১৯৭১: সাংবাদিক জেমস স্টেরবার স্মৃতিতে ঢাকা
নিউইয়র্ক টাইমসের জাকার্তা প্রতিনিধি ছিলেন জেমস স্টেরবা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি টোকিওতে ছিলেন টেক্সটাইল শিল্পের বিরোধ সম্পর্কিত প্রতিবেদনের কাজে। তার সম্পাদক নভেম্বর মাসে তাকে ঢাকায় যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেসময় দিল্লিতে অবস্থানরত সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গ ও চার্লস মোরের সূত্রে জানা যায়, শীঘ্রই সংঘাত চূড়ান্ত রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে। একারণেই মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একজন সাংবাদিক পাঠানোর দরকার পরে নিউইয়র্ক টাইমসের, সেসময় শ্যানবার্গও ঢাকা থেকে বহিষ্কৃত ছিলেন।
সেসময় করাচি হয়ে টোকিও থেকে ঢাকা যেতে হতো। (ভারত পাকিস্তানের সরাসরি ফ্লাইট না থাকায় দিল্লি প্রতিনিধিকে ফ্রাঙ্কফুট হয়ে করাচি যেতে হয়েছিল)। স্টেরবা নভেম্বরে প্রথম ঢাকায় যান, তারপর আবার ২রা ডিসেম্বর ঢাকায় আসেন। যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশেই ছিলেন তিনি। দিনাজপুরে পৌঁছে কিছু পাকিস্তানি অফিসারদের সাথে দেখা হয় তার, তারা স্টেরবা-কে বলছিলেন ভারতের যেকোনো আগ্রাসন দমনে প্রস্তুত পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সেখানে কোরিয়ান যুদ্ধের সময় উপস্থিত থাকা কিছু সাংবাদিকও ছিলেন। সাংবাদিকরা পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের যুদ্ধের সম্মুখভাগ কোথায় জিজ্ঞেস করতেই তারা আঙ্গুল উঁচিয়ে অদূরেই অবস্থিত একটি জায়গা দেখিয়ে দেয়। সাংবাদিকরা সেখানে কিছু কামান দেখতে পান, একজন সাংবাদিক নিচে তাকিয়ে তার দেখতে পান। স্টেরবা ও অন্যান্য সাংবাদিকরা বুঝতে পারেন তারা একেবারে সম্মুখভাগেই আছেন, কারণ ঠিক সেখানেই তারের শেষ সীমানা ছিল।
কান রাইলি সহ অন্যান্য সাংবাদিকদের সাথে দিনাজপুর থেকে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার পরই সংঘাত শুরু হয়। ঢাকায় আটকা পড়েন তারা। কারফিউর সময় তারা মোমবাতি জ্বালিয়ে পোকার খেলতেন। রেড ক্রসের চেষ্টায় হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালকে নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করা হয়। একারণে হোটেল প্রাঙ্গন থেকে অস্ত্র সরিয়ে ফেলতে তল্লাশিও চলানো হয়। ডোনাল্ড ওয়াইস নামের একজন সাবেক প্যারাট্রুপার ও সাংবাদিকের নেতৃত্বে কক্ষগুলোতে তল্লাশি চালানো হয়, কিছু কক্ষে অনেক পাকিস্তানিও ছিল সেসময়। তল্লাশির সময় খুঁজে পাওয়া একটি বোমাও নিষ্ক্রিয় করা হয়েছিল। একদিন হোটেলের পাশেই বোমা বিস্ফোরণের পর বোমার খন্ডাংশ হোটেলের সুইমিং পুলে এসে পড়ে। শহরজুড়ে খাদ্য সংকট শুরু হলেও হোটেলে অবাধ সরবরাহ ছিল। একটি ড্যানিশ ডেইরি ফার্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মাখনের পুরো চালানই কিনে নিয়েছিলেন হোটেলের ব্যবস্থাপক।
যখনই কারফিউ কিছুটা শিথিল হতো, দিনের বেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে যেতেন সাংবাদিকরা। পরবর্তীতে নিউইয়র্কে স্টেরবার বাসায় যখন তার সাথে দেখা করতে যাই, হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের ছাদ থেকে দেখা ভারত পাকিস্তানের রুদ্ধশ্বাস বিমান যুদ্ধের বর্ণনা দেন তিনি।
"আমরা ইন্টার কন্টিনেন্টালের ছাদেই ছিলাম। এখান থেকেই পাকিস্তানের এফ-৮৬ ও ভারতের মিগ-২১ বিমানের লড়াই সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল। সবগুলো টিভি ক্যামেরাতেই এ দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ ভারতীয় মিগ পাকিস্তানি বিমানকে পেছন থেকে ধাওয়া করছিল, পরক্ষণেই আবার পাকিস্তানি বিমান ঘুরে গিয়ে প্রচণ্ড বেগে ভারতীয় মিগের পেছনে চলে যাচ্ছিল। রুদ্ধশ্বাসে হোটেলের ছাদ থেকেই এসব দৃশ্য দেখেছি আমরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিমান যুদ্ধের সেরা ছবিগুলো তোলা হয়েছিল সেসময়েই। ভারতীয় একটি মিগ বিমানের গায়ে গুলি লাগা ও পাইলটের জরুরি অবতরণের দৃশ্যও ক্যামেরায় ধরা পড়ে। সংঘাত চলাকালীন সময়ে ভারতীয় জেট হোটেলের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় আমাদের লাফ দিয়ে সরে যেতে হতো।" বলেন স্টেরবা।
কখনো কখনো দিনের বেলায়ও বিমান যুদ্ধ চলতো, কান রাইলি তার দেখা অভিজ্ঞতার ব্যাপারে বলেন, "হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের ওপর তলার জানালাগুলো থেকে ঢাকা এয়ারপোর্টে বা আরও কয়েক মাইল দূরে ভারতীয় মিগের প্রতিঘন্টার চক্করের দৃশ্য দেখা যেত। নীল আকাশে মেঘের মধ্যেই বিক্ষিপ্তভাবে পাকিস্তানি বিমানের গুলিবর্ষণ চোখে পড়ছিল। এয়ারপোর্টের দিক থেকে কালো ধোঁয়া ভেসে আসছিল। আকাশকে মনে হতো বিশাল স্ক্রিন, পুরো দৃশ্যকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ত্রিমাত্রিক চলচ্চিত্র মনে হতো।"
ধারণকৃত দৃশ্যগুলো ঢাকা থেকে নিরাপদে নিয়ে আসাই সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। পাকিস্তানি অফিসাররা ভারতীয় আগ্রাসনের দলিল হিসেবে ফিল্মরোলগুলো নিয়ে যেতে সম্মতি দেয়, তবে ফ্লাইট মায়ানমারের রাঙ্গুনে পৌঁছানোর পর বার্মিস কাস্টোমসে রোল গুলো রেখে দেয়া হয়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, মেজর জেনারেল কে.পি. কান্দেথের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের আগেই পশ্চিম পাকিস্তানে সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব ঢাকাকে দখলমুক্ত করার বিস্তারিত পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেন। ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা জয়সালমিরে প্রবেশের চেষ্টা করলেও ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের ঠেকিয়ে দেয়। জয়সালমিরে প্রবেশের চেষ্টায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণে রাজস্থানের লঙ্গেওয়ালার সীমান্তে কোণঠাসা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা। অপারেশন চেঙ্গিস খান অভিযানের পর ভারতীয় বিমানবাহিনী অনেক বিমান ধ্বংস হওয়ায় আবারও আকাশপথে হামলা হতে পারে তা আমলে নেয়নি পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আকাশ থেকে বোমা বর্ষণের মাধ্যমে বাড়তি সুবিধা পায় ভারতীয় সেনারা। রাতের অন্ধকারে সীমান্তের পাশে অনেকটাই দিকভ্রান্ত হয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। তারপর দিনই বাসান্তর এলাকা দখলে নেয় ভারতীয় সেনারা।
৮ ডিসেম্বর ভারতের নৌবাহিনী করাচি আক্রমণ করে। বন্দর শহর করাচির নৌবন্দর আক্রমণের এ অভিযানের নাম ছিল অপারেশন পাইথন। এ অভিযানের আগেও অপারেশন ট্রাইডেন্ট নামের একটি অভিযান চালায় ভারতীয় নৌবাহিনী। অপারেশন ট্রাইডেন্টের পরই পাকিস্তান বন্দর অঞ্চলের আকাশপথ নজরদারি জোরদার করে, বাণিজ্য জাহাজের সাথে যুদ্ধ জাহাজ মিশিয়ে সতর্ক অবস্থানে থাকে। ৮ ডিসেম্বর রাতেই বিনাশ নামের একটি মিসাইল বোট ও তলোয়ার ও ত্রিশূল নামের দুইটি ফ্রিগেট নিয়ে করাচির দিকে এগিয়ে যায় ভারতের নৌবাহিনী। মিসাইল নিক্ষেপ করার পর দুটি মিসাইল করাচির কিমারি অয়েল ফার্মের তেলের ট্যাংকারে বিস্ফোরণ ঘটে ও পানামীয় তেলের ট্যাংকার এসএস গাল্ফ স্টার ডুবিয়ে দেয়। অন্য দুটি মিসাইলের আঘাতে পাকিস্তানি নৌ বহরের ট্যাংকার পিএনএস ঢাকা এবং ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ এসএস হারম্যাটেন ডুবে যায়। করাচির অস্ত্রের ডিপোতেও আঘাত হানে ভারতীয় জাহাজগুলো। তেল ও জ্বালানির ট্যাঙ্কারে বিস্ফোরণ ও বাণিজ্য জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায় আমদানির ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতি চাপের মুখে পড়ে যায়। পাকিস্থানের নৌযান বন্দরেই আটকা পড়ে। কয়েক মাইল দূর থেকেও করাচির বিস্ফোরণের অগ্নিশিখা দেখা যাচ্ছিল। ডিসেম্বরের শুরুতে ভারতের আইএনএস বিক্রান্ত রণতরী ডুবিয়ে দেয়ার অভিযানে গিয়ে ডুবে যায় পাকিস্তানের গাজী নামের সাবমেরিনটি। তবে তার কয়দিন পরই আরব সাগরে ভারতে আইএনএস খুকরি নামের ফ্রিগেটে টর্পেডো ছুঁড়ে প্রতিশোধ নেয় পাকিস্তান।
পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনীর লড়াই শুরুব হওয়ার পরই পাকিস্তানি বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। মুক্তি বাহিনীর ৩টি দল ও কাদেরিয়া বাহিনী সহ অসংখ্য বিচ্ছিন্ন যোদ্ধাদের সহযোগিতা করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড। ভারতের যুদ্ধবিমান পরিবাহক বিক্রান্ত থেকে যুদ্ধবিমানগুলো চট্টগ্রাম, বরিশাল ও কক্সবাজার আক্রমণ করে। ফলে পাকিস্তানের নৌবাহিনী অচল হয়ে যায়, বন্দর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পালনোর পথও থাকেনা। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা সীমান্তে পাশে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়, আক্রমণ প্রতিরোধেরও কোনো উপায় ছিলনা তাদের। দ্রুতই সীমান্তবর্তী শহরগুলোসহ অন্যান্য শহর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী দখলমুক্ত করতে থাকে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেছিল কাদেরিয়া বাহিনী। কাদের সিদ্দিকী ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি ঘাঁটির স্কেচ একে ভারতীয় বিমানবাহিনী-কে পাঠিয়েছিল। স্কেচের সাহয্যেই সে জায়গাগুলোতে বোমা বর্ষণ করে ভারতীয় বিমানবাহিনী। জামালপুরের দিকে ব্রহ্মপুত্র নদী পার করতে ভারতীয় বাহিনী বাঁধার সম্মুখীন হলে, কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করে ভারতীয় সেনাদের সাহায্য করে।
- সূত্র: ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক সলিল ত্রিপাঠির লেখা 'দ্য কর্ণেল হু উড নট রিপেন্ট: দ্য বাংলাদেশ ওয়ার অ্যান্ড ইটস আনকুইট লিগ্যাসি'
- অনুবাদ: রাফিয়া তামান্না