শাহীনবাগ, কৃষক আন্দোলন এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির পরিক্রমা
বিশ্ব যখন করোনায় আক্রান্ত, প্রায় অর্ধেক পৃথিবী যখন রুদ্ধদ্বারে আবদ্ধ; ঠিক সেই সময় ভারতের পার্লামেন্টে ঘটে গেল এক ঘটনা।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পার্লামেন্টে ভারত সরকার 'ফারমার্স বিল' নামক তিনটি কৃষি বিল উপস্থাপন করে এবং পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে- তা পাস হয়। বিল নিয়ে কৃষকরা বিরোধিতা শুরু করেন প্রথম থেকেই। এরমধ্যে একটি বিষয় হচ্ছে; কৃষি বিলে ন্যুনতম মূল্য নির্ধারণ করার কোন সুযোগ নেই।
দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল; কৃষক এবং বাণিজ্যিক সংস্থার ক্রেতার মধ্যে যদি কোন মতবিরোধ হয়, তাহলে আদালতে যাওয়া যাবে না। সমাধান করতে হবে জেলা কমিশনারের মাধ্যমে।
এরকম অস্পষ্ট কিছু বিধি-বিধান নিয়েই কৃষকদের মধ্যে থেকে প্রতিবাদ শুরু হয়। লক্ষণীয় হচ্ছে যে, যারা এই প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, দিল্লিতে যারা অবরোধ করেছেন; তাদের পরিচয় কী?
দিল্লি অবরোধের নেতৃত্ব প্রদানকারী জনগোষ্ঠী হচ্ছে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার । পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার জাট ও শিখ সম্প্রদায়ের প্রধান্য। এদের দিয়ে গঠিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর রেজিমেন্টও আছে। দুটি সম্প্রদায়ের প্রত্যেক পরিবার থেকেই পুরুষরা সেনাবাহিনীতে কর্মরত, আবার এদের অনেকেই কৃষিকাজে লিপ্ত।
ভারতের ভূমি ব্যবস্থার মধ্যে দেখা যায় যে, বৃহৎ কৃষকদের অবস্থান একমাত্র পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার। ভারতের অন্যান্য অংশে আছেন ক্ষুদ্র কৃষক। বাংলাদেশে আমাদের যেমন ক্ষুদ্র কৃষক, তেমনি সর্ব-ভারতীয় আঙ্গিকে ক্ষুদ্র কৃষকদের ব্যাপক সংখ্যা দেখতে পাওয়া যায়। নয়া কৃষি আইন নিয়ে পাঞ্জাব হরিয়ানা ছাড়া অন্যান্য রাজ্যে তেমন কোন বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়নি।
সেপ্টেম্বর মাসের আইনগুলোকে কেন্দ্র করে নভেম্বর থেকে আজপর্যন্ত দিল্লিকে অবরোধ করে যে কৃষক আন্দোলন চলছে, সেখানে সর্বাত্মক বল প্রয়োগের রাস্তায় যায়নি ভারতের সরকার। এর কারণ কী?
দিল্লির শাহীনবাগে 'সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন' বিরোধী আন্দোলনে বিজেপির সশস্ত্র পান্ডা এবং রাষ্ট্রের পুলিশ সেই আন্দোলনকে দমন করেছিল কয়েকদিনের মাথায়। কিন্তু, পাঞ্জাবের কৃষক বিদ্রোহ কিংবা আন্দোলনে- তা কেন ঘটছে না? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বটে। ভারতীয় সুশীল সমাজের কখনো কখনো পাঞ্জাবের বিলের সমালোচনা এবং কৃষকদের সমর্থনেও নেমে পড়ে।
এই সুশীলদের একটি বিরাট অংশের সাথে ক্ষমতাসীন বিজিপি'র সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আছে। আন্দোলনকারী কৃষক সমাজের একটি বিরাট অংশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকায় ধারণা করা হয়, বলপ্রয়োগ না করার কারণ সম্ভবত অতীতের শিখ জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহ তাদের মনে আছে।
সেই বিদ্রোহের প্রথম স্ফুলিঙ্গে কংগ্রেস প্রধান ইন্দিরা গান্ধীর জীবন অবসান ঘটেছিল। স্বর্ণ মন্দিরের ইতিহাস এবং যারা কংগ্রেসের ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করেছিল সেই সময়ে, সেই দুই পাঞ্জাবীর ছবি এখনো শহীদ হিসেবে রক্ষা করা হচ্ছে স্বর্ণমন্দিরে। আজও পাঞ্জাবের মানুষ সবসময় শ্রদ্ধাভরে তাদের স্মরণ করে। সেকারণে ধারণা করা যেতে পারে যে, পাঞ্জাবের কৃষক বিদ্রোহকে বিজেপি শক্তহাতে দমন করছে না, যেটা শাহীনবাগে তারা দেখিয়েছে।
শাহীনবাগ-এর ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিল ভারতীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী মূলত মুসলিমরা। শাহীনবাগ আন্দোলন কাভার করা গণমাধ্যমকর্মীদের যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে, পাঞ্জাবের গণমাধ্যমকর্মীদের কেউ সেভাবে আক্রমণ করছে না।
পাঞ্জাব কৃষক আন্দোলন থেকে ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার বিষয়টিও উঠে আসে। এতে বোঝা যায়, অঞ্চলভেদে রাষ্ট্রটি তার সমস্ত বলপ্রয়োগ করতে পারে না। এমনকি সুপ্রিমকোর্ট কৃষি বিল'কে স্থগিত করার একটা ঘোষণা দিয়েছিলেন, পাঞ্জাবের কৃষকরা তা প্রত্যাখ্যান করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারও দেড় বছরের জন্য স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছিল, যা আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রত্যাখ্যান করে।
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সমর্থক কর্মী। আজকে পাঞ্জাবিরা দিল্লির চতুর্দিকে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এথেকে বোঝা যায়, ভারতে বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিও বিকশিত হচ্ছে।
যে পাঞ্জাবে দীর্ঘদিন যাবৎ বিজেপি এবং আকালি দলের সরকার ছিল; সেই পাঞ্জাব আজকে সম্পূর্ণ তাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এরসঙ্গে, কৃষকের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট দাবি সম্পৃক্ততার থেকে বেশি হচ্ছে রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে।
কৃষক আন্দোলনের নেতাদের মৌলিক যাবি ন্যূনতম মূল্য; অথচ মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার কোন মূল্য গ্যারান্টি দিতে পারে না। আজকে ভারতের অর্থনীতির যা বিকাশ ঘটেছে- তা সবই মুক্তবাজার অর্থনীতির কল্যাণে।
দেশটি মুক্তবাজার অর্থনীতির যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৯২ সালে। ২০০৬ সালের একটি রিপোর্টে দেখা যায়, তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার কৃষি সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করেছিলেন, সেই কমিশনের তথ্য- উপাত্ত থেকে দেখা যায়, পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় জমির মালিকানা বৃহৎ কৃষকদের হাতে।
ভারত কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় চীন, আমেরিকা এবং জাপান থেকে অনেক পিছিয়ে। প্রতি হেক্টরে ভারতে যেখানে মাত্র ৩০০০ কেজি শস্য উৎপাদিত হয়, সেখানে আমেরিকানের উৎপাদন ৬০০০ কেজির উপরে।
কৃষির পূর্ণ সংস্কারে তাই দরকার; ভূমি বণ্টন ও বিপণন ব্যবস্থা এবং বৃহৎ পুঁজি বিনিয়োগ। এছাড়া, ভারতের পক্ষে উৎপাদনে; চীন কিংবা আমেরিকার সমকক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। সেকারণেই কৃষকদের এবং তাদের নেতাদের এই বাস্তবতা মানতে হবে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক