সাবদার সিদ্দিকী: বড় নিঃসঙ্গ আমি আজ
কবি সাবদার সিদ্দিকী সম্পর্কে আমরা যতটা জানি, তারচেয়ে বেশি মনে হয় জানি ব্যক্তি সাবদার সিদ্দিকী সম্পর্কে।
মানুষের ব্যক্তিগত জীবন যখন খুব বেশি এলোমেলো হয়ে যায়, তখন তার সৃষ্টিকর্মের চেয়েও তার জীবনাচরণই মুখ্য হয়ে ওঠে। কবিতার চেয়ে তার উদ্ভ্রান্ত, উন্মুল, বাউন্ডুলে, বোহেমিয়ান জীবন নিয়ে আমাদের কথাবার্তা বেশি। সাধারণত তার কবিতা নিয়ে কথা বেশি বলা হয় না। কয়দিন আগে, তর্ক বাংলায় সাবদার সিদ্দিকীকে নিয়ে 'গণমননের কবি সাবদার সিদ্দিকী' শিরোনামে একটা লেখা লিখেছেন কবি মাহবুব হাসান। আমি সেজন্য খুব সাধুবাদ জানাই তাকে। একটা বড় ঘাটতি ছিল, সেটা কিছুটা পূরণ হলো।
আমি সাবদার ভাইকে চিনি ১৯৭২ সাল থেকে
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল ঢুকেছি। কয়েকজন ভারতীয় নকশাল বাংলাদেশে এসে এদেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করছিল তখন। বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনীতিবিদদের কয়েকজনও তখন তাদেরকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। আর এটা সবার কাছে গোপনীয় বিষয়ও ছিল না। কিছু লোকজন জানতো যে তারা কলকাতার মানুষ, এখানকার গোপন রাজনীতির সঙ্গেও তারা জড়িত।
যা-হোক, এই কলকাতার কিছু মানুষের মাধ্যমেই সাবদার ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়।
সাবদার ভাইয়ের সঙ্গে কলকাতার সম্পর্ক ছিল বেশ নিবিড়
তিনি খুব ঘন ঘন কলকাতায় যেতেন। কলকাতার জন্য ছিল তার অন্যরকম মায়া। কলকাতার মানুষকে তিনি পছন্দ করতেন এবং প্রচুর চেনাজানা লোক ছিল তার সেখানে।
সেই হিসেবে নকশালপন্থীদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। সে সময়কার একজন লেখক আমাকে বলেছিলেন যে, সাবদার ভাই কট্টরপন্থী রাজনীতি করলেও, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
তবে সাবদার ভাইয়ের রাজনৈতিক দিকটি নিয়ে মানুষ তেমন কথা বলে না। বা জানেনা।
সাবদার ভাই ক্রমেই এভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন সবার থেকে
কিছু মানুষ তাকে অপছন্দ করতো। তবে আমার খুব ভালো লাগতো তাকে। আমাকেও তিনি খুব স্নেহ করতেন। আমার মায়ের পরিবার ওপার বাংলায় হওয়ায়, সাবদার ভাই হয়তো আরও বেশি আপন ভাবতেন আমাকে।
সাবদার ভাই একজন উন্মুল মানুষ ছিলেন। তার থাকার কোনো জায়গা ছিল না, ঘুমানোর জায়গা ছিল না। যেখানে জায়গা পেতেন, সেখানেই রাত কাটাতেন। কোথায় খাচ্ছেন, কী করছেন না করছেন তার কোনো ঠিক ছিল না। একবার কাকে যেন কী গালি দিয়েছিলেন, আমার চোখের সামনে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন থেকে তাকে মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হলো কলাভবন পর্যন্ত।
সাবদার ভাই আমার বাসাতেও আসতেন মাঝে মাঝে। আমার মা খুব যে তাকে পছন্দ করতো, তা না। সেটা অবশ্য সাবদার ভাইয়ের চালচলনের কারণে। বাসার মধ্যে দুয়েকবার গাঁজা খাবার চেষ্টাও করেছেন। সাবদার ভাইয়ের একটি দিক হলো, তিনি মদ খেলে খুব উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়তেন। সে কারণে দুয়েকবার তাকে মারও খেতে হয়েছে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ তার ভালো বন্ধু ছিলেন। শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে কবি নির্মলেন্দু গুণ ও সাবদার ভাই একসঙ্গে আড্ডা দিতেন। একবার আমাদের বাসায় দুজনেই এসেছিলেন। দুজনে মিলে কথা বলতে বলতে সাবদার ভাই হুট করে সামনের টেবিলে একটা লাত্থি মেরে বসলেন।
গুণদা তখন বললেন, 'এগুলো কী হচ্ছে সাবদার? এটা ভদ্রলোকের বাসা, এগুলো করে নাকি কেউ?'
