ছেলেশিশুদের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে হবে
গত কয়েক মাসে যৌন হয়রানির শিকার ছেলেশিশু সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি খবর চোখে পড়লো। স্কুলে, মাদ্রাসায় এবং প্রতিবেশির হাতে ছেলেশিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। কিন্তু এই বিষয়টিকে লজ্জাস্কর মনে করায় তাদের পরিবার হয় বিষয়টি স্বীকার করে না, নয়তো লুকিয়ে রাখে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১৮ ছেলেশিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।
শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে সমাজে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে এবং আমরা অধিকাংশ অভিভাবক সেই ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করেই শিশুর উপর যৌন হয়রানির বিষয়টিকে বিচার করি। আমরা অনেকেই মনে করি শুধু মেয়েশিশু ও নারীরাই যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হয়। বাংলাদেশে প্রতি চার জন মেয়েশিশুর মধ্যে একজন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। কিন্তু আমরা কি জানি যে মেয়েশিশু ও নারীর পাশাপাশি ছেলেশিশু ও পুরুষরাও যৌন হয়রানি ও বলাৎকার বা ধর্ষণের শিকার হয়? প্রতি ছয় জন ছেলেশিশুর মধ্যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় একজন।
শুধু পুরুষের দ্বারাই শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হয়, তা কিন্তু নয়। শিশুরা কখনো কখনো নারীর হাতেও যৌন হয়রানির শিকার হয়। নারীদের বিরুদ্ধেও আছে যৌন হয়রানির অভিযোগ। শিশুর যৌন নির্যাতনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে বাড়িতে, আত্মীয় বা পারিবারিক বন্ধুদের বাড়িতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা ছাত্রাবাসে।
বাংলাদেশে শতকরা ৭৫ ভাগ শিশুর যৌন নিপীড়ক পরিবারের ঘনিষ্ঠজন। নারী বা পুরুষ শিশুকামী ও বিকৃত রুচির মানুষরা ছেলে শিশুদের উপর যৌন নিপীড়ন চালায়।
একটি পরিবারের কথা বলছি যেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকুরিজীবী ছিলেন। তাদের ছেলের যখন ৫ বছর বয়স, তখন বাসায় যে গৃহকর্মীর কাছে শিশুটি থাকতো, সে নিয়মিতভাবে শিশুটিকে যৌন নিপীড়ন করত। ক্রমে শিশুটি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে এবং ঐ গৃহকর্মীকে ভয় পেতে শুরু করলে, তারা ডাক্তারের কাছে গেলে বিষয়টি সম্পর্কে বুঝতে পারেন। এই ঘটনা তাদের ওপর এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে সেই মা শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরকম আরো কিছু ঘটনার খবর আমরা জানি।
অভিভাবকদের মধ্যে ধারণাই ছিল না যে, ছেলেশিশুরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে। শিশুর প্রতি যৌন অপরাধ হলে মুখ খুলতেই হবে, ট্যাবু ভাঙতেই হবে। অধিকাংশ শিশু হয়তো এই বিষয়টি ঠিকমতো বুঝেই না। আর সেই সুযোগেই অপরাধী ব্যক্তি শিশুকে ধর্ষণ, অজাচার (ইনসেস্ট), ওরাল সেক্স, পর্নোগ্রাফি, যৌনাঙ্গে বা মলদ্বারে কোন কিছু প্রবেশ করানো, শিশুকে নগ্ন ছবি প্রদর্শন অথবা ছবি তোলার মতো কাজগুলো করে বা করিয়ে নেয়। এগুলো সবই যৌন হয়রানি।
অসংখ্য শিশু প্রতিদিন নানা ধরনের যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এরমধ্যে মেয়েশিশুর সংখ্যা বেশি হলেও ছেলে শিশুর সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। এ বিষয়ে কথা বলতে আমরা এখনও স্বচ্ছন্দবোধ করি না, লজ্জা পাই। এরকম ঘটনা যে ঘটে তা অনেকেই স্বীকার করতে চান না, এড়িয়ে যান।
এমনকি ভুক্তভোগী শিশুটিকেও বলা হয় এ কথা প্রকাশ না করতে। নিপীড়নকারী যদি পরিবারের সদস্য হয়, তার বিরুদ্ধে সাধারণত কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না। এগুলো প্রতিটিই হলো নিজের নিপীড়িত সন্তানের প্রতি অবিচার। এগুলো গোপন করা এক ধরনের অপরাধ।
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের চাইল্ড অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি'র সহযোগী অধ্যাপক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে যৌন হয়রানির শিকার শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন। আর এই কাজ করতে গিয়ে তিনি যৌন হয়রানি নিয়ে ক্লিনিক্যাল গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণায় শিশুদের যৌন হয়রানি বিষয়ে ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। তাতে দেখা যায়, শতকরা ৭৫ ভাগ যৌন হয়রানির ঘটনাই ঘটে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু বা আত্মীয়দের মাধ্যমে এবং ছেলে শিশুরাও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে (সূত্র: ডয়েচে ভেলে)।
