রাষ্ট্র যখন ভাবমূর্তি সংকটে
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনামূলক কন্টেন্ট শেয়ার করে দেশের ভাবমূর্তি 'ক্ষুণ্ণ' করার অভিযোগে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারকৃত কারাবন্দি লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সম্পর্কে নতুন করে এক পুরনো প্রশ্ন তুলেছে। সংবিধানের ১১তম অনুচ্ছেদের আদলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যেমন হওয়ার কথা ছিল বর্তমানে দেশের ভাবমূর্তি তার ঠিক বিপরীতই বলা যায়।
রাষ্ট্রীয় নীতির মৌলিক নীতিমালার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুটি স্তম্ভ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে: "প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে…"
দেশের সর্বোচ্চ আইনের প্রস্তাবনায় আরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, "রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।"
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল, প্রস্তাবনায় ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাপকাঠি ধরা হয়েছে "গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে।"
রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত নীতি নির্ধারক ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা উপরিল্লিখিত প্রতিশ্রুতি ও মৌলিক নীতিমালা মেনে চললে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবেই।
কিন্তু কারাগারে মুশতাক আহমেদের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুতে রাষ্ট্রের একেবারেই ভিন্ন ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। দমনমূলক আইন প্রণয়ন, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ ও বাকস্বাধীনতা হরণ, সমালোচকদের গ্রেপ্তার ও জামিন নামঞ্জুর করা, বিচার বহির্ভূত হত্যার প্রতি রাষ্ট্রীয় সহনশীলতা- বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বর্তমানে এমন অবস্থার অভিযোগ উঠেছে। পদ্ধতিগতভাবে এসকল কাজই মুশতাক আহমেদকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
তবে মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পরই হঠাৎ করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এমন অবস্থায় এসেছে এমনও নয়। গণতন্ত্র চর্চা, আইনের শাসন, দুর্নীতি দমন ও মানবাধিকার রক্ষায় বৈশ্বিক দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই।
প্রথমেই গণতন্ত্র সূচকের দিকে তাকানো যাক, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) সূচকে ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬তম।
নির্বাচনী ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, সরকারের সক্রিয়তা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক অধিকার- এই পাঁচ মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে দেশগুলোর পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই সূচক তৈরি করে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।
৫ দশমিক ৯৯ স্কোর নিয়ে সূচকে 'মিশ্র শাসন' তালিকায় আছে বাংলাদেশ। এই সূচক অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক চর্চা রয়েছে, কিন্তু নিয়মিত নির্বাচন হলেও বিভিন্ন অনিয়মের কারণে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন চলে এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থাও রয়েছে এমন দেশগুলোই 'মিশ্র শাসন' (হাইব্রিড রেজিম) তালিকার অন্তর্ভুক্ত।
তারপর আসা যাক সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায়। গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র হিসেবে বিবেচিত বাকস্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রহিত হচ্ছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ) মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১ তম। সর্বশেষ প্রকাশিত সূচকে আগের বছরের চেয়ে এক ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ২০১৬ সাল থেকেই বাংলাদেশের অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি।
আন্তর্জাতিক সংগঠনটি প্রতিবছর ১৮০ দেশ ও অঞ্চলের সাংবাদিকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করে এ সূচক প্রকাশ করে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের (ডব্লিউজেপি) গত বছরের মার্চে প্রকাশিত আইনের শাসন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫ তম। এর আগের বছর প্রকাশিত সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১২ তম, অর্থাৎ সর্বশেষ প্রকাশিত সূচকে দুই ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ।
১২৮টি দেশের ওপর জরিপ চালিয়ে দেশগুলোতে আইনের শাসনের অবস্থার ওপর এই সূচকের তালিকা প্রস্তুত করে ডব্লিউজেপি। ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতির অনুপস্থিতি, উন্মুক্ত সরকার, মৌলিক অধিকার, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতার প্রয়োগ, নাগরিক ন্যায়বিচার এবং ফৌজদারি বিচার- এই আটটি মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে এই সূচক তৈরি করে সংস্থাটি।
ডব্লিউজেপি'র আইনের শাসন সূচক প্রতিবেদন-২০২০ অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। সূচকে নেপালের অবস্থান ৬১ তম, শ্রীলঙ্কা ৬৬ তম ও ভারতের অবস্থান ৬৯ তম। সর্বনিম্ন অবস্থান সূচকের সবগুলো মানদণ্ডে বাংলাদেশের দুর্বল অবস্থানই নির্দেশ করে।
আইনের শাসনের সার্বিক অবস্থা দেশের জনগণের মানবাধিকারের ওপরও প্রভাব ফেলে। ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের (এফসিও) ২০১৯ সালের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মানবাধিকারের দৈন্য দশার কথা উঠে এসেছে। বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম, সাংবাদিক ও অন্যান্যদের ওপর হামলা বজায় ছিল সেবছরও।
বৈশ্বিক সূচকগুলোতে বাংলাদেশের ভালো না করার ফলাফল হল: জাতি হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল নয়। গ্লোবাল সফট পাওয়ার ইনডেক্স ২০২১ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, অসাধারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থাকা সত্ত্বেও বৈশ্বিক পর্যায়ে রাষ্ট্র, করপোরেশন ও সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করার ক্ষমতা কমেছে বাংলাদেশের। কোন একটি রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগ ছাড়াই গণমাধ্যম ও সংস্কৃতির মাধ্যমে অন্যান্য দেশকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাই হল সফট পাওয়ার।
বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কেন উজ্জ্বল নয়? দেশের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার দায়িত্ব কাদের আর ক্ষুণ্ণ করার দায় কার?
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনই দেখা যাক। সংবিধানের ১৫২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, "রাষ্ট্র" বলিতে সংসদ, সরকার ও সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ অন্তর্ভুক্ত।
রাষ্ট্র গঠনকারী স্তম্ভগুলোর কার্যক্রমই নির্ধারণ করে দেয় রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি কেমন হবে। কার্যকর ও বিচক্ষণতার সাথে কার্যক্রম পরিচালিত হলেই দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। কিন্তু তারাই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হলে সার্বিক চিত্র বিপরীত দিকে মোড় নেবে।
কল্যাণকর আইন, সেসব আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা এবং আইনের অপব্যবহার না করার দায়িত্ব সংসদ, সরকার ও অন্যান্য সরকারি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের। 'গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া'কে কেন্দ্র করে সব কার্যক্রম পরিচালনা ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সংবিধানের প্রস্তাবনার অঙ্গীকারগুলো তাদের মেনে চলতে হবে।
এসব অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হলেই রাষ্ট্র জনগণের মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এবং মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখাতে ব্যর্থ হবে।
ঘন ঘন এসব অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুতি দেশে প্রতিনিয়ত এমন ধরনের নতুন ঘটনার জন্ম দেবে, যাতে মুশতাকের মতো আরও অনেকের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু হবে বা এর ফলভোগ করবে।
রাষ্ট্রের সব স্তম্ভ যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে নাগরিকদের এধরণের সমালোচনাকে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার দায় দেওয়া যায় না। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা যখন রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভ যেমন সংসদ ও সরকারের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তখনই রাষ্ট্র ভাবমূর্তি সংকটে ভোগে। দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনেক দেশের অবস্থাই এমন, তাদের নীতি নির্ধারকরা সমালোচনামূলক মন্তব্যের জন্য নাগরিকদের রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার দায়ে অভিযুক্ত করেন। এটি নিজেদের ভুল ও ব্যর্থতা ঢাকার একটি কৌশল মাত্র।
নরওয়ে, সুইডেন ও অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশের মত উন্নত দেশগুলো সরকার বা ক্ষমতাসীন কোন ব্যক্তির প্রতি সমালোচনামূলক মন্তব্যের জন্য তাদের নাগরিকদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ আনে না। বৈশ্বিক অঙ্গনে তাদের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল; গণতন্ত্র, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও আইনের শাসন সূচকসহ অন্যান্য সূচকেও তাদের অবস্থান ভাল।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো 'আক্রমণাত্মক' মন্তব্য, পোস্টিং বা শেয়ারের কারণে অনেকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেশের 'ভাবমূর্তি' ক্ষুণ্ণ করার। আসলেই দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নানা সূচকে দেশের যে ভাবমূর্তির প্রতিফলন দেখা যায় তা আসলেই উদ্বেগের বিষয়। যাদের দায়িত্ব পালনে গাফিলতি বা ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে আন্তর্জাতিক সূচকে দেশের খারাপ চিত্র প্রকাশ পায় তাদের সম্পর্কে কি কখনো দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের অভিযোগ আনা হয়েছে? তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
তবে, এখনই সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের অন্যতম ইতিবাচক দিক। তবে মনে রাখতে হবে, শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারে না। কারণ শুধু জিডিপি দেশের জনসাধারণের উন্নত জীবন যাত্রার মান নির্দেশ নয়। মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও স্বাধীনতাই জনসাধারণের জীবন যাত্রায় গুণগত পরিবর্তন আনতে পারে।
- লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা: When a state suffers from an image crisis
- অনুবাদ: রাফিয়া তামান্না