সাবদার ভাই এরপর চুপ করে বসে রইলেন।
'৭৯-এর দিকে সাবদার ভাই কবিদের এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেখানে সব কবিরা মিলে একসাথে মদ খাওয়ার পর, সাবদার ভাইকে বালুর ঢিপির মধ্যে পুঁতে দিয়েছিল বাকি কবিরা। তারা সবাই মাতাল ছিলেন।
তার এরকম বিশৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য অনেকেই তাকে অপছন্দই করত। কলকাতা থেকে আসা মানুষগুলোর মধ্যে যাদের সঙ্গে সাবদার ভাইয়ের একটু ঘনিষ্ঠতা ছিল, তারাও ৭৩-৭৪-এর দিকে চলে গেল।
সাবদার ভাইও ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন সবার থেকে।
তার কবিতা কিন্তু অনেকেই খুব পছন্দ করত
দৈনিক বাংলা বা বিচিত্রায় (আমার ঠিক মনে নেই) তখন কবি এবং কবিতার ওপরে কলাম বের হতো। সেখানে হেলাল ভাইকে ( হেলাল হাফিজ) নিয়ে যেমন লেখা হয়েছিল, সাবদার ভাইকে নিয়েও লেখা হয়েছিল।
৭৪ এর শেষের দিকে আমি একটা পত্রিকা বের করেছিলাম, সেখানে সাবদার ভাইয়ের একটি বিশাল কবিতা ছেপেছিলাম। সে কবিতার একটা লাইনি কেবল মনে আছে।
'সাবদার করে আবদার,
কিছু হয়না, কেন হয়না
কী হবে না জানিনা, জানি না'
অর্থাৎ তার রুজি বা আয় কোনোকিছুই ছিল না। কিন্তু সে যে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছিল, তা কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই!
'আমি একজন কবি। আমার জন্য আবার বর্ডার গার্ড কী।'
সাবদার ভাই বলেছিল, সে ভারতে যাবার সময় তাকে বর্ডারগার্ড আটকেছিল। তখন না-কি তিনি গার্ডদের বলেছিলেন, 'আমি একজন কবি। আমার জন্য আবার বর্ডার কী।'
তখন গার্ড কবির প্রমাণ দেখতে চাইলে, তিনি তখন আমার সম্পাদিত ঐ পত্রিকা থেকে তার কবিতাটি পড়তে দেন। তারপর তাকে যেতে দেওয়া হয়।
একদিন কী কারণে আমি খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। সাবদার ভাই এসে আমার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, 'কী হয়েছে তোমার?' কিন্তু সাবদার ভাইয়ের এই মর্মস্পর্শী দিকটি কিন্তু অন্যরা অতটা দেখেনি। কারণ তিনি অন্যদের কাছে নিজের ব্যাপারে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে রেখেছিলেন।
সাবদার ভাইয়ের শরীর আস্তে আস্তে খারাপ হতে শুরু করলো। শুধু শরীর না। মানসিক দিক থেকেও ভারসাম্য হারাতে শুরু করেছিলেন। দেখাসাক্ষাৎও কমে আসতে লাগলো। আমি তখন চাকরিতে চলে গেছি ১৯৭৮ সালে। শেষ পর্যন্ত আশির দশকে তার সঙ্গে আমার দেখা হলো কলকাতায়। সেখানে একদিন দেখলাম কলকাতার জাদুঘরের কাছে বসে আছে সাবদার ভাই। কথাবার্তা বললেন একদম মানসিকভাবে উদ্ভ্রান্তের মতো। আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম তার অবস্থা দেখে। একদম রাস্তার পাগলদের মতো হয়েছিল। শেষদিকে ভিক্ষুকের মতোই জীবন কাটিয়েছেন তিনি। মাঝেমধ্যে পুরান ঢাকার আরমানিটোলার কবরে থাকতেন শেষদিনগুলোতে। শেষ পর্যন্ত সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে।
তার এই উন্মুল জীবনই হয়তো তার কবিতাকে আর প্রসারিত হতে দেয়নি।
- লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক