ন্যাটোর সম্প্রসারণ বিশ্বকে কোন দিকে নিয়ে যাবে?
স্পেনের মাদ্রিদে শুরু হওয়া বিশ্বের সর্ববৃহৎ সামরিক জোট ন্যাটো'র সম্মেলন শুরু হয়েছে গত মঙ্গলবার। ঠিক তার আগে জি সেভেনের শীর্ষ বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে। ন্যাটো সম্মেলনের শুরুতেই যে ঘোষণা এসেছে তাতে প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, নিকট ভবিষ্যতে বিশ্বে শান্তি স্থাপিত হওয়ার কোন সুযোগ আর নেই। ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের জন্য আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। অন্যদিকে, সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদান প্রশ্নে তুরস্ক আপত্তি প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
ন্যাটো র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সের সংখ্যা ৪০ হাজার থেকে বাড়িয়ে তিন লাখে রূপান্তর করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এই বাহিনী ইউক্রেনে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মত সকল সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে অবস্থান করবে। যদিও দেশগুলোর এই বর্ধিত সামরিক শক্তি নিজ নিজ দেশে অবস্থান করার কথা রয়েছে।
জি সেভেন সম্মেলনে রাশিয়ার সঙ্গে যখন তারা একটি প্রক্সি ওয়ারে লিপ্ত ঠিক তেমন সময়ে তারা নতুন করে চীনকেও সতর্ক করেছে রাশিয়ার বিষয়ে। ন্যাটো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন আগামী ৮ নভেম্বর। বর্তমানে মার্কিন সিনেট রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে ৫০/৫০ বিভক্ত। সেই কারণেই এই মধ্যবর্তী নির্বাচন অনেক গুরুত্বপূর্ণ জো বাইডেনের প্রেসিডেন্সির জন্য।
ওদিকে যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ইতোমধ্যে বরিস জনসনকে একটি অনাস্থা ভোটের মোকাবেলা করতে হয়েছে। যেখানে তার নিজ দলের বহু সদস্য তার প্রতি অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য এই দুই দেশ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ইউক্রেন যুদ্ধকে প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। এই সামরিক জোট বিশ্বকে তাদের পদানত করতে চায়।
বিশ্বের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর নিজস্ব চিন্তা করার অধিকারকে তারা সংকুচিত করেছে। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের প্রথম দিকে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ উপমহাদেশের তিনটি দেশই একই অবস্থান নিয়েছিল। ভঙ্গুর রাজনৈতিক অবস্থানের দেশ পাকিস্তান তার অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলেছে সরকার পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত করে আগের মুসলিম লীগকে ক্ষমতায় ফেরত আনা হয়েছে।
পর্দার অন্তরালে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী এবং বিচার মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এর আগে নওয়াজ শরীফের সরকারকে দুর্নীতির অভিযোগে উচ্ছেদ করে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। এখন সেই নওয়াজ শরিফের দলকেই পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
ভারতের উপরও চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপক বিকাশের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম সংকট তীব্র হয়েছে। সেই হিন্দু-মুসলিম সংকটকে কেন্দ্র করে নানাভাবে ভারতের উপর চাপ আসছে। পশ্চিম এশিয়ার যে দেশগুলো সবসময়ই পশ্চিমাদের দ্বারা পরিচালিত, তারা ভারতের ব্যাপারে প্রকাশ্যেই একটি অবস্থান গ্রহণ করেছেন ধর্মীয় ইস্যুকে কেন্দ্র করে।
যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ভারত যথার্থভাবে তা মোকাবেলা করেছে। বহির্বিশ্বের সংকট তাদের অর্থনীতির উপর এখনও তেমন খারাপ প্রভাব বিস্তার করেনি। কিন্তু চলমান রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই পড়বে। তা সত্ত্বেও কেন ন্যাটোভূক্ত ক্ষমতাশালী দেশগুলো বিশ্ব অর্থনীতিকে এই সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা এখনো অস্পষ্ট।
এই যুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে নিশ্চিতভাবে পৃথিবীর বহু দেশে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হবে। আমরাও তার অংশ হয়ে দাঁড়াব। আমাদের বাস্তবিক অর্থেই কী করার আছে তা এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না।
কৃষিপণ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকার কত দ্রুত ব্যবস্থা নেবে সেটি এখন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক নানান চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে আমাদের উপর। সরকারের প্রতিষ্ঠান ও কতিপয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বিশ্বে তাদের নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। আশার বাণী এইটুকু, চীন ও ভারতের মধ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী সীমান্ত সংকট থাকার পরেও কয়েকদিন আগেই ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল- যেখানে রাশিয়া, চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিল মিলিতভাবে নিজেদের অর্থনীতি উন্নয়নের ভাবনা ভাবছে।
বিশ্ব মুদ্রাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে তাদের আধিপত্যের আওতায় রাখতে চায়। আপাতদৃষ্টিতে মনে করা যেতে পারে, ইউক্রেন- রাশিয়ার যুদ্ধ ইতোমধ্যে পশ্চিমা বিশ্বে রাশিয়াকে একটি ঋণখেলাপি দেশে রূপান্তরিত করেছে। রাশিয়ার কাছে ঋণ সমন্বয় করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা থাকা সত্ত্বেও তারা রুশ মুদ্রা আটকে দিয়ে দেশটিকে ঋণখেলাপিতে পরিণত করেছে।
জি সেভেন সম্মেলনে একটি বিষয় সামনে এসেছে তা হল, রাশিয়ার তেলের মূল্য নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছিল জি সেভেন দেশগুলো। জি সেভেনের পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তাব জার্মানি গ্রহণ করেনি। কারণ, জার্মানি জানে এই প্রস্তাব গ্রহণ করার ভেতর থেকে ইউরোপ এক তীব্র জ্বালানি সংকটে পড়বে। যার ফলে ইউরোপের শিল্প উৎপাদনের মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটবে। নিশ্চিতভাবে বোঝা যাচ্ছে, জার্মানি এবং অন্যদের তেলের মূল্য নির্ধারণ করার বিষয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে।
তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কি ইউরোপের দেশগুলোর শিল্পোৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্যই এই যুদ্ধকে অব্যাহত রেখেছে? ইউরোপের অধিকাংশ দেশ রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। তেল গ্যাস নির্ভরশীলতা থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘস্থায়ী একটা যুদ্ধে কী কারণে ন্যাটো এগিয়ে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। তবে এই যুদ্ধে দ্রুত কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না।