস ব্যবহারও কমে যাবে। আপনি আপনার মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট আউটসোর্সিং করতে পারেন, তাতে অনেক খরচ কমে যাবে, শুধু নিয়মিত তদারকি বজায় রাখতে হবে।
৬। অফিসের গাড়ি ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হলে আপনার খরচ বাঁচবে। যাদের বেশি গাড়ি, তাদের অপচয়ও বেশি। ড্রাইভার রাখতে হয়, তেলের হিসাব, গাড়ি ব্যবস্থাপনাসহ নানাবিধ খরচ করতে হয়; সঙ্গে গাড়ি নষ্ট হলে বাড়তি টেনশন তো রয়েছেই। আপনার একটা পুরো ডিপার্টমেন্ট লাগে গাড়ি ব্যবস্থাপনার জন্য।
আপনি গাড়ি ভাড়ায় রাখতে পারেন। সামগ্রিক বিচারে আপনার খরচ অর্ধেক হয়ে যাবে। অফিসের জন্য একটা গাড়ি রেখে বাকিগুলো ভাড়ায় নিলে আপনার মুনাফায় বেশ কিছু বাড়তি টাকা যোগ হবে।
ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। এক গার্মেন্টস মালিকের ড্রাইভারের বেতন ছিল ২০ হাজার টাকা; কিন্তু তার মাসিক আয় ছিল ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা। তেল থেকে শুরু করে গাড়ির নষ্ট যন্ত্রপাতি কেনা... এভাবে তিনি ওই বাড়তি আয় করতেন। মালিকও তার প্রতি নির্ভরশীল ছিলেন। এক ড্রাইভার যদি ৫০ হাজারের বেশি টাকা বাড়তি আয় করতে পারেন, তাহলে ওই কোম্পানিতে সব মিলিয়ে বাড়তি খরচ কেমন- অনুমান করা যায়। খরচ কমাতে হলে আপনাকে আগে অপচয়ের জায়গাগুলো খুঁজে বের করতে হবে।
৭। আপনার অফিসের জন্য অন্যান্য যন্ত্রপাতি, যেমন- কম্পিউটার, প্রিন্টার, ফটোকপিয়ার ইত্যাদি কেনার ক্ষেত্রে সতর্কতা এবং স্টেশানারিদ্রব্য ও অন্য যেকোনো টুকটাক কেনাকাটা আপনি অনলাইনে করতে পারেন; তাহলে অপচয় কমে আসবে। দেখা যায়, শুধু কেনার সময় অসতর্কতা ও অযত্নের কারণে একটা কোম্পানির খরচ ওই বিশেষ ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়।
৮। ব্যবসায় সময়কে মূল্যায়ন ও কাজে লাগানো অনেক জরুরি। আমরা সময়কে অযথা নষ্ট করি; ফলে কোম্পানিতে দক্ষতা তৈরি হয় না। সময়ের কাজ সময়ে করা যেমন জরুরি, তার চেয়ে বেশি জরুরি স্বল্প সময়ের মধ্যে কাজটা শেষ করে ফেলা এবং কাজ করতে গিয়ে প্রতি পদক্ষেপে উন্নয়ন করতে পারা।
যে কর্মী যত স্বল্প সময়ে নির্ভুলভাবে কাজটা করতে পারেন, সে কর্মী ততটা দক্ষ। যে কোম্পানিতে সময়কে মূল্যায়ন করা হয় না, দক্ষতাকে মূল্যায়ন করা হয় না, সে কোম্পানির উন্নয়নও চোখে পড়ে না।
৯। কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত ট্রেনিং ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করা খুব দরকার। বর্তমান সময়ে প্রতিদিন নতুন নতুন ধারণা, প্রযুক্তি ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে। এখানে কিছু খরচ হবে সত্য; কিন্তু ব্যবসায় টিকতে হলে কাস্টমারকে আপনার ভালো পণ্য ও সেবা উপহার দিতে হবে। দক্ষ টিম না হলে নিন্মমানের হবে আপনার সেবা ও পণ্য। একটি দক্ষ টিমই পারে একটা কোম্পানিকে দক্ষ ও টেকসই করতে।
১০। এখন ব্যবসায় টিকে থাকার সময়। যতদূর সম্ভব প্রযুক্তি নির্ভর হচ্ছে সামনের ব্যবসা। প্রযুক্তি ব্যবহারে যত্নবান হোন। তাছাড়া আপনার কোম্পানিকে টেকসই করার জন্য ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক পরামর্শকের সাহায্য নিন। তিনি আপনাকে পথ দেখাবেন- কীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করবেন, আর্থিক ব্যবস্থাপনা কীভাবে করবেন, ব্যবসায়ে ডাইভারসিফিকেশন করতে হবে কি না, করলে কখন কীভাবে... ইত্যাদি। আপনি এককভাবে সিদ্ধান্ত নিলে ভুল হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। ফলে কোম্পানির ব্যবসায়ে লোকসান হতে পারে।
তাছাড়া আপনি এখন ক্যাশ সংকটে পড়বেন। আপনার ব্যাংকের সঙ্গে ক্রেডিট লাইন ঠিক করে নিতে হবে। আর চেষ্টা করতে হবে কত কম খরচে ব্যাংকিং সেবা নেওয়া যায়।
মনে রাখতে হবে, এক টাকা বাঁচানো মানে এক টাকা মুনাফা করা। যে ব্যবসায়ী সততা, নিষ্ঠা ও মেধা দিয়ে তার খরচকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, তিনি এক সময় ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়বেন, এটাই স্বাভাবিক। আর যিনি পারেন, তার ব্যবসার বৃদ্ধি হয়, টেকসই হয়, করোনাকালেও তিনি টিকে থাকেন ভালোভাবে।
- লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল