ভারতীয় রাজনীতিতে নেতাজির আদর্শে সাম্প্রদায়িক রঙ চড়াচ্ছেন মোদি-মমতা জুটি
পশ্চিমবাংলার আসন্ন নির্বাচনের আগে ভারতীয় রাজনীতির মধ্যগগনে আবির্ভূত হলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস। ১৮৯৭ সালে জন্মগ্রহণকারী এই নেতা অবিভক্ত বাংলা তথা ভারতবর্ষের মানুষের কাছে মধ্যমণিতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন; মোদির উত্তরসূরি গুজরাটি নেতৃত্বের (মহাত্মা গান্ধীর) প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার মাধ্যমে।
গুজরাটি গান্ধীর বিরোধিতা করা সত্ত্বেও ১৯৩৮ সালে প্রথমবার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর দ্বিতীয় বার নির্বাচিত হন ১৯৩৯ সালে। সেবার গান্ধী অনুসারীরা, বিশেষ করে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু ও সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল- এরা সবাই নেতাজির বিপক্ষে দাঁড়ান। নেতাজি সুভাষ বুঝতে পারেন যে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস যে ধারায় স্বাধীনতা আন্দোলন করছে তার মাধ্যমে প্রকৃত স্বাধীনতার কোন কিছুই অর্জিত হবে না । তখন সুভাষ বোস কলকাতা থেকে অন্তর্ধানে চলে যান। পরবর্তীতে জাপানে তাকে দেখতে পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য উৎখাতের লক্ষ্যে জাপানের সামরিক শাসক, রাজনীতিবিদ এবং জার্মানির একনায়ক হিটলারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। নেতাজি ব্রিটিশ শাসনের অধীন থেকে জাপানি দখলদারিত্বে চলে যাওয়া- সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন। দলে দলে ভারতীয়রা সেই ফৌজে যোগ দিতে শুরু করে। আজাদ হিন্দ ফৌজও ভারতের দিকে অগ্রসর হয় জাপানিদের সহায়তায়। তাদের মিয়ানমারে প্রবেশের মুহূর্তে ব্রিটিশরাজ বুঝতে পারে; যদি এই সেনাবাহিনী ভারতীয় অংশে প্রবেশ করে তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে যে ভারতীয়রা ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে কাজ করছে- তারা সবাই বিদ্রোহ করবে। এমন একটি গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতেই ব্রিটিশরা তাদের ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করে।
বৃটেনের যুদ্ধকালীন সরকার ছিল লেবার পার্টির ক্লিমেন্ট এটলি এবং চার্চিলের যুক্তফ্রন্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে চার্চিল প্রধানমন্ত্রী এবং এটলি উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনা করেন এবং নির্ধারিত নির্বাচনকে পিছিয়ে দেন। যুদ্ধশেষে তারা ১৯৪৫ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচনে এটলি জয়ী হলে প্রথমবারের মতন লেবার পার্টি নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় এসেই লেবার পার্টির ঘোষিত কর্মসূচি অনুসারে ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বৃটেনের লেবার পার্টি আশঙ্কা করছিল যে, ভারতের রাজনীতিতে যে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে তার পরিণতিতে হয়তো ইউরোপিয় অধিবাসীরা আক্রমণের শিকার হবেন। তখন প্রশাসনের পক্ষে আর তাদের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হবে না। সেই কারণে ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করে অনেকটা পালিয়ে যাবার মতো করেই।
১৯৪৭ সালের মার্চে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভারতের গভর্নর জেনারেল করে পাঠানো হয়। মাউন্টব্যাটেন আড়াই মাসের মাথায় অবিভক্ত ভারতকে দ্বিখন্ডিত করার পর ভারত ছাড়ে ব্রিটিশ সরকার। সেজন্য লেবার দলের মন্ত্রী পরিষদ মিশন ভারতেও আসে ভারতীয় রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনার জন্য।
তবে, প্রকৃতপক্ষে নেতাজি সুভাষ বোসের আজাদ হিন্দ ফৌজ পরাজিত হলেও তাদের আত্মত্যাগ, বীরত্ব এবং ভবিষ্যৎ ভীতি ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করে। নেতাজি ১৯৩০ এর দশকের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি জানতেন, সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া ব্রিটিশদেরকে ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য করা যাবে না। নেতাজি মনে করতেন, গান্ধী অহিংসার কথা বলে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব এই ধারণা সৃষ্টি করেছিলেন; প্রকারান্তে ব্রিটিশদের সঙ্গে এক ধরনের সহযোগিতামূলক জায়গা থেকেই। ভারতের স্বাধীনতাও তিনি তেমন করেই চেয়েছিলেন অনেকটা ব্রিটিশরা যেমন স্বাধীনতা দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ক্যানাডাকে। অর্থাৎ, সাংবিধানিকভাবে ব্রিটিশ মুকুটের প্রতি আনুগত্য রেখে এক ধরনের আধা- ডোমিয়ন।
তাই গান্ধী যখন ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার স্বপক্ষে গান গাইছিলেন, তার সঙ্গেই ছিল তখনকার জাতীয় কংগ্রেস। কিন্তু নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তার বিপক্ষে ছিলেন। মতবিরোধ চরমে ওঠায়, ১৯৩৯ সালের এপ্রিলে নেতাজি জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করেন এবং ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৯৪০ সালে নেতাজি অন্তর্ধানে চলে যান। এই অন্তর্ধান ছিল ভারত থেকে পালিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার নেতাজি সুভাষ বোসকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে এবং তারপর দীর্ঘকাল ভারতীয় রাজনীতিতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু মূলধারার রাজনীতিতে খুব একটা প্রাসঙ্গিকতা পাননি।
তার জীবনকথা, তার কর্মকাণ্ড, অসাম্প্রদায়িক আদর্শ; সবকিছু ভারতীয় জনগণের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে । আজও ভারতীয় রাষ্ট্রকর্তৃক নেতাজির শেষ পরিণতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি। ব্রিটিশদের ঘোষিত বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর স্বীকৃতিটাই প্রচার করা হয়। যদিও, মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা- সিআইএর তত্ত্বে বলা হয়েছে, এমন কোন বিমান দুর্ঘটনার ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। বরং এ সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিনের আদেশে সুভাষের হত্যার কথা বলছে সিআইএ'র গোপন এক নথি ।
ফিরে আসা যাক বর্তমানে। অধুনা ভারতে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছেন মোদি। তার হঠাৎ নেতাজিপ্রীতি গভীরভাবে প্রকাশ করলেন গতকাল শনিবার (২৩ জানুয়ারি) পশ্চিমবাংলায় আগমন করে। নেতাজির জন্মদিনের অনুষ্ঠান করার ভেতর থেকে আসলে মোদির উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতিতে যে ধর্মান্ধতার সৃষ্টি করা হচ্ছে; বিজেপির নেতৃত্বে তাকে প্রতিষ্ঠা করা। পশ্চিমবাংলায় গতকাল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে যে আনুষ্ঠানিক সভা অনুষ্ঠিত হয়; সেখানে মমতা ব্যানার্জি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে উত্তরীয় উপহার দেযন। মোদিজিকে একথা পরিষ্কার করে দেন যে মোদি এবং মমতার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক এখনো বহাল । বরং নেতাজি সুভাষ বোসের আদর্শ কখনোই এই সম্পর্কের মধ্য অন্তরায় ছিল না।
মমতা ব্যানার্জি এক নতুন কৌশল অবলম্বন করলেন গতকাল মোদির সঙ্গে স্মৃতি গ্যালারি ঘুরে দেখে। পাশাপাশি মমতা এক নতুন দাবি তুললেন যে, ভারতের নাকি চারটি রাজধানী করতে হবে, তার মধ্যে একটি হবে কলকাতা। ভারতের চারটি ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে তাদের লোকসভা অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে হবে। এধরনের ঘটনা পৃথিবীতে বিরল হবে, যদি তার বাস্তবায়ন হয় ।
পৃথিবীতে জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত ২৩টি ফেডারেল রাষ্ট্র আছে। ফেডারেল রাষ্ট্রে এধরনের ব্যবস্থা প্রচলিত নয় যে; চারটি রাজধানীতে চারটি অধিবেশন কক্ষ থাকবে। ভারতের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে দুর্বল হচ্ছে এবং সেই দুর্বলতাকে কাটানোর জন্যই যে সম্প্রদায়িক রাজনীতির পশ্চিমবাংলায় এই দ্রুত আগমন- তা উপলব্ধি করা যায়।
ভারতীয় সংবিধান রচনা করার সময়ে রাজ্যগুলোকে যতটা স্বাধীনতা ক্ষমতা দেওয়া উচিত ছিল- তা করা হয়নি। যেকারণে আজ ভারতে নতুন রাজনৈতিক দর্শনের আবির্ভাব হচ্ছে। নেতাজিকে একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল যেভাবে ভারতীয় জনগণের কাছে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে- তা নেতাজির আজীবন লালিত আদর্শের পরিপন্থী।
আর্থিক উন্নয়নের আজকের ভারতীয় রাজনীতি; ১৯৩০ এর দশকে নেতাজির সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কংগ্রেস ত্যাগ করে ফরওয়ার্ড ব্লক নামক বামপন্থী রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার সম্পূর্ণ বিপরীত। আদর্শের জন্যেই তিনি ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন। কেন্দ্রে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সঙ্গে নেতাজির ঐতিহাসিক বিরোধের কারণেই আজও ভারতীয় রাজনীতিতে তাকে ঘিরে সাম্প্রদায়িকতার অপচ্ছায়ারা সক্রিয়। অথচ, তার মৃত্যু নিয়ে আজও ধোঁয়াশা কাটেনি। তার আদর্শের ভ্রান্ত অনুবাদও যেন দিনেদিনে জোরালোই হচ্ছে।