আমাদের পরিবার ও সমাজে মেয়েশিশুকে অনেক বাবা মা সাবধান করেন বা চোখে চোখে রাখেন। কোনটা গুড টাচ, কোনটা ব্যাড টাচ তাকে তা জানানো হয়। কিন্তু ছেলেশিশুর ব্যাপারে আমরা একেবারে উদাসীন। একটি ছেলে শিশুকে কেউ চুরি বা অপহরণ করতে পারে, কিন্তু তাকে বলাৎকার করবে, এটা তারা ভাবেন না। বাংলাদেশের সমাজে এটা খুব অপরিচিত এবং লজ্জাস্কর বিষয়। কাজেই এই ট্যাবুটাই ভাঙতে হবে প্রথমে। প্রচার করতে হবে, সাবধান হতে হবে যে শুধু মেয়ে শিশুকেই যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ করা হয় না, ছেলে শিশুকেও করা হয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিষয়টি জবাবদিহিতার সংস্কৃতির আওতায় আনতে হবে। বাবা-মা বিশ্বাস করে তাদের শিশুকে শিক্ষাঙ্গনে পাঠান, সেখানে যদি তারা এইভাবে নিপীড়নের শিকার হয় তাহলে তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। আমরা পরপর বেশ কয়েকটি খবর পেয়েছি যে শিক্ষাঙ্গনে ছেলে শিশুরা নানাভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
যৌন নিপীড়ক ব্যক্তি এমন বেশে শিশুর সামনে আসে, যখন শিশু বা তার পরিবার বুঝতেই পারে না যে তাদের সাথে কী ঘটতে পারে বা কী ঘটতে যাচ্ছে। তাকে শিশু বা শিশুর পরিবার বিশ্বাস করে। এই লোকগুলো প্রায়ই রক্ষকের ভূমিকায় এসে ভক্ষক হয়ে যায়।
শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন অনেক ক্ষেত্রে একটা শিশু নিজেই বুঝতে পারে না যে কোনটা নির্যাতন। আবার শিশু তার বাবা-মাকে বলতে না পারার পেছনে আরেকটা বড় কারণ হলো বাবা-মায়েরা সাধারণত শিশুর কথা বিশ্বাস করতে চান না। নির্যাতনের ঘটনা যদি ঘটে তাহলে কখনো বাচ্চাকে দায়ী করা যাবে না। তাকে মানসিক সমর্থন করতে হবে, তার সামনে এই ঘটনা নিয়ে বার বার আলোচনা করা বা কান্নাকাটি করা যাবে না।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন না হওয়ার কারণে কাওমী মাদ্রাসায় ঠিক কী হচ্ছে এবং কীভাবে এখানে নিপীড়ন বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব, তা স্পষ্ট নয়। কাওমী মাদ্রাসাসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা এতদিন ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হলেও এখন সেইসব ঘটনা ক্রমশ সবার সামনে চলে আসছে।
দরিদ্র ঘরের অনেক শিশু কাওমী মাদ্রাসায় থাকা খাওয়ার সুবিধা পায় বলে এখানে পড়তে আসে, কাজেই তাদের উপর নির্যাতন করা হলে, তাদের পক্ষে মুখ খোলার কেউ থাকেনা। সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে শিক্ষাঙ্গনে বা মাদ্রাসায় কী হচ্ছে এবং কী হতে পারে। সময় এসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতন বন্ধে একটা সামগ্রিক পদক্ষেপ নেওয়ার।
বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ছেলেশিশুর প্রতি যৌন হয়রানি ও বলাৎকার প্রসঙ্গে কোনো স্পষ্ট ধারণা দেয়া হয়নি। তাই আইনজীবী ও পুলিশের কাছেও এটি পরিস্কার নয়। বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের যে সংজ্ঞা, সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী ও মেয়েদের কথাই বলা রয়েছে। আইনের এই দিকটার সুযোগ গ্রহণ করছে অপরাধীরা।
পরিবারে বা পরিবারের বাইরে, বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনে কোনো শিশু (মেয়ে কিংবা ছেলে) যৌন হয়রানির শিকার হলে তা গোপন না করে মুখ খুলতে হবে আমাকে, আপনাকে, সবাইকে। সাহায্য চাইতে হবে শিশুর হয়ে এবং শিশুর জন্য। কোনো শিশু যৌন হয়রানির শিকার হলে তাকে বকা দেওয়া, ভয় দেখানো বা লুকিয়ে থাকতে বলা যাবে না।
শিশুকে বলতে হবে তার প্রতি যে অন্যায় ও খারাপ আচরণ করা হয়েছে এর জন্য তার কোনো দোষ, ভয় বা লজ্জা নেই। লজ্জা বা দোষ সেই ব্যক্তির, যে তার সঙ্গে এই খারাপ আচরণ করেছে। কথা বলতে হবে প্রফেশনাল ক্রাইসিস কাউন্সিলরের সাথে। পরিবারের ভেতরে এবং শিক্ষাঙ্গনে শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়ন প্রতিহত করার জন্য পরিবার, সমাজ ও সরকারকে আরও অনেক বেশি তৎপর হতে হবে। সেইসঙ্গে ছেলেশিশুর প্রতি যৌন নিপীড়নের বিষয়টিকে আর এড়িয়ে না গিয়ে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে।
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন