ভয় ও লোভ: শেয়ার বাজারের দুই বিনাশী শত্রু
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে শেয়ার বাজার বেশ কিছুদিন ধরে বন্ধ। স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। মহামারির প্রকোপ কমলে এবার শুরু হবে শেয়ার বাজারে লেনদেন। যেহেতু মানুষের আয় কমেছে, কারও-বা আয় বন্ধ, শেয়ার বাজারে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতার সংখ্যা তাই বেশি হবে; দরপতন ঘটার আশঙ্কা বেড়ে যাবে।
এখন যারা যারা শেয়ার ব্যবসা করেন, বিশেষ করে যারা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, তাদের খুব হুঁশিয়ার হতে হবে। 'লোভ' আর 'ভয়' বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকে খুব প্রভাবিত করে। এই দুই আবেগ ক্ষতিও করে অনেক বেশি। শেয়ার বাজারে লেনদেন শুরু হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়া যাবে না বিক্রির জন্য। আপনাকে খুব ধৈর্যশীল হতে হবে কেনা ও বেচা- উভয়ক্ষেত্রে; বিশেষ করে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায়।
দেশের শেয়ারবাজার নিয়ে লিখতে গেলে আমার ১৯৯৬ সালের কথা মনে পড়ে। একটা ছোট্ট গল্প দিয়ে শুরু করি। তখন আমি একটা ব্যাংকের সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছি। শেয়ার বাজার নিয়ে তখন এত মাতামাতি, মানুষজন সব বাজার-ঘাট বাদ দিয়ে শেয়ার বাজার নিয়ে ব্যস্ত। আমার এক শ্যালক তার বাবার কাছ থেকে এক প্রকার জোর করে কিছু টাকা নিয়ে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করল। ৬ হাজার টাকা কয়েকদিনেই ১২ হাজার টাকা হয়ে গেল। তার উদ্দীপনা দেখে কে! আমার কাছে ঘুর ঘুর করে। একদিন এসে প্রস্তাব দিল, 'মাত্র ১২ হাজার টাকা দিন, মাত্র এক সপ্তাহ পরে আপনাকে ২০ হাজার টাকা দেব।' বাড়তি যদি কোনো টাকা থাকে, সেটার দাবি আমি করতে পারব না।
আমি রাজি হলাম। শর্ত দিলাম, যদি লোকসান হয় তবে অন্তত আমার মূল টাকাটা ফেরত দিতে হবে। সে রাজি। উল্লেখ্য, তখন শেয়ার ছিল কাগুজে। ইলেকট্রনিক শেয়ার তখনো চালু হয়নি। তাছাড়া তখন কার্ব মার্কেট চালু ছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়েও শেয়ার কেনাবেচা হতো। পরে কোম্পানি থেকে মালিকানা বদল করা যেত।
যাহোক, আমি তাকে ১২ হাজার টাকা দিলাম। সে দ্রুত একটা জুতা কোম্পানির কাগুজে শেয়ার কিনল রাস্তা থেকে। ১০-১২ দিন পর সেটির দাম সত্যি বেড়ে গেল। সে দৌড় দিল সেগুলো বিক্রির জন্য। আমি খুব খুশি মনে বসে আছি। সে আজ আমার টাকা ফেরত দিবে লাভসহ। পরের দিন সে আমার অফিসে এসে আমার সামনের চেয়ারে খুব মন খারাপ করে বসে থাকল কিছুক্ষণ। আমি কারণ বুঝলাম না। জিজ্ঞেস করতেই খুব মন খারাপ করা একটা খবর শুনলাম। সে যে শেয়ারগুলো কিনেছিল, সেগুলো জাল। তাই বিক্রি করতে পারেনি। আমার মূলধন হারিয়ে গেল।
সম্পর্কে শ্যালক, কিছু বলতে পারলাম না; যদিও শর্ত দেওয়া ছিল। এখানে আবেগের চেয়ে লোভটা বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। তাই সাত-পাঁচ না ভেবে আমরা ওই শেয়ার ব্যবসা করতে গিয়েছিলাম। আমি নিজে কিনলে সতর্ক থাকতাম; রাস্তা থেকে কিনতাম না। উল্লেখ্য, আমার ওই প্রিয় শ্যালক পরবর্তীকালে, ২০১০ সালে শেয়ার বাজারে তার বাবার মৃত্যুর পর পাওয়া পেনশনের টাকা পুরোটাই হারিয়েছে।
আমি বলেছি সে পুরোটা হারিয়েছে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে। আসলে তো পুরোটা শেষ করা কঠিন; কারণ, যেসব কোম্পানির শেয়ার সে কিনেছিল, সেইসব কোম্পানি তো উৎপাদন বন্ধ করে দেয়নি। সেসব কোম্পানি আগের মতোই চলছে; তবে আমার শ্যালকের টাকাটা পুরো নষ্ট হলো কীভাবে?
ঘটনাটা ২০১০ সালের। শেয়ার বাজার যখন ষাঁড়ের মতো দৌড়াচ্ছে, যাকে আমরা বলিবুল মার্কেট। দেশের সব প্রান্তের মানুষ তখন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে শেয়ার বাজারে। আজ কিনলেই কাল লাভ! যার যা আছে, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানুষ বিনিয়োগের জন্য। অনেক উচ্চসুদে ঋণ করেও অনেকে দৌড় দিয়েছে সেখানে অনেক লাভ করার জন্য; বুঝে, না বুঝে। সে শেয়ার কেনার সময় ১:১ ঋণ করেছে ব্রকারেজ হাউস থেকে; মানে নিজের ১০০ টাকা হলে ঋণ নিয়েছে ১০০ টাকা।
বিপত্তিটা সেখানে। নিজের ১০০ টাকার কোনো সুদ দিতে হয় না। কিন্তু ব্রকারেজ হাউস থেকে ঋণকৃত ১০০ টাকার বিপরীতে মাসে সুদ দিতে হয় ১৪-১৫ শতাংশ; তাও আবার চক্রবৃদ্ধি হারে। দেখা গেল, ২০০ টাকা দিয়ে শেয়ার কিনেছে চারটি; প্রত্যেকটি শেয়ারের দাম ৫০ টাকা। যদি পরের সপ্তাহে দাম বেড়ে ৩০০ টাকা হয় আর শেয়ার ধারক বিক্রি করে দেন, তাহলে লাভ থাকে ১০০ টাকার কিছু কম। কারণ, ব্রকারেজ হাউস কমিশন বাবদ কিছু টাকা কাটবে।
আমার আত্মীয়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। শেয়ারের দাম বেড়ে ৪০০ টাকা হয়েছিল। তার আশা ছিল, ৮০০ টাকা হলে বিক্রি করবে। ৪০০ টাকা হওয়ার পর মার্কেট কমতে শুরু করে একসময় ৩০০ টাকায় আসে; প্রত্যাশা- আবার বাড়বে। তারপর কমে ২০০ টাকা, পরে ১৫০ টাকা, পরে ১০০ টাকা, পরে ৭৫ টাকা, পরে ৫০ টাকা। এখন দেখুন, শেয়ারের দাম মাত্র ৫০ টাকা; অন্যদিকে ঋণ সুদসহ ১২০ টাকা। অর্থাৎ শেয়ার বিক্রি করে দিলে ঋণ সমন্বয় হবে ৫০ টাকার কিছু কম; কারণ কমিশন বাদ যাবে। তাহলে নিট ঋণ থাকবে কত? ধরুন ৭১ টাকা (১২০-৪৯)। শেয়ার পুরোটা বিক্রি করলেও ঋণ বাবদ পকেট থেকে দিতে হবে ৭১ টাকা।
দেরি করলে আর শেয়ারের দাম না বাড়লে প্রতিদিন ১৪-১৫ শতাংশ হারে সুদ যোগ হবে ঋণের। ফলে ৭১ টাকা প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়বে। এক সময় ১৭১-এ যাবে; গেছেও তাই। ওদিকে ব্রকারেজ হাউসের উচিত ছিল, যখন ঋণ সমন্বয় করা যেত, শেয়ার বিক্রি করে তখন সেটা করা; কিন্তু তারাও সেটা করেনি। পরে তারাও আটকে গেছে। আমার আত্মীয় তার বাবার পেনশনের টাকাটা হারিয়েছে; সঙ্গে ঋণের বোঝা তার মাথার ওপর। যদি সে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিত, তাহলে এমন হতো না।
ভেবে দেখুন, বাবার পেনশনের টাকায় কতজনের অধিকার? তাহলে পারিবারিক সম্পর্কটা কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকার কথা?
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীর সিদ্ধান্ত মূলত দুই ধরনের আবেগে চালিত: ভয় ও লোভ
বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে এই দুই আবেগ এত বেশি কার্যকর, যা একটু নজর দিলেই বোঝা যায়। আমরা খুব সাহসী জাতি, তার প্রমাণ অনেকবার দিয়েছি; কিন্তু শেয়ার বাজারের ক্ষেত্রে এসে দেখি, আমরা খুব ভীতু। ভয় নামক এই ধ্বংসকারী ঋণাত্মক আবেগ আমাদের খুব অল্পতেই আক্রান্ত করে। কে কী বলল- তা শুনেই আমরা শেয়ার বিক্রি শুরু করে দিই! কে কী গুজব ছড়াল, আমরা হাতে থাকা সব শেয়ার একেবারে বিক্রি করে হাত খালি করে ফেলি! অর্থমন্ত্রী বললেন, শেয়ার বাজার ভালো হবে, সবাই লাইন ধরে শেয়ার কিনি! পরের দিন গভর্নর বললেন, সামনে সঙ্কোচনমূলক আর্থিক নীতি ঘোষণা করা হবে, ঋণ প্রবাহ কমে যাবে- সঙ্গে সঙ্গে শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করি দল বেঁধে! কি দারুণ বোকামি!
যারা বুদ্ধিমান, তারা আপনার শেয়ার কম দামে কিনে নিচ্ছেন। আপনি লোকসান করছেন নিজের ভয়ের কারণে; দোষ দিচ্ছেন অন্যের, দোষ দিচ্ছেন সরকারের। কেন? আপনি খেয়াল করে দেখুন, কিছুদিন পর আবার শেয়ার বাজার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। লোকসান কে করছে? আপনি। কথায় বলে, শেয়ার বাজারে পচানব্বই ভাগ লোক লোকসান করে আর মাত্র পাঁচ ভাগ লোক লাভ করে। আপনি ভয় পেয়ে শেয়ার বেচবেন না, তাহলে আপনি ওই পাঁচ ভাগের দলভুক্ত হবেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা অধিকাংশ লোক শুধু ভয়ের কারণে এবং অবশ্যই জ্ঞান ও ধৈর্যের অভাবে পচানব্বই শতাংশ বিনিয়োগকারীর দলভুক্ত হয়ে পড়ি।
আর একটি আবেগ হচ্ছে 'লোভ'- যা আমাদের বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয় অনবরত। আমরা একটা শেয়ারে কত লাভ করতে চাই? ১০ শতাংশ? ২০ শতাংশ? ২৫ শতাংশ?
যারা ট্রেড করেন বা স্বল্প সময়ের জন্য বিনিয়োগ করেন, তাদেরকে বলছি, যদি ১০০ টাকার শেয়ার ১১০-১১৫ টাকা হয়, তখন আপনার শেয়ার ছেড়ে দিন, (যদি আপনি দীর্ঘ সময়ের জন্য বিনিয়োগ করেন, সে কথা ভিন্ন)। অপেক্ষা করুন আর একটি ভালও শেয়ার খুঁজে বের করুন; তারপর তাতে বিনিয়োগ করুন। যদি মনে করেন, আপনার শেয়ারের দাম প্রতিদিন বাড়বে, এক মাসে বা এক বছরে দ্বিগুণ হবে, তবে আপনি অতিশয় লোভী ব্যক্তি। লোভকে দমিয়ে রাখুন। আমার আত্মীয় যখন ২০০ টাকা দিয়ে কেনা শেয়ারের দাম ৩০০, পরে ৪০০ টাকা হয়েছিল- তখন যেকোনো সময় বিক্রি করে দিতে পারত; কিন্তু লোভ তাকে বারণ করেছিল। এই লোভের লাগাম টেনে ধরা খুব জরুরি।
বিনিয়োগ গুরু ওয়ারেন বাফেট শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীদের একটা গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'আপনি ভয় করুন যখন অন্যরা লোভ করে, আর লোভ করুন যখন অন্যরা ভয় করে।' অন্যরা যখন বেশি লাভের আশায় শেয়ার ধরে রাখে, তখন আপনি বিক্রি করুন; আবার অন্যরা যখন ভয় পেয়ে শেয়ার বিক্রি করে, তখন আপনি লোভ করে কিনুন। কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি বুঝতে হলে শেয়ার বাজার সম্পর্কে পড়াশোনা করতে হবে, বুঝতে হবে।
আমার দুই দশকের অভিজ্ঞতা বলে, শেয়ার বাজার একটা ঘুরন্ত চাকার মতো- যা কখনো এক জায়গায় থেমে থাকে না। সর্বনিম্নে নেমে তা আবার উপরে ওঠে। আপনাকে সেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থাকতে হবে- কখন আপনি শেয়ার কিনবেন, কোন শেয়ার কিনবেন আর কখন তা বিক্রি করবেন। আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। কিন্তু আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি, একটু লোভ থাকা দরকার; না হলে মানুষ বড় হতে পারে না। তবে লোভের মাত্রা যদি সীমা ছাড়িয়ে যায়, ভিন্ন কথা।
ইদানিং কিছু কিছু ফেসবুক পেজে অনেক বিনিয়োগকারী দেখি হট আইটেমের খোঁজ করেন। কেউ কেউ বলেন, আমাকে ইনবক্স করুন যদি হট আইটেম চান, যেটার দাম কালকেই বাড়বে। এইভাবে অনেকে আইটেম খোঁজার রোগে আক্রান্ত। আরে বাবা, শেয়ার বাজার কোনো মূর্খের বাজার নয়, এখানে বিনিয়োগ করা খুব সহজ কাজ নয়; অনেক লেখাপড়া করে এখানে আসা উচিত। দেখা দরকার, বোঝা দরকার- কোন শেয়ার আপনার কেনা উচিত। এমন শেয়ার কিনুন, যে শেয়ারের দাম থাকবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পুড়ে গেলেও বা বন্ধ হয়ে গেলেও।
কিন্তু সেটা তো আমরা করব না! আমরা অন্যের কাছে আইটেম চাইব, কারা গেম করছে তাদের খুঁজে বের করব; তারপর সেইসব বুদ্ধিমান মহারথিদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ধরা খাব, আর দোষ দেব দেশের, সরকারের, প্রধানমন্ত্রীর, অর্থমন্ত্রীর, গভর্নরের- এটা মোটেই কাম্য নয়। তবে শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কেউ যদি ভুল করে, আমরা কিছু বলব না- তা নয়। নিজে প্রশিক্ষিত হওয়া জরুরি। নিজের শিক্ষা, মেধা মনন, চিন্তা, পড়াশোনা কাজে লাগানো দরকার।
ভয় আর লোভকে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিন, আপনি শেয়ার বাজার থেকে লাভ করতে পারবেন। অন্যরা পারলে আপনি কেন নয়? নিজে তৈরি হোন। এটা অন্যের ওপর নির্ভর করে কাজ করার জায়গা নয়; গুজবে কান দিয়ে কাজ করার জায়গা নয়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে শেয়ার বাজার অনেক বাড়বে- এমন প্রত্যাশা করা বোকামি। তাই ধৈর্য ধরে, চিন্তা করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভয় পেয়ে নয়।
- লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল