যে সংখ্যা আমরা চাইনি
ধীরে ধীরে স্মৃতির বিবর্ণ পাতায় ম্লান হয়ে আসছিল কোভিড-১৯।
কোভিড-১৯ শনাক্ত ও মৃত্যুর তালিকা প্রতিদিনই পাঠাত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এদিকে কারোই তেমন মনোযোগ ছিল না। কারণ, মহামারির শুরুর দিনগুলোতে হাসপাতাল, আইসিউতে মানুষের ঠাঁই না হলেও সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতির কারণে এক সময় হাসপাতাল, আইসিইউ খালি পড়ে ছিল। অনেক হাসপাতালেরই কোভিড ইউনিট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
লকডাউনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আবারও পূর্ণ উদ্যমে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু হয়, ব্যবসায় আস্থাও বাড়তে থাকে। চারদিকে ছিল ইতিবাচক সংবাদ, দেশের পরিস্থিতি ভালোর দিকেই এগোচ্ছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের শনাক্ত ও মৃত্যুর রেখাতে এ চিত্রের প্রমাণ মেলে। কিছু বিচ্যুতি ছাড়া ১ জুলাইয়ের কাছাকাছি সময়ে সংক্রমণ ও মৃত্যু রেখা একদম উঁচুতে গিয়ে আবার নামতে শুরু করে।
তারপর ১ মার্চ থেকে দুটি রেখাই প্রায় ৯০ ডিগ্রি কোণে উলম্বভাবে একটানা উপরে উঠতে থাকে, যেন শেষ নেই আর।
গতকাল এমন এক চিত্র দাঁড়িয়েছে, যা একাবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর এ পর্যন্ত ১০ হাজার মানুষ কোভিডজনিত কারণে মারা গেছেন।
আমরা যদি দলে দলে কক্সবাজার, শপিংমলে গিয়ে ভিড় না করতাম, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতাম, সামাজিক অনুষ্ঠানে জমায়েতের ক্ষেত্রে এতটা অসাবধান না হতাম- আমরা এতটা নির্বিকার না হলে এ পরিস্থিতি অনেকটাই এড়ানো যেত।
ভিত্তিহীন ব্যতিক্রমবাদের চিন্তা, 'ভাইরাস আমাকে আক্রান্ত করবে না' ও 'বাংলাদেশিরা কোভিড থেকে নিরাপদ'- এ ধরনের ভাবনা আমাদের আবারও এমন পরিস্থিতিতে নিয়ে এসেছে যে, আবারও লকডাউনের প্রয়োজন পড়েছে। এমনকি লকডাউনও প্রহসনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আবার, সংক্রমণ ছড়ানো ও কোভিডজনিত কারণে মৃত্যুর দূরতম সম্ভাবনার চেয়েও ক্ষুধায় মৃত্যু বেশি ভয়াবহ মনে হওয়ায় ভাইরাসকে পাশ কাটিয়ে যেতে আমরা বাধ্য হয়েছি।
আমরা প্রায় সবাই পরিচিত কাউকে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে দেখেছি। গতকালের সর্বমোট ১০ হাজার সংখ্যাটি তো শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে নথিভুক্ত মৃত্যুর সংখ্যা। বাস্তব চিত্র এর কয়েকগুণ বেশি হতে পারে। হাসপাতালে জায়গা না থাকা ও চিকিৎসার খরচ যোগানো সম্ভব না হওয়ায় অনেক রোগী বাসায় মারা যাচ্ছেন।
সংক্রমণ ও মৃত্যুর রেখায় লকডাউনের কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু তারপর?
আগের মতোই স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়ে গেলে আবারও শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। তাহলে কী করতে পারি আমরা? আবারও লকডাউন?
টিকাদান কর্মসূচী চলছে। টিকাদান কর্মসূচীর বড় প্রভাব তো থাকবেই, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার হার নিয়েও নিত্যনতুন বিতর্ক চলছে। ভ্যাকসিন হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু ঠেকাতে পারে, কিন্তু সবাই সামাজিক দূরত্ব মেনে না চললে সংক্রমণ কমবে না। এক্ষেত্রে দায়িত্ব শুধুই সরকারের নয়, আমাদের সার্বিক দায়িত্বও সমানভাবে গুরূত্বপূর্ণ।
একটি ব্যাপার নিশ্চিত, সামনের বছরগুলোতেও কোভিড-১৯-এর অস্তিত্ব থাকবে। এ কারণেই টিকাদানকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া আরও বেশি জরুরি। প্রতিনিয়ত ভাইরাসের নতুন ধরনের দেখা মিলছে, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন ভাইরাসের অনেক ধরনের বিরুদ্ধেই অপেক্ষাকৃত কম কার্যকর।
যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের ধরনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারে- এমন ভ্যাকসিন কিনতে অনুসন্ধান ও ভ্যাকসিন সংগ্রহের দিকে নজর দিতে হবে।
ভবিষ্যতে করোনাভাইরাসের ওয়েভ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিতে দীর্ঘ মেয়াদি ব্যবস্থা নিতে হবে বাংলাদেশকে। এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, বাংলাদেশে আদর্শ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ কিউবাই তার প্রমাণ। আমাদের শুধু নেতৃত্বে দূরদর্শিতা প্রয়োজন।
এককালীন বিষয় ধরে নিয়ে মহামারির ওয়েভ নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না, বরং আসন্ন আরও অনেক ওয়েভের প্রস্তুতি রাখতে হবে।
অন্যথায়, গতকালের ১০ হাজার আগামীতে আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
- লেখক: সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
ইংরেজি থেকে অনূদিত - মূল লেখা: A number we did not want